অর্ণব দত্ত পর্ব ১ — রাতের সেতু হাওয়ায় গন্ধ ছিলো গরম লোহা আর নদীর শ্যাওলার। কলকাতার শহরতলির পুরনো লোহার সেতুটি রাত নামার পর যেন অন্য রকম হয়ে যায়—দিনে সে কত ব্যস্ত, ট্রাক, বাস, ভ্যানগাড়ি সব মিলিয়ে এক বিশৃঙ্খলা। অথচ গভীর রাতে, হঠাৎ করেই যেন সেতুর গায়ে সময় থেমে যায়। বাতাসে ভিজে ধাতব শব্দ বাজতে থাকে, দূরে নদীর স্রোত কালো তেলের মতো ঘন হয়ে বইতে থাকে, আর হাওয়ার ফাঁক দিয়ে মনে হয়, কারা যেন অদৃশ্য পায়ে সেতুর গায়ে হাঁটছে। অনিকেত দাঁড়িয়ে ছিলো সেতুর মাঝখানে। হাতে সিগারেট, চোখ নদীর দিকে। সে একজন সাংবাদিক, তিরিশ পেরিয়েছে, জীবন তাকে খুব একটা সহজ কিছু দেয়নি।…
-
-
পর্ব ১: সেই খামখানা চিঠি বৃষ্টিভেজা কলকাতার সন্ধ্যায়, ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের লাইব্রেরির নরম আলোয় বসে ছিল অনির্বাণ। ইতিহাসের ছাত্র, বইপাগল, এবং ভীষণরকম নিঃসঙ্গ। লাইব্রেরির শেষ তাক থেকে পুরোনো ধুলোবালিতে মোড়া একটা খাম পেয়েছিল সে। উপরে কোনো প্রেরকের নাম নেই, শুধু একটা লাল মোমের সীল—তার ওপর আঁকা ছিল একটা গোলচিহ্ন, তার ভেতরে চোখের মতো কিছু একটা, যেন কোনো গুপ্ত প্রতীক। খুলতেই ভিতরে পাওয়া গেল হাতের লেখায় লেখা চার লাইনের একটা ছড়া— “যেখানে সময় থেমে থাকে, আর ছায়া গিলতে চায় আলো, তুমি যদি চাও জানতে সত্য, এসো শূন্যচক্রে, নিঃশব্দ চলো।” অনির্বাণের বুকের ভিতর কেমন যেন কাঁপুনি ধরল। এতদিনের নিঃসার জীবনটা আচমকা যেন কোনো…
-
দীপান্বিতা রায়চৌধুরী ১ ঘূর্ণি গ্রামটা যেন সত্যিই সময়ের বাইরে পড়ে আছে—পথের ধারে টালির ছাউনির বাড়িগুলো, পুকুরঘাটে সাদা শাড়ি পরা বধূর মুখে মেঘ জমা চোখ, আর সেই নদী, যাকে ঘূর্ণি বলে, সে যেন জলের বদলে গোপন ইতিহাস বইয়ে চলে যায়। ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাস, দেশভাগের আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, তবু এই গ্রামটায় একটা ভিন্ন নৈঃশব্দ্য। পাখির ডাক, নদীর ছলাৎছল, আর দুপুরের নিস্তব্ধতা—সব মিলিয়ে অচিন্ত্য সেনের চোখে প্রথম দর্শনে ঘূর্ণি এক ধরনের অদ্ভুত মায়ার মতো লাগল। অচিন্ত্য তখন সদ্য পাশ করা একজন তরুণ শিক্ষক, কৃষ্ণনগরের ছাত্র, কিন্তু আদর্শে গাঁথা এক প্রবল দেশপ্রেমিক। আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ পুলিশের লাঠির ঘা খেয়েছে, কিন্তু বাবার অশান্ত…
-
অরিত্র চক্রবর্তী পর্ব ১: আগমনের দিন আকাশটা ছিল ধূসর, পাহাড়ের কোলে জমে থাকা কুয়াশা গড়িয়ে পড়ছিল রাস্তার ধারে। কালিম্পং শহরের মূল অংশ থেকে গাড়ি ছুটেছে প্রায় পঁচিশ মিনিট, তখনই প্রথম দেখা মিলল সেই বাংলোর—একটা কাঠের দু’তলা বাড়ি, পাহাড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে। নাম তার “শিল কালিম্পং”—একটা লেখকদের রেসিডেন্সিয়াল প্রোগ্রাম, যেখানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে দশজন লেখক এসে জড়ো হয় প্রতিবছর, দশ দিনের জন্য। গাড়ি থেকে প্রথম নেমেছিলেন সুচেতা ব্যানার্জি—পঁয়ত্রিশ পেরোনো, শহর কলকাতার কবি, মুখে গম্ভীর ছায়া। পাহাড়ের নিঃশব্দতা তাকে কেমন অসহ্য লাগছিল প্রথমে, তারপর হঠাৎ শব্দ শুনলেন—ঝিঁঝিঁ পোকার, পাতা নড়ার, দূরের ঝরনার। মনে পড়ল কোনো এক কবিতার লাইন, “যেখানে ভাষা থেমে যায়,…
-
অনিরুদ্ধ ঘোষ পর্ব ১ দুপুর গড়িয়ে বিকেল। উত্তর কলকাতার এক পুরনো দোতলা বাড়ির জানালার পাশের ঘরটায় বসে আছে অরিত্র। চোখে তার একধরনের শূন্যতা, চা ঠান্ডা হয়ে গেছে টেবিলের কোণে, আর গিটারের তার ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে যেন কোনো স্মৃতি ছুঁতে চাইছে। হঠাৎ ঘরের দরজা খুলে ঢুকে পড়ল মৃণাল, অরিত্রর ছোটবেলার বন্ধু, এখনকার থিয়েটার ডিরেক্টর। “তুই এখনো ওই পুরনো গানের সুরটা নিয়ে পড়ে আছিস? কতবার বলেছি, নাটকটা নিয়ে সিরিয়াস হতে হবে,” বলে মৃণাল চেয়ারে বসে পড়ল। অরিত্র হালকা হেসে বলল, “এই সুরটা গেলে অনেক কিছুই হারিয়ে যাবে রে। মা যখন ছোটো ছিলাম, এই গানের সুরেই ঘুম পাড়াতো। এখন এটা ছাড়া কিছুই ভালো…
-
অনিরুদ্ধ বাগচী নীলচাষের আঘ্রাণ ঘন কালো মেঘ জমেছে আকাশে, যেন আষাঢ়ের শেষের এই সন্ধ্যেটা কোনো অশনি সংকেত নিয়ে এসেছে। শিবপুর গ্রামের গলির মাথায় দাঁড়িয়ে রেণুকা তাকিয়ে ছিল দূরের মাঠের দিকে। ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি নামবে—সে নিশ্চয় জানত। কিন্তু বৃষ্টির থেকে বড় ভয় তার মনে বাসা বেঁধেছে আজকাল—নীল সাহেবদের ভয়। এই গ্রামের সব জমিতে এখন আর ধান চাষ হয় না। নীল চাষ হয়। সাহেবরা এসে জমিদারদের সাথে হাত মিলিয়ে গ্রামটাকে বদলে দিয়েছে। আগের সেই সোনালি মাঠ আর নেই। এখন কেবল নীল গাছের শালপাতা রঙের পাতা আর কুয়াশার মত গন্ধমাখা নিঃশ্বাস। রেণুকার স্বামী হরিদাস যখন জীবিত ছিল, তখনো সে প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি…
-
ঐশী চৌধুরী জঙ্গলের ডাক মেঘমালা বসাকের বয়স পনেরো। কিন্তু তার চোখে যেন হাজার বছরের পুরোনো বৃক্ষের জ্ঞান আর ভবিষ্যতের বাতাসের গন্ধ। সবুজডাঙা গ্রামের এই দশম শ্রেণির ছাত্রী বরাবরই একটু অন্যরকম। পুতুল খেলায় তার মন ছিল না, বরং মাঠে ঘুরে ঘাসের গন্ধ নিতে, পাখিদের ডাক শুনতে আর গাছের ছায়ায় বসে গল্পের বই পড়তে ভালোবাসত। গ্রামের পাশেই একটুকরো জঙ্গল, যেখানে ছোট্ট খালটা বয়ে গেছে বাঁক নিয়ে। সেই খালের পাড়ে বসে মেঘমালা ভাবত, পৃথিবী যদি সবসময় এমন সবুজ থাকত! কিন্তু সবুজডাঙার সবুজ আর আগের মতো নেই। নতুন রাস্তা তৈরির নাম করে পঞ্চায়েত কয়েক মাস আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জঙ্গলের একাংশ কেটে ফেলা হবে। গাছগুলোতে…
-
পর্ব ১ আনন্দবাজারের শেষ পাতায় ছোট একটা বিজ্ঞাপন ছিল—“থিয়েটার ওয়ার্কশপ: কেউ যদি মঞ্চের আলোয় হাঁটতে চান, আসুন। বয়স, পেশা, অভিজ্ঞতা—সব এক পাশে সরিয়ে রাখুন।” রুদ্রর চোখে পড়েছিল বিজ্ঞাপনটা এক শনিবারের সকালে, যখন সে অফিস যাওয়ার আগেই হাঁপিয়ে উঠছিল জীবনের নিয়মে বাঁধা পড়ে। কর্পোরেট অফিসের কাঁচের জানালা দিয়ে সে প্রতিদিন শহরটাকে দেখে, কিন্তু তাতে কিছুই দেখা হয় না। ফাইল, মিটিং, টার্গেট—সব কিছুর মধ্যে কোথাও যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। নাটকের সাথে তার কোনো যোগাযোগ ছিল না, কিন্তু শব্দটা ‘চরিত্র’ যেন কেমন করে তার গায়ে লেগে গিয়েছিল। নিজের চরিত্রটা কেমন, সেটাই সে বুঝতে পারছিল না। ওয়ার্কশপের প্রথম দিন ছিল রবিবার। গলফ গ্রিনের একটা…
-
পারমিতা রায় ছাদের উপর সেই পাথরের বাক্স কলকাতার উত্তর শহরতলিতে, শ্যামবাজার থেকে একটু ভেতরে ঢুকলেই যে গলিটার মোড়ে বিশাল এক পামগাছ মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তার ঠিক পাশেই অবস্থিত “দত্ত ভিলা”। দু’শো বছরের পুরনো এক জমিদারবাড়ি, আজ যার অর্ধেকটা পরিণত হয়েছে কুয়াশা ও কালের ক্ষয়ে ধূসর এক ভগ্নদশা স্তূপে। মেঝেতে ফাটল, দেওয়ালে শ্যাওলা, আর কাঠের জানালায় কেবল বাতাসের ছোঁয়ায় গুনগুন শব্দ—সব মিলিয়ে যেন অতীত নিজে এসে বাসা বেঁধেছে এখানে। এই বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী এখন অর্ণব দত্ত—বয়সে প্রায় তিরিশ, ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ইতিহাস বিভাগে পিএইচডি শেষ করে সদ্য ফিরে এসেছে লন্ডন থেকে। ঠাকুরদার মৃত্যুর পর এই পুরনো বাড়িটি তার দায়িত্বে পড়েছে। যদিও…