সুশান্ত দাস ১ গ্রামের পুকুরটি সবসময়ই একটি রহস্যময় উপস্থিতি বয়ে আনে। দিনের আলোয় যখন গ্রামের মানুষ সাধারণ কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে, তখনও পুকুরটি যেন নীরবভাবে তাদের নজর কাড়ে। পুকুরটির পানি গভীর এবং অন্ধকারের মিশ্রণে যেন অদ্ভুত এক আভা ছড়িয়ে দেয়। পুকুরের চারপাশে হালকা ঘাস আর কিছু ছোট গাছ থাকলেও, রাতে সেই ঘাস আর গাছের ছায়া যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। গ্রামের মানুষ নানা গল্প শোনায়—কিছু গল্প কেবল ভয়ের, আবার কিছু গল্পে বলা হয় বহু বছর আগে এখানে একটি মেয়ের রহস্যময় মৃত্যু ঘটেছিল। সেই মেয়েটিকে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। লোকেদের কথা অনুযায়ী, মেয়েটির আত্মা এখনও পুকুরের পানির মধ্যে ভেসে বেড়ায়।…
-
-
১ পুরনো শহরের খাম্বা-খাম্বা সড়ক পেরিয়ে ছাত্রটি অবশেষে সেই হোটেলের সামনে থামে, যেটি অনেক দিনের পুরনো কাহিনী আর শহরের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হোটেলটি বাইরে থেকে দেখতে চেহারা হিসাবে সময়ের সাক্ষী—পুরনো দেয়ালগুলোতে ফাটল, ধুলো জমে থাকা জানালা, এবং কখনো ভাঙা কখনো রঙ ছুঁয়ে থাকা দরজা, যেন প্রতিটি কোণই নিজের ভাষায় শহরের অতীত গল্পগুলো বলে। প্রবেশদ্বারে ধাতব ঘণ্টার গর্জন ভাঙতে ভাঙতে বাজে, আর সেই শব্দের প্রতিধ্বনি ভেতরের খালি প্রাঙ্গণে একটা অদ্ভুত নীরবতার সৃষ্টি করে। হোটেলের লবি কোনো সাধারণ হোটেলের মতো উজ্জ্বল বা আতিথ্যপূর্ণ নয়; বরং এতে আছে ধূসর রঙের ছায়া, পুরনো কাঠের মেঝেতে পা ফেলার সাথে সাথে কেবল ধীর ধীর শব্দ,…
-
সুশান্ত নস্কর অধ্যায় ১ – নিঃসন্তান দম্পতির আশা রবি ও রুমার সংসারটি গ্রামের সাধারণ জীবনের মধ্যে গভীর শান্তি ও এক ধরনের অদৃশ্য দুঃখ বহন করত। বহু বছর ধরে তারা নানা চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়েও সন্তানের আশায় ব্যর্থ হয়েছেন। প্রতিটি মাসের প্রথম এবং শেষ দিনগুলো যেন তাদের জীবনে অতিরিক্ত চাপ ও হতাশা নিয়ে আসে। রুমা প্রায়শই তার কোল গলে শিশুর কল্পনা করে, স্বপ্নে সেই কল্পিত শিশুকে দেখে হেসে ওঠে, আবার কখনও চোখের কোণে অজান্তেই জল আসে। রবি চেষ্টা করে সংসারের কাজকর্ম ও তার চাকরিতে মন দিতে, কিন্তু রুমার চোখে যে দুঃখের ছায়া, তা তিনি কখনো এড়াতে পারেন না। তারা শুনেছে…
-
১ কলকাতার এক প্রাচীন রাজবাড়ি, যার দেয়ালগুলো স্নিগ্ধ ইতিহাস আর অগণিত স্মৃতির বহনকারী, নতুন মালিকদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন জীবনের আহ্বান জানাচ্ছিল। রঙ ফ্যাকাশে দেয়াল, ভগ্নপ্রায় কাঠের জানালা এবং প্রাচীন সিঁড়ির কুড়ির মতো পদক্ষেপের আওয়াজে যেন অতীতের আভা প্রতিফলিত হচ্ছিল। নতুন মালিকরা, রাহুল এবং তার স্ত্রী ইলা, প্রথমে সবকিছুই আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করলেও, শীঘ্রই তারা লক্ষ্য করল যে রাতের নিরিবিলি মুহূর্তগুলোতে করিডোর থেকে অদ্ভুত পদশব্দ ভেসে আসে। প্রথমে তারা এটিকে ভেবেছিল হয়তো বেজে ওঠা পাখির আওয়াজ বা পুরোনো কাঠের সৃষ্ট স্বাভাবিক শব্দ, কিন্তু সময় যত গড়ায়, শব্দগুলো আরও নির্দিষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট হয়ে ওঠে—কোনও এক অদৃশ্য উপস্থিতি যেন ধীরে ধীরে তাদের…
-
তনয়া সেন বিকেলের শেষ আলোয় যখন সূর্য পাহাড়ের গায়ে ধূসর হয়ে গলে আসছিল, তখনই অরণ্যের বাস এসে পৌঁছল ছোট্ট গ্রামটায়। বাস বলতে আসলে একটা পুরোনো মিনিবাস, জানালার কাচ ঝাপসা, সিটের চামড়ায় ফাটল। গাঁয়ের নাম রাধাপুর—এমন নাম মানচিত্রে খুঁজলেও পাওয়া মুশকিল। তবু অরণ্যের মতো ফটোগ্রাফারের কাছে এই জায়গার টান ছিল অন্যরকম। শহরের কোলাহল, নামজাদা প্রকল্প, নামী রিসর্ট নয়—বরং অচেনা, অনাবিষ্কৃত জায়গার মধ্যে লুকোনো প্রকৃতির ছবি তুলতে তার সবচেয়ে ভালো লাগে। অরণ্যের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা ভারী, ভিতরে ক্যামেরা, লেন্স, ত্রিপড আর কিছু নোটবুক। বাসস্ট্যান্ডে নেমে চারপাশে তাকাতেই সে বুঝল, এই গ্রাম যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচা রাস্তা, খড়ের চালের ঘর, বাচ্চাদের…
-
মৈনাক ভৌমিক ১ পুরুলিয়ার চন্দনবন — নামটি আজও অনেকের কাছে অজানা, যদিও লোকমুখে ছড়িয়ে থাকা বহু গল্পের কেন্দ্রবিন্দু এই অরণ্য। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তঘেঁষা এই অঞ্চলটি আদিবাসী জনপদের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা ঘন জঙ্গলে ভরপুর, যেখানে আজও সূর্যাস্তের পর কেউ একা পথ মাড়ায় না। অথচ সেখানেই, এক শতাব্দী পুরনো ব্রিটিশ জরিপ মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া এক দাগচিহ্ন—“K.T. Akhra (Abandoned)”—ডঃ ঋত্বিক বসুর চোখে পড়ে। বহুদিন ধরে প্রাচীন ভারতীয় তন্ত্রচর্চা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসা এই প্রত্নতত্ত্ববিদ তার টিম নিয়ে রওনা দেন চন্দনবনের উদ্দেশ্যে। তাঁর দলের সঙ্গে ছিলেন ইতিহাসের গবেষক ইরা সেনগুপ্ত, ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর অভীক মণ্ডল, তথ্যলিপিকার তৃষা দে এবং স্থানীয় গাইড হিসেবে নিযুক্ত হন নিতাই মাহাতো,…
-
সৌমিক ভট্টাচার্য ১ পাহাড়ি রাস্তাগুলো যেন কোনও অজানা গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল অভিজিৎ সেনগুপ্তকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের গবেষক, লোকবিশ্বাস এবং পাহাড়ি সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘদিনের আগ্রহ ছিল তার। একটি গবেষণা প্রকল্পের সূত্রে সে এবার রওনা দিয়েছিল উত্তরবঙ্গের এক অদ্ভুত দূরবর্তী গ্রামে—সিংরিপাহাড়। ট্রেন থেকে নামার পর পায়ে হেঁটে, জিপে চড়ে, শেষমেশ খচ্চর পিঠে চেপে পৌঁছাতে হয়েছিল তাকে সেই দুর্গম স্থানে। পাহাড়গুলো যেন দাঁড়িয়ে ছিল এক অভেদ্য প্রাচীর হয়ে—মানুষের সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন, অথচ নিজেদের মতো করে সাজানো এক অলৌকিক গ্রাম। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অবস্থিত ছোট্ট গ্রামটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ল ছায়াঘেরা গাছপালা, পাথরের বাড়ি, আর সন্ধ্যার আগেই বন্ধ হয়ে আসা কুড়িটি দরজা-জানালা। অভিজিৎ…
-
তুষার অধিকারী এক আষাঢ় মাসের শেষভাগ। ঘন মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে চিংড়িঘাটের ঘোলা জল থেমে থাকলেও বাতাস কাঁপিয়ে চলেছে। বোটের ইঞ্জিনের একটানা গর্জন ঠেলে, গহীন ম্যানগ্রোভের মধ্যে ঢুকে পড়ছে এক গবেষক দলের চার সদস্য—ড. অদিতি সেন, সম্রাট দে, জয়ন্ত ঘোষ ও স্থানীয় গাইড বীরাজ মুখার্জি। চারপাশে থমথমে নিরবতা। মাঝে মাঝে দূরে শোনা যায় ময়ূরের ডাক, আবার কোথাও চাঁদিয়ালের তীক্ষ্ণ শব্দ। গঙ্গার শাখা নদী ঘেঁষে বোটটা এগোচ্ছে, সঙ্গে করে যাওয়া খাবার, ক্যামেরা ট্র্যাপ, ড্রোন, ল্যাপটপ, আর একরাশ কৌতূহল। অদিতি চোখ মেলে দেখছেন—দু’পাশে যে বন, সেটাকে শুধুই গবেষণার বিষয় বলে মনে করা ভুল হবে। একটা অলিখিত অনুভব যেন সঙ্গী হয়ে এসেছে—এই বনের…