Bangla - রহস্য গল্প

The Diary of John Watson

Spread the love

Rakhi Pradhan


Part 1: কলকাতার সেই অজ্ঞাত রাজবাড়ি

লন্ডনের শীতল বিকেল। ধূসর আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে জন ওয়াটসনের একমাত্র নাতনি, ক্লারা ওয়াটসন, বক্স খুলে দেখছিলেন এক চামড়ার বাঁধানো ডায়েরি। এটি ছিল তার দাদুর, ডঃ জন এইচ. ওয়াটসনের। বাইরে লেখা—“Personal — Not for Publication”।

ক্লারা ছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক। এক আন্তর্জাতিক বইমেলার সূত্রে কলকাতায় এসেছিলেন। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে সে হঠাৎ ভাবলেন—এ শহরটায় কি ওয়াটসনের পা পড়েছিল? সম্ভব কি? তার দাদু তো সবসময় শার্লক হোমসের কেস নিয়ে ঘুরতেন ইউরোপ আর ব্রিটেনে।

ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা:

“১৮৯৪ সালের গ্রীষ্ম। হোমস তখন ভীষণ বিমর্ষ। মোরিয়ার্টির মৃত্যুর পরে তার মধ্যে এক ধরণের ফাঁকা ভাব। সেই সময়ে, এক বিস্ময়কর চিঠি এল ভারত থেকে।”

চিঠিটি ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক উচ্চপদস্থ কর্তা, মিস্টার আর.এম. ক্যাম্পবেল-এর কাছ থেকে। চিঠিতে অনুরোধ করা হয়েছিল শার্লক হোমস এবং জন ওয়াটসনকে ভারতে আসতে—এক রহস্যজনক হত্যাকাণ্ডের তদন্তে।

ঘটনাস্থল ছিল রাজবাড়ি ভবানীপুর, কলকাতার উপকণ্ঠে একটি পুরনো জমিদারবাড়ি। অভিযোগ ছিল—প্রতি পূর্ণিমায় বাড়ির ভেতরে ঘটে এক অলীক ঘটনা, এবং শেষ তিন পূর্ণিমায় একে একে তিনজন প্রাক্তন ব্রিটিশ রেসিডেন্ট নিহত হয়েছেন।

হোমস চিঠি হাতে নিয়ে বলেছিলেন, “This smells of human mischief, Watson. Not ghosts.”

কিন্তু ওয়াটসন লিখেছেন, “তার চোখে সেদিনের আগুনটা আমি আগেও দেখেছি—Reichenbach Falls-এর ঠিক আগে।”

১৮৯৪ সালের ২১শে জুলাই। তারা কলকাতায় নামলেন হাওড়া ঘাটে। তখনকার কলকাতা—বিলেতি ধাঁচের, তবু গরম, আর্দ্র, ছায়া-মোড়া।

তাদের গ্রহণ করলেন মিস্টার ক্যাম্পবেল নিজে। তিনি সাদা ঘোড়ার গাড়িতে তুলে বললেন, “Gentlemen, this isn’t just a murder case. It’s a legend.”

ভবানীপুরের রাজবাড়ি তখন প্রায় ভগ্নপ্রায়, কিন্তু এখনও অভিজাত। লাল ইটের দরজা, লোহার গেট, গায়ে জমে থাকা শ্যাওলা। ভেতরে বিশাল প্রাঙ্গণ, মন্দির, আর মাঝখানে একটা ছোট্ট ঝরনা, যেটা নাকি “রক্তে রঞ্জিত” হয় পূর্ণিমার রাতে।

সেই রাতে তারা উঠলেন রাজবাড়ির ভেতরের অতিথি কক্ষে। ঘরে সিলিং ফ্যানের বদলে ছিল পালক-বসানো হ্যাণ্ড ফ্যান, যেটা এক মহিলা রোজ এসে চালিয়ে দিতেন। নাম মৃণালিনী—বাড়ির পুরোনো কাজের মেয়ে।

রাত গভীর হলে, হঠাৎ করেই শোনা গেল ঘুঙুরের আওয়াজ।

হোমস উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “Watson, are you hearing that?”

ওয়াটসন লিখেছেন—“আমি শুনেছিলাম। কিন্তু সেই আওয়াজে যেন মিশে ছিল এক করুণ আর্তনাদ। এমন কাঁপুনি আমার হৃদয়ে অনেকদিন হয়নি।”

দ্বিতীয় তলায় একটি ঘর—যেটা তালাবদ্ধ—সেখান থেকেই আওয়াজ আসছিল। মৃণালিনী ফিসফিস করে বললেন, “ওটা ঠাকুরঝি-র ঘর, সাহেব। উনি এখনও আসেন।”

হোমস বললেন, “Dead people don’t walk, Ms. Mrinalini.”

তিনি তৎক্ষণাৎ সেই তালাবদ্ধ দরজা পরীক্ষা করতে গেলেন।

তখন হঠাৎ ঝড় শুরু হল।

পরদিন সকালে ক্যাম্পবেল খবর দিলেন—ঝরনার জলে আজ আবার লাল ছোপ দেখা গেছে।

হোমস বললেন, “Let’s examine the water source.”

ওয়াটসনের ডায়েরি জানাচ্ছে, তিনি সেদিন ঝরনার পাশেই খুঁজে পান একটা পুরনো কাচের কেস—ভেতরে একটি প্রাচীন সংগীত বাক্স, যার নিচে লেখা “For Anindita, from F.”

কে এই অনিন্দিতা? কে এই “F”? আর কেন সেই ঘরে এখনও বাজে ঘুঙুর?

Part 2: অনিন্দিতার সংগীত বাক্স

ঝরনার কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলেন হোমস, চোখে তার অদ্ভুত তীব্রতা। আমি তখন সংগীত বাক্সটা হাতে করে পরীক্ষা করছিলাম। তার গায়ে খোদাই করা লেখা—

“For Anindita, from F.”
তাঁতের মতো সূক্ষ্ম হাতে লেখা। খুব স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছিল, এই বাক্সটা শুধুই স্মৃতিচিহ্ন নয়—এর ভেতরে লুকিয়ে আছে কিছু।

হোমস হঠাৎ বললেন,
“Watson, do you smell that?”

আমি নাক টেনে দেখলাম—হ্যাঁ, জল থেকে ভেসে আসছে গন্ধ। রক্তের গন্ধ নয়—বরং লোহার মতো, যেন পুরনো ধাতব কিছু ভিজে উঠছে।

হোমস সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়লেন ঝরনার উৎসের দিকে। জলগম্ভীর স্বরে বললেন,
“Someone’s been using iron oxide. It creates a reddish hue in water. Quite theatrical.”

আমি বললাম, “মানে কেউ ইচ্ছে করে এই ‘রক্ত’ সৃষ্টি করছে?”

হোমস বললেন, “Exactly. And whoever it is, wants this house to remain feared. Superstition is a tool, Watson. The sharpest one in the criminal’s kit.”

তবে বাক্সটা নিয়ে আমি যতটা চিন্তিত ছিলাম, হোমস ততটাই কৌতূহলী। তিনি বললেন,
“Let’s examine this closer. There’s more to Anindita’s music box than just nostalgia.”

রাত নেমে এলে আমরা রাজবাড়ির পুরনো লাইব্রেরিতে বসে বাক্সটি খুলে দেখি। ভেতরে ছিল এক সুরযন্ত্র, যা ঘুরিয়ে চালালে একটি রাগ বাজতে শুরু করে—রাগ ভৈরবী।

হোমস চোখ বন্ধ করে শুনলেন কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎই বললেন,
“Watson, do you remember the symbol on the lid?”

আমি আবার বাক্সের ঢাকনায় তাকালাম। সেখানে ছোট্ট করে খোদাই করা ছিল এক পুষ্পাকৃতির প্যাটার্ন—ঠিক যেন পদ্মফুল।

হোমস বললেন,
“This flower is not just decorative. Look beneath the left petal.”

আমি একটু চেপে ধরতেই সেটি খুলে গেল, আর বেরিয়ে এল একটি সূক্ষ্ম পার্চমেন্ট পেপার।

সেখানে লেখা—

“Where the goddess dances, silence dies.”

হোমস বললেন,
“That’s a clue. A poetic one. There must be a room or space here connected to dance—or a dancer. Perhaps ‘Anindita’ was one.”

এমন সময় আবার সেই ঘুঙুরের আওয়াজ!

সিঁড়ির ওপর থেকে ঝরে পড়ল রুপালি আলো। আর হ্যাঁ, এইবার আমরা দুজনেই স্পষ্ট শুনতে পেলাম একজন নারীর গলা—জানা নেই, গানের টান না কান্নার চিৎকার। মুহূর্তের মধ্যেই হোমস দৌড়ে গেলেন সেই তালাবদ্ধ ঘরের দিকে।

ঘরের নাম ছিল ‘ঠাকুরঝির ঘর’। প্রায় একশো বছর আগের এক মহিলার নামে নামকরণ, যিনি নাকি এই প্রাসাদের একমাত্র প্রগতিশীল নারী ছিলেন। শুনলাম, তিনি শিখতেন ভারতনাট্যম, রবীন্দ্রসঙ্গীত, এমনকি ফরাসি ভাষা।
নাম—অনিন্দিতা দেবী।

হোমস বললেন,
“She was ahead of her time. Which means she was dangerous.”

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, “Dangerous?”

“Of course,” হোমস ঠাণ্ডা গলায় বললেন। “In a household of old zamindars, a free-thinking woman is more frightening than a ghost.”

হঠাৎ মৃণালিনী এসে বললেন,
“আপনারা দয়া করে ঘরটার দরজা খুলবেন না। ঠাকুরঝি-র আত্মা এখনও থাকে ওখানে। আমরা ছুঁই না।”

হোমস বললেন, “আমরা আত্মায় বিশ্বাস করি না, মৃণালিনী। আমরা বিশ্বাস করি ছায়ায়, আর ছায়া মানেই আলো কোথাও আছে।”

রাত ১টা।
রাজবাড়ির বাতি নিভে গেছে। শুধু ঘন্টার শব্দ—টিক টিক টিক।

হোমস আমাকে নিয়ে ছাদে গেলেন। তিনি বললেন,
“Watson, we’re missing something. The layout of this palace. It hides things.”

তিনি ব্যাগ থেকে বের করলেন একটি ছোট চুম্বক, ধাতব ডিটেক্টর, আর একটি ছোট মানচিত্র।
“Mr. Campbell was kind enough to give me the original architectural drawing. And look—see here—there’s a corridor behind ‘Thakurjhi’s Room’. A blind alley.”

আমি অবাক, “গুপ্তপথ?”

হোমস হেসে বললেন, “Yes. And we’re going in.”

সেই মুহূর্তে ছাদের এক কোণে খুঁজে পাওয়া গেল একটি ছোট দরজা, প্রায় অদৃশ্য—পাথরের গায়ে ছোপ দেওয়া। দরজাটি খুলতেই ভেতর থেকে উঠে এলো ধুলোর গন্ধ, পুরোনো আতর, আর একটা কিছু পচা-কাঠের মত।

আমরা ঢুকলাম। ছোট একটি করিডোর। দেয়ালের গায়ে পুরোনো তৈলচিত্র, যার ওপর সময়ের ধুলো জমে গেছে। হোমস হঠাৎ থমকে গেলেন। একখানা ছবির নিচে লেখা:

“Anindita, 1863—1879”
মাত্র ১৬ বছর বয়সে মৃত্যু!

আমি বললাম, “She died at sixteen?”

হোমস কেবল বললেন, “Or was killed.”

করিডোরের শেষে ছিল একটা ঘর। আমরা ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখি—মেঝেতে বসে আছে এক নারী-ছায়া।
তার পিঠ আমাদের দিকে। সে গান গাইছে—একটি অসমাপ্ত ঠুমরি।
আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো।

হোমস সামনে এগিয়ে গেলেন। বললেন, “Who are you?”

কিন্তু নারী ঘুরে তাকাল না। শুধু গান চলল—

“নাহি মোরে ভালো লাগে…”

আমি তখন স্নায়ু ধরে বললাম, “H-H-Homes, is this real?”

হোমস বললেন, “Watson, look at her shadow. It’s not moving.”

আমরা এক পা করে এগিয়ে গেলাম। আর তখনই… সে ঘুরে তাকাল।

চোখ নেই, নাক নেই—একটি মোমের মুখ!

আমরা ততক্ষণে বুঝে গেছি—এটি আসল নয়, এটি একটি মোমের পুতুল। তার পায়ের কাছে রাখা ছিল একটি ছোট্ট ঘুঙুর, আর তার পায়ের কাছে লুকিয়ে রাখা ছিল—

একটা রক্তমাখা ছুরি।

আমি হাঁ করে চেয়ে ছিলাম। হোমস নীচু হয়ে ছুরিটা হাতে নিয়ে বললেন,
“Watson, we’ve just entered the past. And it’s bleeding.”

Part 3: পেছনের দরজা দিয়ে আগত শত্রু

মোমের পুতুলটা যেন অভিশপ্ত। তার সামনে পড়ে থাকা ছুরিটা রক্তমাখা হলেও তা নতুন রক্ত নয়—পুরনো, ঘন হয়ে জমে থাকা, কালচে লাল। হোমস চুপচাপ ছুরিটা পরীক্ষা করছিলেন। তিনি একটা ছোট ধাতব ক্যাপ খুলে ফেললেন ছুরির হাতল থেকে—ভেতরে সাদা কাগজ পেঁচানো, তাতে লেখা:

“যদি তুমি খুঁজতে চাও সত্য, তবে ফিরে যাও সেখানে, যেখানে আমি শেষ গানের রেওয়াজ করেছিলাম।”
— A.

আমি বললাম, “এ তো আবার কবিতার মতো!”

হোমস কেবল বললেন, “No, Watson. It’s a confession wrapped in poetry.”

আমরা বাইরে এলাম গোপন করিডোর পেরিয়ে। ভোরের আলো তখন ছড়িয়ে পড়ছে রাজবাড়ির ছাদে। গানের রেওয়াজ মানে কি মন্দির? না কি ওর ঘরেই কোনো কিছু আছে?

তখনই মিস্টার ক্যাম্পবেল এলেন। তিনি বললেন,
“Hope you gentlemen had a restful night?”

হোমস বললেন, “Restful is not the word I’d use, Mr. Campbell.”

ক্যাম্পবেল একটু হাসলেন। “Let me take you to the archives. There might be something useful.”

রাজবাড়ির আর্কাইভ ঘর ছিল প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত—তবু কিছু নথি, রেজিস্টার, ও পুরনো ছাপা ছবি সেখানে সংরক্ষিত। সেখানে আমরা পেলাম রাজবাড়ির আসল পরিবারের সদস্যদের তালিকা।

হোমস তালিকাটা দেখে বললেন,
“Look here—Raja Narendranath Roy, died 1877. His son Harinath Roy, died 1879. And his adopted daughter—Anindita Roy. No death record.”

আমি বললাম, “কিন্তু তোদের ফ্রেমে অনিন্দিতার মৃত্যু ১৮৭৯-এ লেখা!”

হোমস একবার চেয়ে বললেন,
“Exactly. Which means, someone fabricated it. She didn’t die naturally. She disappeared.”

হঠাৎ একটা পুরনো খাম পড়ল মেঝেতে—চিঠি, লিখেছেন “F”।

হাতে লেখা—

“অনিন্দিতা,
আমি ভুল করেছি তোমায় বিশ্বাস করে। তুমি রক্ত নিয়ে খেলছো। একদিন সেই রক্ত তোমার হাতেই লাগবে। আমি যাচ্ছি, ফিরে আর আসব না।”
— F

“F কে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

হোমস চোখ সরু করে বললেন,
“Not Ferdinand. Not Francis. No foreign name. Someone Bengali. Perhaps—Fakir?”

আমি হাসলাম, “ফকির? রাজবাড়িতে?”

“Or… perhaps a Flutist. Someone who was close to her in music.”
হঠাৎ তিনি থেমে গেলেন। “Wait. Did you hear what she sang?”

আমি বললাম, “ঠুমরি?”

“Not just that,” হোমস বললেন, “She sang ‘Nahi more bhalo lage…’. It’s from a composition that was banned by the family elders. Too romantic, too free.”

আমি ধীরে বললাম, “তবে কি অনিন্দিতা কাউকে ভালোবেসেছিলেন? যিনি এই ‘F’?”

হোমস কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “That would explain everything. A hidden lover. A betrayal. A false accusation. And then—disappearance.”

ঠিক সেই সময় ছুটে এল মৃণালিনী।

“সাহেব, আপনারা আসুন! ঝরনার পাশে আরেকটা বাক্স পাওয়া গেছে! আমাদের বাগানের ছেলে খুঁড়তে গিয়ে পেয়ে যায়!”

আমরা ছুটে গেলাম। মাটি খুঁড়ে উঠল ছোটো টিনের বাক্স। খুলতেই দেখি ভেতরে—

১) একটা সোনার ঘুঙুর
২) একটি আধপোড়া চিঠি
৩) এবং একটা ছোট আয়না, যার পেছনে খোদাই করা:

“He who stands behind you, walks faster than you.”

হোমস আয়নাটা হাতে নিয়ে বললেন,
“Watson, we are not alone in this investigation. Someone is watching us. And they’ve been doing it for quite a while.”

সেই রাতে রাজবাড়ির ছাদে বসে আমরা চুপচাপ ছিলাম। হাওয়ার মধ্যে ভেসে আসছিল শেয়ালের ডাক, দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল মন্দিরের ঘন্টা।

আমি হোমসকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি মনে করো কেউ চায় না আমরা সত্য জানি?”

হোমস বললেন, “Not just that. I believe we’ve stumbled upon something bigger than just Anindita’s death. This palace is a web of suppressed history.”

তিনি ব্যাগ থেকে বের করলেন একটা ছোট্ট তামার টোকেন।
“Campbell dropped this in the archive room. It bears a strange sigil—a crescent inside a sun.”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “এটা তো রাজবাড়ির চিহ্ন নয়!”

“Exactly,” হোমস বললেন, “It’s from the Freemasons.”

পরদিন সকালে ক্যাম্পবেল আবার দেখা করতে এলেন।

হোমস সরাসরি প্রশ্ন করলেন, “Mr. Campbell, do you belong to any secret society?”

ক্যাম্পবেল প্রথমে চমকে গেলেন। তারপর হাসলেন। “You’re clever, Mr. Holmes. Yes. I belonged to the Bengal Lodge—established 1821. But what’s that got to do with the murder of a girl a hundred years ago?”

হোমস বললেন,
“Everything. Because I believe the girl was silenced for knowing something she wasn’t supposed to.”

রাতে আমরা ঠাকুরঝির ঘরের তালা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে হোমস বললেন,

“Watson, if I’m correct, there is a journal hidden inside this room. One that Anindita kept.”

আমরা দরজা খুললাম। ভিতরে ধুলো, জাল, আর দেয়ালের গায়ে বড় পেইন্টিং—অনিন্দিতার ছবি।

বিছানার নিচে কাঠের তক্তার ফাঁক থেকে বের হল একটি পুরনো চামড়ার খাতা।

অনিন্দিতার ডায়েরি।

প্রথম পাতায় লেখা ছিল:

> “আজ আমি শেষ গানটা গাইলাম। কাল হয়তো আমি থাকব না। কেউ যদি এই ডায়েরি খোঁজে—জেনো, আমি সত্য বলেছিলাম। আমি কাউকে খুন করিনি।”
— অনিন্দিতা

 

আমি আর হোমস পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

হোমস বললেন, “She was framed.”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তবে কে করল এটা? কে চায় এত বছর পরে ঘটনাটা চাপা থাক?”

হোমস ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর কণ্ঠে ছিল জলের মতো ঠান্ডা শব্দ,
“Someone who still lives in this house, Watson. And I think… he just saw us take the diary.”

Part 4: রাজবাড়ির ছায়ায় লুকিয়ে থাকা মৃত্যু

ডায়েরিটা হাতে নিয়েই হোমস যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। ওর চোখে আমি প্রথমবার ভয় দেখেছিলাম—না, ভূতের জন্য নয়, মানুষের অপার অন্ধকারের জন্য। অনিন্দিতার সেই হস্তাক্ষরে লেখা ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা ছিল: “আমি কারো প্রেমে পড়েছিলাম, আর সেই অপরাধেই আমার মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়। আমার দাদারা কেউ কথা বলেনি। আমার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল রক্তমাখা এক গানের দোষ। আজ রাতে, আমি আমার শেষ গান গাইব। যদি কপাল ভালো হয়, হয়তো কারও কানে পৌঁছবে।” হোমস ডায়েরির পাতা উলটে যাচ্ছিল নিঃশব্দে। আমি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম, কিন্তু যেন কিছু বলার সাহস হারিয়ে ফেলেছি। অনিন্দিতার শেষ কিছু শব্দ ছিল একরাশ কান্না, যন্ত্রণা, আর অপমান—“ওরা বলেছিল আমি নাচগানে আসক্ত, আমি চরিত্রহীন। অথচ আমি শুধু গান গাইতাম আর ভালোবেসেছিলাম একজন বাঁশিওয়ালাকে। তার নাম আমি কখনও জানিনি, শুধু জানতাম ওর বাঁশিতে ছিল আমার মুক্তি।”

আমি বললাম, “ও তাহলে আত্মহত্যা করেনি।” হোমস বলল, “না। কেউ ওকে সরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু মৃত্যুর আগে সে জানত সত্য একদিন বেরিয়ে আসবেই।” তখনই পেছন থেকে শব্দ—কাঠের মচমচে আওয়াজ। আমরা তৎক্ষণাৎ ঘুরে তাকালাম। দরজার ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিল মৃণালিনী। তার চোখে ভয়, ঠোঁটে নীরব প্রার্থনা। সে বলল, “আপনারা বেরিয়ে আসুন, দয়া করে। কিছু মানুষ আপনাদের দেখেছে। এই রাজবাড়ি আপনাদের মেনে নেবে না।” হোমস বলল, “তুমি কি কিছু জানো, মৃণালিনী?” সে মাথা নাড়ল, “শুধু এটুকু জানি, অনিন্দিতার মৃত্যু ছিল একটা ষড়যন্ত্র। আমি তখন খুব ছোট। কিন্তু আমি শুনেছি রাতের বেলা কয়েকজন ভদ্রলোক তাকে নিয়ে গিয়েছিল পশ্চিমের ছোট মন্দিরের কাছে। তারপর সে আর ফেরেনি।”

আমরা তখনই ঠিক করলাম সেই মন্দিরটা খুঁজে দেখতে হবে। রাজবাড়ির পুরনো মানচিত্র অনুযায়ী, পশ্চিম প্রান্তে ছিল এক জরাজীর্ণ শিবমন্দির, যার পাশেই একটা পাথরের নর্তকী মূর্তি। আমরা সন্ধ্যা নামার আগে পৌঁছে গেলাম সেখানে। চারপাশে ঝোপ, গাছ, শ্যাওলা। মূর্তিটা দেখে আমার কেমন যেন শিহরণ হল—মূর্তির চোখ নেই, কিন্তু মনে হচ্ছিল সেগুলো যেন তাকিয়ে আছে আমার দিকেই। হোমস সেই মূর্তির পাদদেশ খুঁটিয়ে দেখছিল। হঠাৎ সে থমকে দাঁড়াল। পাথরের গায়ে একটা অদ্ভুত ছাপ—একটা সূক্ষ্ম বৃত্ত, যার ভেতরে ছিল একটি চাঁদ ও সূর্য—একই চিহ্ন যা আমরা ক্যাম্পবেলের টোকেনে দেখেছিলাম।

“এই চিহ্নটা কি একটা সাঙ্কেতিক ভাষা?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। হোমস বলল, “এটা সম্ভবত ফ্রিম্যাসনদের চিহ্ন। আর এই মন্দিরের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এমন কিছু যা কেউ চায় না আমরা খুঁজি।” সে তখন মূর্তির বাম পাশে থাকা একটি পাথরের টুকরো আলগা করে তুলল। নিচে একটা কাঠের সিঁড়ির মুখ খুলে গেল—কালো অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া এক গোপন সিঁড়ি। আমরা নামতে শুরু করলাম। বাতাসে একটা ভ্যাপসা গন্ধ, ঘামের সঙ্গে মিশে থাকা ধূপ ও কিছু পুরনো চামড়ার গন্ধ। সিঁড়ির নিচে গিয়ে পৌঁছালাম এক গুহার মতো জায়গায়। দেয়ালে টাঙানো মশাল, কিছু পুরনো দেউল, আর মাঝখানে কাঠের তৈরি একটা বেদি, যার ওপর রাখা একটি প্রাচীন বাঁশি।

হোমস সেই বাঁশিটার দিকে এগিয়ে গেল। বলল, “এটাই কি সেই বাঁশি যার কথা অনিন্দিতা বলত?” আমি বাঁশিটার নিচে দেখতে পেলাম—একটা ছোট কাপড়ের পুঁটুলি, যার মধ্যে ছিল রক্তরঞ্জিত এক চুড়ি আর একটি পৃষ্ঠা। কাগজে লেখা—

“তাকে নিয়ে আসার আগে ওকে গানে গাইতে বাধ্য করা হয়েছিল। তারপর ওর গলায় কাপড় বেঁধে ফেলে দেওয়া হয় রাজবাড়ির পেছনের কুয়োয়। কেউ কিছু জানে না, কারণ সবাই ভয় পেয়েছিল। আমি শুধু গোপনে এই স্মৃতিগুলো রেখে যাচ্ছি।” – F

আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে বললাম, “তবে তো কুয়োটা এখনই খুঁজতে হবে!” ঠিক তখনই গুহার ওপরে ধ্বংসস্তুপ থেকে শব্দ এল—কেউ আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েছে! হোমস বলল, “Run, Watson!” কিন্তু বেরোতেই দেখি এক ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির মুখে। হাতে বন্দুক। সেই মানুষটি ধীরে ধীরে সামনে এল—সে ছিল মিস্টার ক্যাম্পবেল। তবে তার চোখে সেই অফিসিয়াল সৌজন্যের ছিটেফোঁটাও নেই—বরং ছিল তীব্র বিদ্বেষ। সে বলল, “তোমরা অনেক বেশি জেনে গেছো।” হোমস বলল, “তুমি-ই তাহলে এই ইতিহাস চাপা রাখতে চাইছো?” ক্যাম্পবেল বলল, “আমি শুধু নিজের দায়িত্ব পালন করছি। এই রাজবাড়ি একটা প্রতিষ্ঠান, একটা নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র। যদি অনিন্দিতার সত্যি প্রকাশ পায়, তাহলে অনেক সম্মান ভেঙে পড়বে।”

আমি বললাম, “তুমি-ই তাহলে ওকে খুন করেছো?” ক্যাম্পবেল মুচকি হাসল, “আমি করিনি, আমার পূর্বপুরুষরা করেছিল। আমি শুধু উত্তরাধিকার রক্ষা করছি।” হঠাৎ হোমস কিছু একটা ছুঁড়ে মারল তার দিকে—একটা পুরনো ঘন্টার পাটাতন। ক্যাম্পবেল চমকে গিয়ে পড়ে গেল, আর বন্দুক ছিটকে পড়ল দূরে। আমরা সেই সুযোগে দৌড়ে বেরিয়ে এলাম মন্দির থেকে।

হোমস বলল, “ও এখন জানে আমরা সত্যি কাছে পৌঁছে গেছি। আমাদের এখন পুলিশ বা প্রশাসনের ওপর ভরসা করলে চলবে না। আমাদের লাগবে প্রমাণ—তথ্য, যা এই হত্যাকাণ্ডকে প্রমাণ করবে।” আমি বললাম, “তবে আমরা কোথায় খুঁজব সেই কুয়ো?” হোমস বলল, “ডায়েরিতে লেখা ছিল—‘প্রাসাদের পিছনের কুয়ো, যা আলো পায় না।’ মানে পশ্চিমে ঝোপের আড়ালে।”

আমরা রাতেই চললাম সেই দিক। এক পুরনো গোলাকার পাথরের কুয়ো। জং ধরা দড়ি, ভাঙা চাকা। হোমস বলল, “আমাকে নিচে নামিয়ে দাও, ওয়াটসন।” আমি বললাম, “তুমি পাগল?” হোমস বলল, “এই কেস আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক সত্য। আমি চাই না এই মেয়েটির মৃত্যু আর অজানায় ঢাকা থাক।” আমি দড়ি জড়ালাম হোমসের গায়ে, আর সে ধীরে নামতে লাগল। নিচে গিয়ে সে চেঁচিয়ে বলল, “এখানে কিছু আছে!” আমি উত্তেজনায় কাঁপছিলাম।

আর ঠিক তখনই, পেছন থেকে কেউ আমার ঘাড়ে কিছু একটা বসিয়ে দিল—একটা ভারী ধাতব কিছু। আমি পড়ে যাচ্ছিলাম… আর দেখতে পাচ্ছিলাম না কিছু… শুধু দূরে হোমসের গলা—“Watson! Watson!”

Part 5: কুয়োর অতলে লুকনো সত্য

আমার ঘাড়ে যেই আঘাতটা পড়েছিল, তাতে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই ঠিক, কিন্তু সম্পূর্ণ স্মৃতি হারাইনি। যেন ঘন এক কুয়াশায় ঢেকে ছিল সব—হলুদ আলো, পায়ের নিচে মাটি নরম হয়ে যাওয়া, দূর থেকে শোনা হোমসের ব্যাকুল গলা। ঠিক যেমন কেউ স্বপ্নের মধ্যে পড়লেও চেনা কণ্ঠ চিনে নেয়, তেমনি আমি বুঝে গিয়েছিলাম—সে হোমস। যখন জ্ঞান ফিরে আসে, তখন আমি আবিষ্কার করি, আমি শুয়ে আছি রাজবাড়ির পুরনো হাসপাতাল ঘরে। আমার কপালে ঠান্ডা জল চেপে ধরে আছে মৃণালিনী। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “হোমস কোথায়?” মৃণালিনী বলল, “তিনি কুয়োর নিচে গিয়েছিলেন, কিন্তু এখনও ফেরেননি। আপনারা যা খুঁজছেন তা খুব গভীরে, সাহেব।” আমি উঠে বসার চেষ্টা করলাম। মাথা ঘুরছিল, কিন্তু ভয় তার থেকেও বেশি। একটা অজানা আশঙ্কা যেন বুকের মাঝখানটায় জমে বসেছিল—এই প্রথম আমি হোমসকে একা রেখে এসেছি।

আমি দৌড়ে গেলাম কুয়োর দিকে। রাত তখন আরও ঘনীভূত, আর আকাশে মেঘ জমেছে। কুয়োর মুখে কেউ নেই, শুধু ছেঁড়া দড়িটার অর্ধেক অংশ ঝুলছে। আমি চিৎকার করলাম, “Holmes! তুমি কি নিচে আছো?” কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। তারপর খুব নিচ থেকে এল এক উত্তর—“I’m alive, but I’ve found something, Watson. Something unbelievable.” আমার হৃদস্পন্দন দ্বিগুণ হয়ে গেল। আমি দড়ি গাঁথতে শুরু করলাম, আরেকটা কাঠের রোলারে বেঁধে ধীরে ধীরে নামতে লাগলাম।

কুয়োর দেয়াল ছিল স্যাঁতসেঁতে, কিছু জায়গায় শ্যাওলা জমে আছে, কিছু জায়গায় পুরনো ইট বেরিয়ে গেছে। নিচে পৌঁছে দেখি—হোমস এক কোণায় দাঁড়িয়ে, মশালের আলোয় এক মৃতদেহের কঙ্কাল পরীক্ষা করছে। তার পাশে একটা কাঠের বাক্স। আমি অবাক হয়ে বললাম, “তুমি এটা কোথা থেকে পেয়েছো?” হোমস বলল, “এই কুয়োর ভেতরে একটা গোপন কুঠুরি আছে। মাটির নিচের গায়ে হাত রাখতেই খুলে যায়। এবং ভিতরে আছে ইতিহাস, মৃত্যু, এবং একটি অসমাপ্ত গান।”

কঙ্কালটি নারীর, তাতে এখনও রয়েছে ছেঁড়া রেশমের শাড়ির অংশ, আর পায়ের হাড়ে আটকে আছে একটি ছোট সোনার ঘুঙুর—যেটা অনিন্দিতার ঘুঙুরের সাথে মিলে যায়। হোমস বলল, “She was never buried. She was never given peace.” পাশে বাক্স খুলে আমরা দেখতে পেলাম একটি ছেঁড়া গানের খাতা, একটি কলম, এবং একটি সাদা চিঠি—যা কালো কালিতে লেখা, এবং চমকে দেওয়ার মতো কথা লেখা তাতে—

“আমি অনিন্দিতা। আমি কাউকে হত্যা করিনি। আমি শুধু ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু আমার পরিবারের পুরুষেরা আমাকে অন্য কারও সঙ্গে গাইতে ও বাজাতে দেখেই রেগে গিয়েছিল। সেই রাতেই আমাকে ধরে নিয়ে কুয়োয় ফেলে দেয়। আমাকে শেষবার গান গাইতে বলে। আমি গাই, আর আমার গলায় কাপড় বেঁধে ফেলে দেয়… যেন গানটাই আমার শাস্তি হয়ে দাঁড়ায়।”

আমি স্তব্ধ হয়ে ছিলাম। হোমস ধীরে চিঠিটা রেখে বলল, “Watson, it’s not just a murder. It’s a silencing of a woman’s voice. Her music. Her right to love.”

কুয়োর দেয়ালে তখন আমরা আরও কিছু খোদাই খুঁজে পেলাম—একটা রাগের নাম, “রাগ দেশ”। হয়তো অনিন্দিতা এই রাগটাই গাইছিলেন শেষবার, অথবা এটি ছিল সেই বাঁশিওয়ালার প্রিয় রাগ। হোমস বলল, “We have the diary, we have the bones, we have her song. Now all we need is the final piece—who gave the order?”

আমরা কুয়োর ওপরে উঠে এলাম। আকাশে তখন ঝড়ের পূর্বাভাস। সেই সময়ই মৃণালিনী বলল, “আমার কিছু বলার আছে।” সে আমাদের রাজবাড়ির এক পুরনো দালানের দিকে নিয়ে গেল। সেখানে সিমেন্টের দেয়ালে একটা গোপন দরজা ছিল—ভিতরে গিয়েই আমরা দেখতে পেলাম পুরনো সব ফাইল, রেকর্ড, এবং একটি সিল করা নথি—লাল রঙের মোমে আটকানো। হোমস বলল, “Let’s break it.”

মোম গলে খোলা নথিতে লেখা ছিল—

“To be kept sealed. Case of Anindita Roy. Confession of Harinath Roy, recorded 1880.”

চোখ কপালে উঠে গেল। সেই নথিতে লেখা ছিল—“আমার দিদি অনিন্দিতা ভালোবেসেছিলেন একজন দরিদ্র লোককে। আমরা তা মানতে পারিনি। আমরা তার ঘর খুঁজে দেখি সে লোকটিকে নিয়ে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই রাতে বাবা ঠিক করেন, মেয়েটিকে শেষবার গান গাইতে বলা হবে, তারপর শাস্তি দেওয়া হবে। আমার ভেতর অনুতাপ ছিল, কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। আমি তখনও ছোট। আমি এই কথা শুধু লিখে রাখছি, যদি কোনওদিন কেউ জানতে চায়।”

আমি বললাম, “মানে হ্যারিনাথ নিজেই স্বীকার করেছে?” হোমস বলল, “Yes. But the document was sealed, hidden, and the world kept blaming a ghost.”

সেই মুহূর্তেই রাজবাড়ির বাইরে গুলির শব্দ! আমরা ছুটে গেলাম। ক্যাম্পবেল, পুলিশের পোশাকে একজনকে ধরে রেখেছে। সে চিৎকার করে বলছিল, “ওরা কুয়োর ভেতর কিছু পেয়েছে! সব মিথ্যে!”

হোমস এগিয়ে গিয়ে বলল, “Mr. Campbell, I think it’s time we unseal not just documents, but your family name too.”

পরে জানা গেল, ক্যাম্পবেল এই রাজবাড়ির পূর্বপুরুষের দিক থেকে উত্তরাধিকারী, এবং সে ছিল সেই প্রাচীন হত্যার রক্ষক, না হোক অংশীদার। সে চেয়েছিল এই ইতিহাস চাপা থাক, কারণ এই মৃত্যু তার বংশের লজ্জা বহন করে।

রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় সেই কঙ্কাল উদ্ধার করে সংরক্ষিত হয়। হোমস নিজ হাতে অনিন্দিতার গান খাতাটি এক সংগীতাগারে হস্তান্তর করেন। কলকাতা শহরের এক সন্ধ্যায় তার গান প্রথমবার রেকর্ড হয়—তার অসমাপ্ত ঠুমরি “নাহি মোরে ভালো লাগে”।

আমি সেই রাতে ডায়েরিতে লিখেছিলাম—

“এই প্রথম আমি হোমসকে অশ্রুসিক্ত দেখেছি। সে বলল, আমরা একটা খুনের বিচার করতে পারিনি, কিন্তু আমরা একটা আত্মার গান ফেরত দিতে পেরেছি। সেটাই অনেক।”

Part 6: বিদায়ের আগে এক অসমাপ্ত কণ্ঠ

কলকাতার ভোর তখন হালকা সোনালি, আর আমাদের রাজবাড়ির সাথে শেষ দেখা। গেটে দাঁড়িয়ে আমি একবার ফিরে তাকালাম সেই লাল ইটের রাজকীয় কাঠামোটার দিকে। যেন একটা সময় বেঁচে আছে ওর গায়ে—ঘুঙুরের ছন্দে বাঁধা, গোপন দরজায় আটকে রাখা এক সুরেলা মেয়ে, যার জীবনের গান থেমে গিয়েছিল অন্যের ভয় আর লজ্জায়। হোমস পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর চোখে ক্লান্তি, তবু একধরনের তৃপ্তি। ক্যাম্পবেলকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে পুলিশ, যদিও সে সরাসরি হত্যাকাণ্ডে যুক্ত নয়। তবে তার পরিবার ছিল। সে ছিল তার উত্তরাধিকারী, এবং সে-ই চেষ্টা করেছিল সব ইতিহাস মুছে ফেলতে। আমরা অনিন্দিতার ডায়েরি, কঙ্কাল, রক্তমাখা ঘুঙুর, ও হারানো সংগীত রচনাগুলি কলকাতা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি। পুরাতত্ত্ব বিভাগ ও ইতিহাসবিদেরা এগুলোর সংরক্ষণে আগ্রহ দেখিয়েছেন। এবং সেই অনন্য গান—“নাহি মোরে ভালো লাগে”—প্রথমবার রেকর্ড হয় অল ইন্ডিয়া রেডিও-র স্টুডিওতে। হোমস নিজে চেয়েছিলেন যেন এটি একজন তরুণা ভারতীয় শিল্পীর কণ্ঠে উঠে আসে—তেমনই হয়। আমি তখন নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। গানের প্রতিটি লাইনে, যেন অনিন্দিতার কান্না, বিদ্রোহ, আর প্রেমের নির্ঘণ্ট লেখা।

স্টেশন যাওয়ার পথে হোমস হঠাৎ বললেন, “Watson, I have rarely seen such elegance in pain. This case has nothing to do with politics or science—it is a story of silence. Of how people silence what they cannot control.” আমি বললাম, “আমরা কি দেরি করে ফেলিনি?” হোমস তাকিয়ে রইলেন সামনের দিকে। “Perhaps. But sometimes, justice doesn’t come to save the dead. It arrives to heal the living.” আমি চুপ করে গেলাম। কলকাতার রাস্তা তখনো সেই পুরোনো ঘোড়ার গাড়িতে ঠকঠক করছে, কিন্তু আমার চোখের সামনে তখন ভেসে উঠছিল সেই কুয়োর মুখ, সেই গানের খাতা, আর সেই চোখ না-থাকা মোমের মুখ যা সত্যের চেয়ে বেশি জীবন্ত ছিল।

হাওড়া স্টেশন তখনো ব্যস্ত। বাঙালি কুলি, সাহেব জুট কোম্পানির কর্মচারীরা, থরে থরে রাখা মালপত্র। আমরা ট্রেন ধরার আগে চুপচাপ দাঁড়ালাম প্ল্যাটফর্মে। সেই সময়ই আমাদের কাছে এল মৃণালিনী। তার চোখে জল, হাতে একটা ছোট বাক্স। সে বলল, “ঠাকুরঝির শেষ গান আমি আপনাদের দিলাম, সাহেব। এটা উনি আমায় দিয়েছিলেন—বাজাতে বলেছিলেন কেবল তখন, যখন কেউ ওনার কথা জানবে।” হোমস বাক্সটা নিলেন। ভেতরে ছিল একটি ছোট্ট বাঁশি, আর তাতে খোদাই করা — “জীবনের বাইরে সুর একটাই — মুক্তি।” হোমস বাঁশিটা হাতে নিয়ে বললেন, “এই সুর হয়তো বাজাতে পারব না আমি, কিন্তু জানি এটার শব্দ অনন্ত কালের জন্য বাজবে। এমনভাবে, যেভাবে গানেরা ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখে।” ট্রেন আসছে। আমরা উঠছি। মৃণালিনী কেবল দাঁড়িয়ে বললেন, “ঠাকুরঝি আজ হেসে উঠবেন।” হোমস তাকে একবার দেখলেন, আর বললেন, “She already did, Miss Mrinalini. When her silence broke.”

আমরা ট্রেনে চড়লাম। কলকাতা পেছনে চলে গেল। আমি জানলার পাশে বসে, রাজবাড়ির দিকে মুখ করে মনে মনে অনিন্দিতাকে বললাম, “তুমি কথা রেখেছো। আমরা শুনেছি তোমার গান।” হোমস তার খাতায় কিছু লিখছিলেন। আমি তাকিয়ে দেখলাম—সে টুকে রাখছে তার অনুমান, সময়, সূত্র। কিন্তু এই প্রথমবার, তার পৃষ্ঠার এক কোণে আমি দেখলাম একটা নাম—“Anindita”—লাল কালিতে লেখা। খুব ছোট করে, তবু যত্নে। আমি হেসে বললাম, “You’re becoming sentimental, Holmes.” সে বলল, “Perhaps. Or perhaps I’m learning there are cases even logic cannot close. Only memory can.” ট্রেন এগিয়ে যাচ্ছে। সময়ের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে সেই কুয়ো, সেই প্রাসাদ, সেই সংগীত যার একটা কলি আজও বাজে এই পৃথিবীর কোথাও—কোনও মঞ্চে, কোনও গলার মাঝে, কোনও কল্পনার কুয়োর নিচে। আমি ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় লিখে ফেললাম—

“অনিন্দিতা ছিল না কোনও ভৌতিক মূর্তি, বরং ছিল মানুষের ভয়ে নিঃশব্দ হয়ে যাওয়া এক কণ্ঠ। আমরা সেই কণ্ঠকে খুঁজে পেলাম, মুক্ত করলাম। এতেই শার্লক হোমসের সবচেয়ে গভীর কেস শেষ হয়, কিন্তু আমার কাছে শুরু হয় এক অনন্ত অনুরণন।”

হোমস চোখ বন্ধ করলেন। আমি জানলার ধারে বসে দেখলাম সূর্য উঠছে—অত্যন্ত ধীরে, অনিন্দিতার সুরে।

Part 7: একটি চিঠি, তিরিশ বছরের পুরনো
(টানা ১০০০ শব্দে, নিরবিচ্ছিন্নভাবে)

লন্ডনের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালের মধ্যে আমি বসেছিলাম বেকার স্ট্রিটের ২২১বি-তে, জানালার ধারে। হোমস চুপচাপ বসে ছিলেন তাঁর প্রিয় আর্মচেয়ারে, এক কাপ কড়া চায়ের পাশে রেখে ধোঁয়া ছেড়ে দেওয়া হুকা হাতে। কলকাতা থেকে ফিরে এসেছি কেবল তিনদিন, কিন্তু আমাদের দুজনের মন যেন এখনো আটকে আছে সেই রাজবাড়ির স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে, ঘুঙুরের ঘ্রাণে, আর সেই ভয়াল কুয়োর অন্ধকারে। আমি আমার ডায়েরির শেষ পাতাগুলো গোছাচ্ছিলাম, যখন সেক্রেটারি হাডসন ঘরে ঢুকল একটা খাম হাতে নিয়ে। বলল, “This arrived by special courier, sir. It says ‘Private: To be opened only by Mr. Sherlock Holmes.’” হোমস দৃষ্টি সরালেন না, কিন্তু হাত বাড়িয়ে খামটি নিলেন। তার উপর ইংরেজি কুর্সিভে লেখা: “To Sherlock Holmes, From F.”

আমার হাত হঠাৎই স্থির হয়ে গেল। আমি ফিসফিসিয়ে বললাম, “F? আবার?” হোমস ধীরে ধীরে খামটা খুললেন। ভেতরে পুরোনো প্যাঁচানো পার্চমেন্ট কাগজ, তার রং হালকা বাদামি হয়ে এসেছে, যেন বয়সের ভারে ক্লান্ত। তিনি পড়তে শুরু করলেন—

“১৮৯০, কলকাতা।
যদি কখনো কেউ এই চিঠি খুঁজে পায়, জানবেন, আমি ছিলাম সেই বাঁশিওয়ালা। আমি জানতাম অনিন্দিতাকে খুন করা হবে, আমি চেয়েছিলাম ওকে নিয়ে পালাতে। কিন্তু পারেনি। আমি ছিলাম গরিব, অক্ষম, আর পরাজিত। ওর গান আমার বাঁশির মধ্যে বাঁচিয়ে রাখি। তারপর আমি চলে যাই, কিন্তু আমার প্রতিজ্ঞা ছিল—যদি কোনওদিন কোনও সত্য-সন্ধানী আসে, তাকে এই ইতিহাসের চাবিকাঠি তুলে দেব।
— F.”

হোমস পত্রখানি আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি স্তব্ধ হয়ে পড়ছিলাম। “তবে এটা কীভাবে এল?” আমি প্রশ্ন করলাম। হোমস চোখ সরিয়ে বললেন, “কেউ সংরক্ষণ করে রেখেছিল এটা। কেউ বুঝতে পেরেছিল, সত্য একদিন ফিরে আসবেই। চিঠিটার তারিখ ১৮৯০—মানে অনিন্দিতার মৃত্যুর ঠিক আগে লেখা। তবু কেউ কৌশলে এটা বিলম্বিত করে রেখেছিল।” আমি বললাম, “কিন্তু কে পাঠাল?” ঠিক তখনই হাডসন আবার ফিরে এল। “There’s more, sir,” সে বলল। “Another envelope arrived for Dr. Watson.”

আমি অবাক হয়ে খামটা খুলে দেখলাম—ভেতরে একটা ছোট কাগজ, আর তার সঙ্গে একটা বাঁশির টুকরো। কাগজে লেখা—

“Watson সাহেব,
আপনার লেখার মধ্যে আমি আমার আপার কণ্ঠ খুঁজে পেয়েছি। আপনি ওঁর কাহিনি জাগিয়ে তুলেছেন। তাই আপনার জন্য ওঁর বাঁশির এক টুকরো রেখে দিলাম।
— মৃণাল”

আমি হোমসের দিকে চেয়ে থাকলাম। তার চোখে ছিল একদম নিঃশব্দ প্রশান্তি। সে বলল, “Watson, do you realise what just happened? History responded. When we recorded her voice, the world listened.” আমি বললাম, “We couldn’t save her, Holmes. But we saved her song.” হোমস মাথা নাড়লেন, “No, my friend. We saved her from being forgotten. That is the real salvation.”

দিন কয়েক পরে, আমরা রিগেন্ট পার্কে হাঁটছিলাম। শরতের আলো পাতার ফাঁক গলে পড়ছে। হোমস একসময় থেমে গেলেন। বললেন, “I’ve been thinking, Watson. Anindita didn’t just die. She became a symbol. Of how truth can be drowned, and yet, float back up.” আমি বললাম, “তবে কি তুমি এই কেস বন্ধ করবে না?” হোমস একটা কাগজ বের করলেন। তাতে লেখা ছিল, “Royal Society of Music, London – Request for historical investigation into Colonial-Era Musical Disappearances.” হোমস বলল, “They want me to lead it. Apparently, our Anindita case has sparked interest.” আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। “তুমি তাহলে সঙ্গীত বিষয়ক তদন্ত করবে?” সে মৃদু হাসল, “Let’s say I’m just following the melody.”

তবে এই গল্প এখানেই থেমে থাকেনি। প্রায় মাসখানেক পর একদিন সকালে আমরা পেলাম এক তৃতীয় চিঠি। এইবার সেটি এসেছিল কলকাতা থেকে নয়, বরং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। খামের ভিতরে ছিল মাত্র দুটি জিনিস—একটি ছবি, আর একটি ছোট্ট পুঁটুলি। ছবিতে দেখা যাচ্ছিল এক বৃদ্ধ—সে বাঁশি বাজাচ্ছে, আর তার পেছনে আঁকা একটি চিত্রকর্ম—অনিন্দিতার মুখ। পুঁটুলির ভিতরে ছিল একটি একতারা-আকৃতির পেনডেন্ট। আর তার গায়ে লেখা—

“I met her again. In song.”

আমি হোমসের দিকে তাকালাম। সে বলল, “Some stories… never die. They just change their rhythm.”

আমি সেই রাতে ডায়েরির শেষ পাতাটি লিখলাম—

“যদি কেউ বলে, ভূতের গল্প কেবল ভয় পাওয়ার জন্য, বলব—না। কিছু আত্মা কথা বলতে চায়, গান গাইতে চায়, সত্যি প্রকাশ করতে চায়। আর কেউ কেউ থাকে সেই আত্মার গল্প শোনার জন্য। আমি জন ওয়াটসন, শুধু চিকিৎসক বা লেখক নই। আমি এক আত্মার শ্রোতা।”

আমার লেখার কালি শেষ হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু শব্দ ছিল অফুরন্ত। বাইরের জানালা দিয়ে শীতের বাতাসে ভেসে আসছিল লন্ডনের টাওয়ার ক্লকের টিক টিক শব্দ। আর আমার কানে বাজছিল সেই ঠুমরির সুর—
“নাহি মোরে ভালো লাগে…”

Part 8: এক মৃত নারীর জয়
(টানা ধারাবাহিকভাবে, ১০০০ শব্দ, কোনও বিভাজন ছাড়াই)

একটা গল্প শেষ হয় যখন সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়—তবে কিছু গল্প থাকে, যেগুলো শেষ হয় না, কারণ তাদের গর্ভে জন্ম নেয় অন্য গল্প। অনিন্দিতার গল্প ছিল ঠিক তেমন। কলকাতার সেই নিঃসঙ্গ রাজবাড়ি থেকে লন্ডনের অভিজাত সংগীত সমাজ পর্যন্ত, ওর গান যেন নিজেই তার পথ খুঁজে নিয়েছিল। সেই সংগীত, যা একসময় রাজবাড়ির পুরুষরা চাপা দিতে চেয়েছিল, আজ লন্ডনের এক শীতের সন্ধ্যায় বাজছিল — রয়্যাল অপেরার আসরে, সিলভার হর্মোনিয়ামের তলে, এক ভারতীয় তরুণীর কণ্ঠে। আমি, জন এইচ. ওয়াটসন, সামনের সারিতে বসে ছিলাম। পাশে শার্লক হোমস। তার চোখ বন্ধ, ঠোঁটের কোণে নরম একটা রেখা। আমি জানতাম, তার ভেতরে এই মুহূর্তে চলছে হিসাব—সুর আর ইতিহাসের। গানটি শুরু হল — “নাহি মোরে ভালো লাগে…”— সেই একই ঠুমরি, যেটা অনিন্দিতা লিখে রেখে গিয়েছিল কুয়োর তলদেশে, একরাশ অভিমানে। আমি চোখ বন্ধ করলাম। গানের প্রতিটি তানে ভেসে উঠল সেই রাজবাড়ির অলিন্দ, সেই মোমের মুখ, সেই স্যাঁতসেঁতে গোপন সিঁড়ি আর সেই ডায়েরির লাল কালির অক্ষর। আমি অনুভব করছিলাম — অনিন্দিতা ফিরে এসেছে।

শোয়ের শেষে মানুষ উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিল, কিন্তু হোমস তখনও বসে। আমি বললাম, “It moved you, didn’t it?” সে বলল না কিছু। ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে শুধু বলল, “It wasn’t just music. It was resurrection.” আমরা বাইরে এলাম। লন্ডনের রাস্তায় কুয়াশা, কিন্তু বাতাস ছিল আলোর মতো পরিষ্কার। হঠাৎ হোমস পকেট থেকে এক চিঠি বের করল। আমি অবাক, “আরও কিছু এসেছে?” সে মাথা নাড়িয়ে বলল, “No. This time, it’s from me.” আমি অবাক হয়ে তাকালাম। হোমস সাধারণত কাউকে চিঠি লেখে না। “To whom?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল, “To the girl I never met, but who gave me the most human case of my career.”

আমি হাঁ করে থাকলাম। সে কি সত্যিই চিঠি লিখেছে অনিন্দিতাকে?

চিঠিটা ছোট, কিন্তু তাতে ছিল সেই কঠিন হৃদয়ের ভাঙন—

“Dear Miss Roy,
You were silenced, but not defeated. Your voice, buried under bricks, dust, and fear, found its way to the world. I couldn’t save your life, but perhaps I helped your melody live.
Yours in truth,
S.H.”

আমি কিছু বললাম না। শুধু চেয়ে রইলাম হোমসের দিকে। এত বছর ধরে আমি তাকে জানি—যে মানুষ যুক্তিকে ভালোবাসে, আবেগকে ভয় পায়, সুরকে সন্দেহ করে—সে আজ একজন মৃত মেয়েকে চিঠি লিখছে। এটাই হোমসের বিজয়। আমারও। আর অনিন্দিতার তো বটেই।

তারপরের সপ্তাহগুলোতে আমরা একসাথে কাজ করলাম এক বিশেষ প্রকল্পে—“The Anindita Archives”—এক সংগীত-নথিভুক্তি ও সত্য উদঘাটন প্রকল্প, যেখানে অনিন্দিতার লেখা গান, ছেঁড়া ডায়েরি, রেকর্ড করা কণ্ঠ আর ঐতিহাসিক প্রমাণগুলি একত্র করে রাখা হল ভবিষ্যতের গবেষণা ও শিল্পীদের জন্য। ব্রিটিশ রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রণালয় পর্যন্ত তাতে স্বীকৃতি দিল। হোমস বলল, “This may not be justice in the traditional sense. But it’s the beginning of something greater—memory.” আমি তার কথায় মাথা নাড়লাম।

একদিন সন্ধ্যাবেলা হোমস আমার ঘরে এল। হাতে একটা ছোট প্যাকেট। সে বলল, “For you, Watson. You’ve earned this.” আমি খুলে দেখি, একটা ঘুঙুর—সেই ঘুঙুর যেটা আমরা কুয়োর তলায় পেয়েছিলাম, রক্তের দাগ ধুয়ে গিয়েছে, তবু এখনো ঝিকিমিকি করছে। আমি স্তব্ধ হয়ে রইলাম। সে বলল, “I kept it not as a clue, but as a keepsake. And I think it belongs more to you.” আমি সেই ঘুঙুরটি তুলে নিলাম। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, আমি কিছু একটা ধরে রাখছি—একটা নারীস্বর, যা যুগের পর যুগ ধরে বন্দী ছিল।

কিছু সপ্তাহ পর, আমি শুনলাম একটা গল্প ছড়িয়ে পড়ছে কলকাতার অলিগলিতে। মানুষ বলছে—ভবানীপুরের পুরনো রাজবাড়ির ঘরে রাতে আর ঘুঙুরের আওয়াজ পাওয়া যায় না। নাকি কারও কান্নাও না। অনেকে বলে, “ঠাকুরঝি এখন শান্তিতে আছেন।” আরেকটি কথা বলা হচ্ছে — এক বিদেশি সাহেব ও তার সঙ্গী একবার এসেছিলেন, অনেক খোঁজ করতেন, পুরনো কাগজ ঘাঁটতেন, আর মাটির নিচে যেতেন। তারা চলে যাওয়ার পর রাজবাড়িতে গান ফিরে এসেছে। কেউ কেউ বলে, রাজবাড়ির পুরনো রেওয়াজ ঘরে এখনো বাজে সেই ঠুমরি—তবে এবার আর অভিশাপের মতো নয়, মুক্তির মতো।

এই গল্পের চিঠিপত্র, প্রমাণাদি, আর আমার ডায়েরি আজ সংগৃহীত হয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের বিশেষ বিভাগে—”Echoes of the Empire”। সেখানে অন্য কেসের ফাইলের পাশে রাখা রয়েছে একটা খাঁটি ভারতীয় কাগজের ডায়েরি—সাদা পাতায় লাল কালির অক্ষরে লেখা একটা নাম: “অনিন্দিতা রায়”।

আমি সেই জায়গায় গিয়ে বসেছিলাম একদিন, একদম নির্জনে। শুধু সেই গানটা বাজছিল টেপে—“নাহি মোরে ভালো লাগে…” আর আমার ডায়েরির শেষ লাইন তখন নিজেই লিখে ফেলেছিল নিজেকে—

“এই গল্প কোনোদিন শেষ হবে না। কারণ যেখানে সুর থাকে, সেখানে চিরকাল বেঁচে থাকে সেই, যাকে মেরে ফেলা যায় না—ভালোবাসা।”

শেষ 

1000025204.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *