অর্ণব দত্ত পর্ব ১ — রাতের সেতু হাওয়ায় গন্ধ ছিলো গরম লোহা আর নদীর শ্যাওলার। কলকাতার শহরতলির পুরনো লোহার সেতুটি রাত নামার পর যেন অন্য রকম হয়ে যায়—দিনে সে কত ব্যস্ত, ট্রাক, বাস, ভ্যানগাড়ি সব মিলিয়ে এক বিশৃঙ্খলা। অথচ গভীর রাতে, হঠাৎ করেই যেন সেতুর গায়ে সময় থেমে যায়। বাতাসে ভিজে ধাতব শব্দ বাজতে থাকে, দূরে নদীর স্রোত কালো তেলের মতো ঘন হয়ে বইতে থাকে, আর হাওয়ার ফাঁক দিয়ে মনে হয়, কারা যেন অদৃশ্য পায়ে সেতুর গায়ে হাঁটছে। অনিকেত দাঁড়িয়ে ছিলো সেতুর মাঝখানে। হাতে সিগারেট, চোখ নদীর দিকে। সে একজন সাংবাদিক, তিরিশ পেরিয়েছে, জীবন তাকে খুব একটা সহজ কিছু দেয়নি।…
-
-
দেবদীপ মুখার্জী পুরনো ভাড়াবাড়ি শহরের প্রান্তে, যেখানে নতুন উঁচু ফ্ল্যাটের দালান এখনও পুরোপুরি গজিয়ে ওঠেনি, সেখানেই একপাশে দাঁড়িয়ে আছে ভাঙাচোরা, শ্যাওলা-ঢাকা একটি ভাড়াবাড়ি। বাইরে থেকে দেখলেই মনে হয় বহুদিন কেউ থাকেনি। কিন্তু আসলে সেটা ভাড়ার জন্যই রাখা হয়েছে—সস্তা ভাড়া, সামান্য মেরামতির খরচে কেউ যদি সাহস করে থাকতে রাজি হয়। রুদ্র, সদ্য কলেজ শেষ করে সাংবাদিকতার চাকরিতে ঢোকা এক তরুণ, তার অফিসের কাছে একটা থাকার জায়গা চাইছিল। শহরের ভেতরে ভাড়া সামলানো সম্ভব হচ্ছিল না। ঠিক তখনই এক প্রপার্টি ডিলারের মাধ্যমে এই বাড়ির খোঁজ পায়। বাড়িটা দেখতে এসে প্রথমেই বুক কেঁপে উঠেছিল—কালচে দেওয়াল, কাঠের জানালায় ফাটল, ছাদের কোণে বাদুড় ঝুলে আছে। কিন্তু…
-
রুবিনা মাহমুদ ১ রাতটা ছিল অদ্ভুত শান্ত। এমন শান্ত যে খুলনার বাতাসেও যেন শব্দ ঢুকতে সাহস পায় না। কিন্তু এই নিশুতি রাতেই শব্দ জন্ম নিচ্ছে, জন্ম নিচ্ছে এমন এক তরঙ্গ, যা ভবিষ্যতের কান্না বা বিজয়—দুটোর একটিকে জাগিয়ে তুলবে। রওশন আরা জানালার পর্দাটা সরিয়ে একবার বাইরে তাকালেন। তামাটে চাঁদের আলোয় গাছের ছায়া লম্বা হয়ে উঠেছে। একটা কুকুর হঠাৎ ডেকে উঠলো দূরে, যেন ইশারা দিচ্ছে—“সব ঠিক নেই।” ঘরের কোণার ছোট মেজেতে পাতলা লেপ, একটা সেলাই মেশিন আর একটা কাঠের বাক্স। কিন্তু বাক্সটা ছিল আলাদা। সাধারণ কাঠের নয়, ভিতরে ছিল রেডিও ট্রান্সমিটার, নিজ হাতে বানানো। ধীরে ধীরে মুখের চশমাটা খুলে রাখলেন রওশন। চুলের…
-
অনিন্দ্য সেন ১ সকালটা অন্য দিনের মতোই ছিল—আলোর বন্যা ছড়িয়ে পড়ছে শেক্সপিয়র সরণির খোলা জানলা দিয়ে, পাখির ডানার শব্দ মিশে যাচ্ছে ঘড়ির টিকটিক শব্দে। কিন্তু অনির্বাণ বসুর নাকে সকালটা কেমন যেন অন্যরকম গন্ধ নিয়ে হাজির হয়েছিল। এই গন্ধটা সে এর আগে কখনও পায়নি। যেন বাদামি কাগজের ভাঁজে পুরনো অভিমানের মত গন্ধ, যেন এক মৃত নারীর ঠোঁটে লেগে থাকা শেষ হাসির ছায়া। অনির্বাণ, পেশায় এক ‘নোজ’—অর্থাৎ পেশাদার ঘ্রাণবিশেষজ্ঞ। বিদেশ থেকে স্নাতক করে ফিরে এসে গত পাঁচ বছর ধরে সে কলকাতার সবচেয়ে অভিজাত পারফিউম ব্র্যান্ড ‘সুরভি’তে কাজ করে। তার কাজ নতুন সুগন্ধের সন্ধান, নতুন ঘ্রাণের সংমিশ্রণ তৈরি করা, যেগুলো মানুষ পরে গায়ে…
-
জিনিয়া রায় পর্ব ১ ২০৭৫ সালের ‘নিউ কলকাতা’ রাত জেগে থাকে এলইডি আলো আর ড্রোনের গুঁজনের নিচে। এ শহরের আকাশে তারা নেই, আছে ডেটা-গ্রিড আর ক্লাউড রেডিয়েশন। আর এ শহরের শিশুদের কাঁদার আওয়াজ নেই, কারণ জন্মই হয় নিরবতায়, সিলিকনের স্যানিটাইজড ওয়ার্ডে, বেছে নেওয়া জিনের শংসাপত্র হাতে নিয়ে। কিন্তু সেদিন ভোররাতে, শহরের পূর্বাংশে পুরনো ধ্বংসপ্রাপ্ত হাসপাতালের নিচতলায় এক শিশুর কান্না শোনা গেল। তার নাম রাখা হলো—আরব। পৃথিবীর নিয়ম অনুযায়ী এই জন্ম বেআইনি। আরবের মা নিসর্গা সেন একসময়কার জেনেটিক্স ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র রিসার্চার ছিলেন। কিন্তু যখন ‘G-Sculpt’ কোম্পানি পুরো মানবজাতির জিন বেছে নেওয়ার অধিকার জনগণের কাছ থেকে কেড়ে নেয়, নিসর্গা পালিয়ে যায়, নিজেকে…
-
আয়নান তাসফিয়া পার্ট ১ — ধুনুচির ধোঁয়ার মধ্যে চান মিয়া নামে যে ফকিরটার কথা বলে পুরো বরিশালের ময়না ইউনিয়ন, সে এই গ্রামে এসেছিল বছর দশেক আগে, হাটের একেবারে পাশের খালি জমিতে একটা মাটির ঘর বানিয়ে। গা ঢাকা শাদা পাঞ্জাবি, চোখে কাঁচের ফ্রেমের মোটা চশমা, আর হাতে একখানা কাঠের লাঠি। গ্রামের লোক প্রথমে ভেবেছিল কোনো পাগল এসেছে, হয়তো শহর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া কেউ, বা শ্মশানে ঘুরে বেড়ানো অদ্ভুত লোকদের একজন। কিন্তু খুব দ্রুতই মানুষের ধারণা বদলে গেল। শুরুটা হয়েছিল এক রাতে। হাটের পাশের কুয়োর জলে সাপ পড়ে গিয়েছিল, আর গ্রামের কেউই সাহস পাচ্ছিল না উঠাতে। তখনই চান ফকির ধুনুচি জ্বালিয়ে, মাটি…
-
অন্বেষা পাল পর্ব ১: শহর থেকে আগমন শহর যতটা দ্রুত হাঁটে, শান্তিনিকেতন ততটাই ধীরে হাঁটে—আর সেই ধীর গতির মধ্যেই যেন তার প্রকৃত ছন্দ। ঈশিতা চক্রবর্তী, কলকাতার একটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্রী, প্রথম যখন শান্তিনিকেতনে পা রাখল, তার মনে হয়েছিল যেন কেউ টিভির রিমোটে ‘স্লো মোশন’ বাটন চাপিয়ে দিয়েছে। কলকাতা থেকে আসা লোকাল ট্রেনটা বোলপুর স্টেশনে থেমে যাওয়ার পর যে নিস্তব্ধতা তাকে ঘিরে ধরল, তা কিছুটা আরামদায়ক, কিছুটা অস্বস্তিকর। সে যেন নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও বেশি করে শুনতে পাচ্ছিল। ব্যাগপত্র হাতে নিয়ে সে স্টেশনের বাইরে বেরোল। শান্তিনিকেতনের বাতাসে একটা হালকা শুকনো পাতার গন্ধ ছিল—সেই গন্ধ শহরে নেই, পারফিউমেও নেই। অথচ কেমন একটা…
-
অর্ঘ্য মজুমদার পর্ব ১: চায়ের দোকানটা অদ্ভুত ছিল শিলিগুড়ির হিলকার্ট রোডের ঠিক এক কোণায় একটা ছোট্ট চায়ের দোকান আছে, নাম—”ডার্ক চা”। দোকানটা যতটা ছোট, ততটাই অদ্ভুত। এখানে চা বানানো হয় একটা পুরনো কেতলিতে, যার মুখে লাল রঙের একটা পাথর বসানো। দোকানের মালিক একটা তরুণী—নির্মা, বছর সাতাশের মতন বয়স। লম্বা কালো চুল, সিঁথিতে লাল সুতো, চোখে অদ্ভুত ঠান্ডা দৃষ্টি। তার চা খেলে কেউ না কেউ কিছু একটা ভুলে যায়—পুরনো প্রেমিকের নাম, নিজের মোবাইলের পাসওয়ার্ড, বা একটা দুঃস্বপ্ন। শহরের কিছু মানুষ হাসতে হাসতে বলেন, “ও চা না, ডাকিনির পান!” কিন্তু কেউই অদ্ভুতভাবে দূরে থাকে না। বরং সন্ধে হতেই দোকানটা জমে ওঠে—কলেজ পড়ুয়া…
-
তিস্তা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্ব ১: প্রথম ইমেল সকালটা শুরু হয়েছিল একেবারে নির্লিপ্তভাবে। স্নান, ব্রেকফাস্ট, মেট্রো, আর তারপর অফিস। কিন্তু সেই নির্লিপ্ততাকে ভেঙে দিল একটা ইমেল—অপরিচিত প্রেরকের, বিষয়বস্তু: “Couldn’t help noticing your post-it habit.” অপরাধ যেন হাতে নাতে ধরা পড়েছে। অনন্যা বসু, এইচআর ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, যাঁর ডেস্ক সবসময় একটা রঙিন ঝকঝকে পোস্ট-ইটের সাম্রাজ্য, প্রথমে একটু চমকে উঠলেন। তারপর হাসলেন। কে এই মানুষটা? অফিসের কেউই হবে। না হলে তো তাঁর ডেস্ক পর্যন্ত নজর পড়ে না। ইমেলের শেষে সিগনেচার ছিল—“Regards, S. Dey, Product Strategy.” অ্যাপ্লিকেশন ওপেন করে লগ-ইন করলেন অনন্যা। “S. Dey”—মানে কি সেটা সুদীপ? না শুভম? স্ট্র্যাটেজিতে তো কয়েকজন নতুন এসেছে। আবার…
-
অভিষেক ভট্টাচার্য পর্ব ১: কোণের ঘরে এক পুরনো নথি শোভন রায়, কলকাতার এক উঠতি ইতিহাসবিদ, চাকরি করেন একটি নামী গবেষণা সংস্থায়। চৈতন্যদেবের জীবনের ওপর একটি নতুন ডকুমেন্টারি তৈরির কাজে তাকে পাঠানো হয় পুরী। উদ্দেশ্য—চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনের শেষ দিনগুলির ওপর তথ্য সংগ্রহ এবং তার মৃত্যু সম্পর্কে প্রামাণ্য প্রমাণ খোঁজা। যদিও ইতিহাস বলে, ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দে একরাত্রে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে কীর্তন করার সময় হঠাৎই অন্তর্ধান হয়ে যান তিনি—কেউ বলেন তিনি সমাধিস্থ হন, কেউ বলেন তিনি গিয়েছিলেন সমুদ্রপথে। কোনো স্পষ্ট সমাধান নেই। শোভনের আগ্রহ ইতিহাসের চেয়েও বেশি কৌতূহলের। তিনি বিশ্বাস করেন, প্রতিটি অন্তর্ধান কিংবা মৃত্যু রহস্যের অন্তরালে থাকে বাস্তব। আর বাস্তব যত গোপন থাকে,…