আত্মদীপা সেন পর্ব ১ – আগমন শীতের শেষ দিকের হাওয়া নামছিল পাহাড় থেকে। সন্ধেবেলা দার্জিলিংয়ের ধারে মেঘলা সেন ছোট্ট একটা লোকাল বাসে চেপে নামল জনশূন্য রাস্তায়। চারদিক জুড়ে তখন কুয়াশার ধোঁয়া, যেন পাহাড়টা নিজের বুকের ভেতর পৃথিবীকে গিলে নিতে চাইছে। তার হাতে একটা পুরনো নোটবুক, ভেতরে টুকে রাখা এক রহস্যময় ঠিকানা—“শেষ গ্রন্থাগার, রংটং পাহাড়তলি।” মেঘলা কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। তার থিসিস ছিল প্রাচীন বই নিয়ে—কাগজের গন্ধ, ছাপার দাগ, মানুষের হাতের ছোঁয়া। অথচ এই পৃথিবীতে এখন বই বলতে বোঝানো হয় কেবল স্ক্রিনের আলো। সব দেশ, সব সরকার, সবকিছু ডিজিটাল আর্কাইভে সরিয়ে নিয়েছে। কাগজের বই নিষিদ্ধ না হলেও, বিলুপ্তির পথে ঠেলে দেওয়া…
-
-
হিয়া মিত্র পর্ব ১: পূর্ণিমার আগে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে ওঠার সময় অরণ্য ভাবছিল, শহরের শব্দকে যদি কাগজে বন্দি করে রাখা যেত, তবে হয়তো সে বুঝতে পারত নীরবতার প্রকৃত মানে কী। গাড়ির জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল চা-বাগানের ঢেউ, দূরে নীলচে পাহাড়, আর মাঝেমাঝে রাতের বৃষ্টির পর জমে থাকা কাদা। বাসস্ট্যান্ডে নামতেই কুয়াশা ওড়ার মতো ভেসে এসে তার গায়ে লাগল—ঠাণ্ডা, কিন্তু দংশনহীন। এখানে আসার উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট: একান্তে বসে নতুন কবিতার বইয়ের খসড়া শেষ করা। কিন্তু উদ্দেশ্য স্পষ্ট হলেই কি পথ অনাড়ম্বর থাকে? গ্রামের একমাত্র চায়ের দোকানে বসে সে অল্প চিনি দিয়ে চা খাচ্ছিল। দোকানদার, বলিষ্ঠ গড়নের, গায়ের ওপর মোটা সোয়েটার টেনে, জিজ্ঞেস…
-
সন্দীপন ধর খামে মোড়া নীরবতা রমেশচন্দ্র বসু বসে আছেন জানালার ধারে রাখা সেই পুরনো বেতের চেয়ারে। জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া বিকেলের আলো তার রুপোলি চুলে খেলে যাচ্ছে। মাথার ঠিক পাশেই একটা ছোট কাঠের তাক, সেখানে রাখা তার স্ত্রীর একটা ছবি — মেঘলা শাড়ি, মৃদু হাসি, কপালে ছোট্ট টিপ। নাম ছিল তার — কাবেরী। আজ অনেকদিন পর আবার পোস্টম্যান এসেছিল। লাল-হলুদ ইউনিফর্ম, কাঁধে ব্যাগ। সে বলল, “বসুবাবু, আপনার পেনশনের শেষ চেকটা এসেছে।” রমেশচন্দ্র ধীরে হাত বাড়িয়ে খামটা নিলেন। যেন মৃদু এক স্নেহে ছুঁলেন। এই খামে শুধু টাকা নেই, আছে একটা দীর্ঘ জীবনের সমাপ্তি ঘোষণা। অফিসের শেষ বেতন মাসেরও বেশি…
-
তিথি বসু পর্ব ১: তাবিজওয়ালা ঘর শহরের কোলাহলের মাঝখানে, যেখান থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ঝাপসা দেখা যায়, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে চৌরঙ্গীর একটি পুরনো হোটেল—‘হোটেল সম্রাট’। বাইরে থেকে দেখলে আধুনিক মনে হলেও ভিতরে ঢুকলেই যেন সময় পিছিয়ে যায়—ফিকে আলো, সাদা কাঠের জানালা, আর মোটা মোটা পর্দা যা আলো ঢুকতে দেয় না। সেই হোটেলের ৩১৫ নম্বর ঘর থেকে পাওয়া গেল এক মৃতদেহ। পুলিশ এসে দরজা ভেঙে দেখে—একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ খাটে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। ঘরের ভিতর অদ্ভুত একটা গন্ধ—মাটির, ধূপের, আর যেন ভেজা ছাইয়ের গন্ধ। মৃতদেহের পাশে পড়ে ছিল একটি তাবিজ—লাল সুতোয় বাঁধা, তাতে শিকল দিয়ে আটকানো একটা ক্ষুদ্র রৌপ্য বাক্স। এই খুনের…
-
সায়নী বসু শীতল জানলার কাচে ভোরের শিশির জমেছে, আলো এসে পড়েছে থেরাপি রুমের কাঠের মেঝেতে। ড. মেঘলা দত্ত প্রতিদিনের মতো আজও ক্লিনিকের টেবিলে বসে, পেশেন্ট ফাইল ঘাঁটছেন। ঘড়িতে তখন সাড়ে ন’টা। নতুন রোগী আসার কথা সাড়ে দশটায়—রেফার করা হয়েছে একটি সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র থেকে। “স্মৃতিভ্রষ্ট, আচরণ স্বাভাবিক, অস্থায়ী আবাসন হোমে রাখা হয়েছে,”—এইমাত্র এমন একটি রোগী এসেছেন যার জীবন যেন এক ছেঁড়া পাজল। মেঘলা চোখ বুলিয়ে নেয় রিপোর্টে, কিন্তু বিশেষ কিছু ধরা পড়ে না। তার মনে অদ্ভুত এক শূন্যতা কাজ করে, কারণ এই ধরনের রোগীদের মাঝে প্রায়ই এমন কিছু থেকে যায়, যা রিপোর্টে ধরা পড়ে না—হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক, অসম্পূর্ণ গল্প, বা…
-
অনির্বাণ ঘোষ অদ্ভুত ধ্বনি গাঁয়ের শেষ সীমানায়, ঘন জঙ্গল আর বুনো পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল বহুতলা ভুতের বাড়ি, যেখানে কোনোদিন মানুষের পা পড়েনি। গাঁয়ের বয়স্করা বলতেন, “এ বাড়ি শাপিত, এখানে বাস করা লোকের ভাগ্য বিপর্যস্ত।” কিন্তু আধুনিক যুবকরা এসব অন্ধবিশ্বাসকে গা ছেড়ে দিয়েছিল, আর তার মধ্যে এক জন ছিল আরিফ। এক রহস্যপ্রেমী সাংবাদিক, যিনি শহর থেকে এই গ্রামে এসেছিলেন কিছু অদ্ভুত ঘটনা অনুসন্ধান করতে। আরিফের প্রথম দিনের সন্ধ্যায় যখন সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্ত যাচ্ছিল, তখন গাঁয়ের বাজারের এক কনফেকশনারি দোকানে বসে শুপ্রা নামক এক স্থানীয় মেয়ের সাথে পরিচয় হলো। শুপ্রা কথায় কথায় বলল, “আপনি কি বহুতলা ভুতের বাড়ি সম্পর্কে জানেন?”…
-
সোমা মিত্র আমার স্মৃতি পুরোনো অ্যালবামের মতো—কিছু ছবি রঙ হারিয়েছে, কিছু এখনো ঝকঝকে। উত্তর কলকাতার যে বাড়িটাতে আমার জন্ম, সেই লালবাড়িটা এখন আর নেই। সেটার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে চকচকে অ্যাপার্টমেন্ট, নাম—“মঙ্গলতারা হাইটস”। মাঝে মাঝে ভাবি, নামটা কত গ্ল্যামারাস, অথচ সেই নামের নিচেই চাপা পড়ে গেছে আমার ছোটবেলার চটি পায়ে দৌড়ানো বারান্দা, কাঁঠালের গন্ধমাখা দুপুর, আর দিদার হাতে বাঁধা তুলসী মালা। আমাদের বাড়িটা ছিল এক রকম রেওয়াজি—সকালে প্রার্থনা, দুপুরে শব্দ করে পাখার ঘুরন্ত আওয়াজ, আর সন্ধ্যেবেলা harmonium-এর একঘেয়ে সুর। বাবা অফিসফেরতা এককাপ চায়ে দিন শেষ করতেন, আর মা রান্নাঘরের কোণে বসে চুপচাপ মাছ কুটতেন—কখনোই অকারণে হাসতেন না। তবু আমি জানতাম, মা…
-
ইন্দিরা দত্ত পর্ব ১: জানলার ওপারে বেলেঘাটা অঞ্চলের পুরনো এক বাড়ির জানালায় বসে আছেন অরুন্ধতী সেন। বয়স প্রায় পঁচাত্তর। বিধবা, প্রাক্তন স্কুল শিক্ষিকা। একটা সময় ছিল যখন তিনি ছিলেন ‘ম্যাডাম সেন’ — প্রয়োজনে কঠোর, কিন্তু কোমল হৃদয়বিশিষ্ট এক আদর্শ শিক্ষিকা। এখন তিনি শুধু অরুন্ধতী — একা, নিঃসঙ্গ, আর অপেক্ষায় থাকেন রোজ দুপুরে ডাকপিয়নের গলার আওয়াজ শোনার। তাঁর ছেলে সৌরভ আমেরিকায় চাকরি করে। মেয়ে অদিতি দিল্লিতে থাকে, সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বছরখানেক আগে একবার এসেছিল… তারপর আর ফেরা হয়নি। অরুন্ধতী এখন বেশিরভাগ সময় বই পড়ে কাটান। তবে মাঝে মাঝে সে বইয়ের পাতাগুলোর ফাঁকেও যেন খুঁজে ফেরেন কারও কণ্ঠস্বর, কেউ যেন ডাকে—“মা…” একদিন,…