প্রাপ্তি নাগ অজয় শহরের দীর্ঘ এবং অবিরাম কোলাহল থেকে দূরে এক নিস্তব্ধ ঠিকানা খুঁজছিলেন, যেখানে তার লেখক মনের প্রশান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। প্রায় এক বছরের ব্যস্ততা, মেট্রোর শোরগোল, অফিসের জটিলতা এবং শহরের অগণিত মানুষের মাঝে নিজেকে হারিয়ে যাওয়ার পর, সে অনুভব করছিল একরাশ শান্তির প্রয়োজন। অজয় সিদ্ধান্ত নিলেন সুন্দরবনের এক ছোট দ্বীপ কাঁঠালপুরে ছুটি কাটানোর জন্য। দ্বীপটি শহরের আধুনিকতা থেকে বহু দূরে, যেখানে শুধু নদী, জঙ্গল এবং ছোট্ট গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবন প্রবাহিত হয়। নৌকায় চড়ার সময় নদীর ঢেউয়ের সরল ছন্দ তাকে প্রথমবারের মতো মনে করিয়ে দিল প্রকৃতির এক অমোঘ সৌন্দর্য। নদীর তীরে হালকা কুয়াশা, দূরের গাছেদের গাঢ় সবুজের স্তর,…
-
-
অতিন্দ্র মুখার্জী অধ্যায় ১ – ঝড়ের রাত সুন্দরবনের গভীর অরণ্যের ভেতর যখন ভাটা নামে, তখন গোটা অঞ্চলের নদী, খাঁড়ি আর নোনা জল যেন অন্য এক সুরে বেজে ওঠে। দিনের শেষে জোয়ারের স্রোত সরে গিয়ে জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে কেবল মাটির গন্ধ আর ভেজা বাতাস ভেসে বেড়ায়। এ সময় মাছ ধরতে বের হওয়া জেলেদের জন্য কাজটা যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি ভয়ংকরও বটে, কারণ ভাটার পরে আসা ঝড় বা ঘূর্ণি হঠাৎ করেই সবকিছু গ্রাস করতে পারে। হরিদাস মণ্ডল, চেহারায় বলিষ্ঠ কিন্তু জীবনে দুঃখে জর্জরিত, এই রাতেও নিজের ভাঙাচোরা নৌকায় জাল নিয়ে নদীতে নামে। আকাশে তখন কালো মেঘ জমে উঠেছে, বাতাসের গায়ে লবণাক্ত কটু স্বাদ,…
-
১ ঈশা দত্ত ট্রেনে দীর্ঘ যাত্রার পর যখন সুন্দরবনের ভেতরের ছোট্ট জনপদের ধুলোমাখা স্টেশনে নেমে এলো, তখন তার মনে হচ্ছিল যেন শৈশবের স্বপ্ন আর ভয় দুটো একসাথে হাত ধরে হাঁটছে। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে স্টেশন থেকে বেরোনোর সময় চারপাশের গন্ধটা প্রথমেই তাকে আঘাত করল—আধভেজা কাদা, নোনা বাতাস, গাছের পাতা, আর নদীর জলে লবণাক্ততার মিশ্র গন্ধ। এ সবকিছুর ভেতরে সে যেন শুনতে পাচ্ছিল অজস্র গল্পের প্রতিধ্বনি, যেগুলো ছোটবেলায় শোনানো হয়েছিল তাকে দাদার ঠোঁট থেকে। সেই জলমহল—এক ভগ্নপ্রায় জমিদারবাড়ি, নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ধেক ডুবে যাওয়া প্রাসাদ—যেটাকে নিয়ে লোকজন বলে অসংখ্য অদ্ভুত কথা। ঈশার মনে পড়ে গেল শৈশবের সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে থাকা, হাতে…
-
অভ্রনীল দত্ত পর্ব ১ – যাত্রা শুরু সকালবেলা কোলাহলমুখর শিয়ালদহ স্টেশনের ভিড়ের ভেতর দিয়ে যখন তারা সবাই প্ল্যাটফর্মে পৌঁছল, তখনও কারও মাথায় ছায়ামাত্রও ছিল না কী অপেক্ষা করছে সামনে। কলকাতার এই পাঁচজন কলেজ–বন্ধু—অনিক, সুমিত, তন্ময়, দেবলীনা আর রুদ্র—দীর্ঘদিন পর আবার মিলে একসঙ্গে কোথাও বেরোচ্ছে। গন্তব্য সুন্দরবন। ভ্রমণের উদ্দেশ্য একটাই—দু–একদিন শহরের কোলাহল ভুলে প্রকৃতির নির্জন অরণ্যে কিছুটা সময় কাটানো, বাঘ দেখার ভাগ্য হলে আরও ভালো, আর সবার ওপরে একধরনের অদেখাকে দেখার আকাঙ্ক্ষা। রুদ্র, যে দলের মধ্যে সবচেয়ে উচ্ছল, আগেই পরিকল্পনা করেছিল গোটা ট্রিপ। সে বলেছিল—“এইবার তো পুজোর ভিড় নেই, একেবারে নিস্তব্ধ জঙ্গলে গিয়ে আসব। কী রোমাঞ্চ বলো তো!” বাকিরা তার কথায়…
-
১ ড. অরিন্দম মুখার্জি, কলকাতার একটি নামকরা গবেষক, তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে সুন্দরবনের অদূরপ্রান্তে অবস্থিত ছোট্ট গ্রাম ধনডুবি পৌঁছান। তিনি বন এবং নদীর সঙ্গে মিশে থাকা গ্রামীণ জীবনের স্বাভাবিকতায় নিজেকে পুরোপুরি নিমগ্ন করতে চান, তবে তাঁর আসল উদ্দেশ্য আরও রহস্যময়—গ্রামের লোককথা অনুযায়ী প্রতি পূর্ণিমার রাতে নদীর পারে যে কালো লন্ঠন জ্বলে ওঠে, তা নিয়ে তিনি গভীর গবেষণা করতে চাচ্ছেন। গাছ-গাছালির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, অরিন্দম অনুভব করেন যে এই গ্রামটি অন্য যে কোনও স্থানের মতো নয়। নদীর জলের নীরবতা, পাতা ছিঁড়ে পড়ার শব্দ, দূরে কোথাও পাখির ডাকে, সব মিলিয়ে যেন এক অদ্ভুত সুরের সৃষ্টিকর্ম। গ্রামের প্রধান রাস্তার ধারে পৌঁছলে,…
-
প্রনব কুমার সিনহা এক কলকাতার এক ব্যস্ত সন্ধ্যায়, শহরের কোলাহলের ভেতর থেকে অর্ণব সেনের মনটা যেন ছুটে যাচ্ছিল অন্য এক জগতে। তিনি পেশায় সাংবাদিক, কিন্তু নেহাত সংবাদ সংগ্রহ নয়, অর্ণবের আলাদা দুর্বলতা ছিল ইতিহাস ও লোককথার প্রতি। কলেজের সময় থেকেই তার অভ্যাস—শহরের পুরোনো ঘাট, অজানা গলি বা অচেনা গ্রামে গিয়ে স্থানীয় লোকেদের কাছ থেকে অদ্ভুত গল্প শোনা। সেদিনও একে একে রাত নেমে আসছিল বাগবাজার ঘাটে, হাওয়ায় ভেসে আসছিল ভেজা কাদার গন্ধ আর গঙ্গার জলে তরঙ্গের গুঞ্জন। সেই সময়েই হঠাৎ তার সঙ্গে পরিচয় হলো এক বৃদ্ধ নাবিকের, যার মুখে জড়ানো ছিল বহু বছরের লোনা জলের স্মৃতি। ঝাপসা চোখ, মুখে সাদা দাড়ি,…
-
এক সকালবেলার আকাশে একধরনের হালকা ধূসর আভা, বাতাসে নোনা জল আর কাদার মিশ্রিত গন্ধ। কলকাতা থেকে লঞ্চে নামার পর ছোট্ট এক কাঠের বোটে পা রাখলেন ড. সমীরণ ঘোষ। সরকারি পরিবেশ গবেষণা প্রকল্পের অংশ হিসেবে এবার তাঁর গন্তব্য সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত দ্বীপ—স্থানীয়দের মুখে যার নাম কুমিরদ্বীপ। নদীর ঘোলাটে জলে বোট দুলে উঠতেই তিনি কাঁধের ব্যাগ শক্ত করে ধরে বসেন। বোটের হাল ধরে থাকা মানুষটির গায়ে মলিন ফতুয়া, চোখে চওড়া ফ্রেমের কালো চশমা, মুখে এক অদ্ভুত রুক্ষতা—সে মোক্তার শেখ। সমীরণের হাতে ধরা নোটবুকে দ্বীপের মানচিত্র, কয়েকটি গবেষণা নোট, আর বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণের সরঞ্জামের তালিকা। যাত্রা শুরুর মুহূর্ত থেকেই মোক্তার তাঁকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে লক্ষ্য…
-
পল্লব সেনগুপ্ত বিকেলের আলো ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হয়ে আসছিল, যখন অনন্যা ঘোষ ছোট ট্রলারে করে নদী পার হয়ে পৌঁছাল সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। আশপাশে কেবলমাত্র কাঁকড়াভরা কাদা, উঁচু বাঁধ, এবং জলপথের ওপর একধরনের ঘন স্তব্ধতা—যেটা শহরের মানুষদের অচেনা। অনন্যা কয়েক মাসের জন্য এসেছে এক NGO-র প্রতিনিধি হিসেবে, উদ্দেশ্য—মহিলা ও শিশুদের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। তাঁর হাতে একটা পুরনো নোটবুক, যেখানে কাজের পরিকল্পনা লিখে এসেছে, কিন্তু গ্রামের নিস্তব্ধতা আর হাওয়ার গন্ধ যেন ওই সব কাগজের যুক্তির চেয়েও বেশি বাস্তব। গ্রামের মানুষজন তাকে সম্মান দেখিয়েই স্বাগত জানাল, কিন্তু তাদের চোখে একটা নিরুত্তাপ দূরত্ব ছিল—যেমন কেউ জানে অতিথি বেশিদিন থাকবে না।…
-
তুষার অধিকারী এক আষাঢ় মাসের শেষভাগ। ঘন মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে চিংড়িঘাটের ঘোলা জল থেমে থাকলেও বাতাস কাঁপিয়ে চলেছে। বোটের ইঞ্জিনের একটানা গর্জন ঠেলে, গহীন ম্যানগ্রোভের মধ্যে ঢুকে পড়ছে এক গবেষক দলের চার সদস্য—ড. অদিতি সেন, সম্রাট দে, জয়ন্ত ঘোষ ও স্থানীয় গাইড বীরাজ মুখার্জি। চারপাশে থমথমে নিরবতা। মাঝে মাঝে দূরে শোনা যায় ময়ূরের ডাক, আবার কোথাও চাঁদিয়ালের তীক্ষ্ণ শব্দ। গঙ্গার শাখা নদী ঘেঁষে বোটটা এগোচ্ছে, সঙ্গে করে যাওয়া খাবার, ক্যামেরা ট্র্যাপ, ড্রোন, ল্যাপটপ, আর একরাশ কৌতূহল। অদিতি চোখ মেলে দেখছেন—দু’পাশে যে বন, সেটাকে শুধুই গবেষণার বিষয় বলে মনে করা ভুল হবে। একটা অলিখিত অনুভব যেন সঙ্গী হয়ে এসেছে—এই বনের…
-
দীপায়ন গুহ ১ সুন্দরবনের ঘন সবুজের বুক চিরে চলে যাওয়া সরু জলপথে সকালবেলায় ধোঁয়াশা ছেয়ে ছিল। কেওড়া, গরান আর সুন্দরী গাছের পাতাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে আলো ফোটার চেষ্টা করলেও ঘন কুয়াশার কুন্ডলীতে হারিয়ে যাচ্ছিল সমস্ত দৃশ্য। বন বিভাগের টহল নৌকোটি ঘোলা জলে এগিয়ে চলছিলো—চালকের মুখে গভীর উদ্বেগ। সামনে বসে থাকা বিট অফিসার রবিউল শেখ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল জলের পাশে সদ্য দেখা দেওয়া কয়েকটি বাঘের পায়ের ছাপের দিকে। এই চতুর্থ বার, গত এক মাসে, এই অঞ্চলেই মৃতদেহ মিলেছে বন দফতরের আধিকারিকের, আর এই বার… সেই মৃতদেহটি ছিল তাঁরই বহু বছরের পরিচিত, ডিএফও প্রফুল্ল ঘোষ। গাছে গাছে কাকের চিৎকার, হঠাৎ…