সৌরদীপ ব্যানার্জী পর্ব ১ : থেমে যাওয়া সময় কলকাতার গ্রীষ্ম সন্ধ্যা। শহরের ব্যস্ততা তখনও ফুরোয়নি। কিন্তু শান্তিনিকেতন লেনের পুরনো তিনতলা বাড়িটা যেন অন্য জগতের মতো নিঃশব্দ। চারপাশে কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ, আর ভেতরে জমে উঠছে অস্বস্তিকর হাহাকার। সেই বাড়ির দোতলার পড়ার ঘরে নিথর হয়ে পড়ে আছেন অধ্যাপক অনিরুদ্ধ মুখার্জী—শহরের খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ। তাঁর শরীরটা একপাশে হেলে পড়ে আছে, টেবিলের ওপরে কাগজপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। মাথার কাছে পড়ে আছে একটি হাতঘড়ি—কাঁচ ভাঙা, কাঁটা থেমে আছে রাত ২টা ১৭ মিনিটে। পুলিশ আসে, চারদিক ঘিরে ফেলে। দারোয়ান অশোক ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জানায়— “সার, আমি তো বিকেল সাড়ে চারটের সময় ভেতরে ঢুকে লাশ দেখি। দরজা ভেতর থেকে…
-
-
দেবাশীষ কলিতা অসমৰ সীমান্তৰ ওচৰত অৱস্থিত এক সৰু গাঁও আছিল, যাৰ নাম জনাইতৈ। গাঁওখন ঘন জংঘলৰ কাষেৰে অৱস্থিত, য’ত ডাঙৰ ডাঙৰ বটগছ, শিমুল আৰু তিলচিৰ গছৰ মাজেৰে ৰৌদ্ৰ আৰু ছাঁৱাৰ খেল অবিৰাম চলি থাকে। বহুদিন ধৰি গাঁওখনৰ মানুহে এই জংঘলৰ বিষয়ে বহু কাহিনী শুনিছিল। মানুহে কয়, “এই জংঘলত প্ৰকৃতিৰ ছাঁৱা মাত্ৰেই মানুহক পথভ্ৰষ্ট কৰিব পাৰে,” আৰু “পুৰণি বনৰীয়া আধ্যাত্মিক শক্তিয়ে আনহাতে মানুহক ঢেকি ৰাখে।” এই কথাবোৰ শুনি বহু লোকেই জংঘললৈ যোৱাৰ সময়ত শংকিত হৈ থাকিব। কিন্তু এজনৰ সৈতে সংঘটিত ঘটনা এই জংঘলৰ রহস্যক নতুন দিশত লৈ যায়। গাঁওখনৰ কিছুমান যুৱক আৰু যৌৱনপ্ৰাপ্ত কিশোৰ ক্ৰীড়া আৰু সাহসিকতাৰ উদ্দেশ্যে জংঘললৈ গৈছিল, কিন্তু…
-
১ রাত্রি শহরের উপর নেমে এসেছে একটি নিঃশব্দ কুয়াশার মতো। বাতাসে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে অদ্ভুত এক শীতলতা, যা গলির মোড়, ফুটপাথে, এবং পুরনো ইটের ভবনের দেয়ালে এক অদৃশ্য সুনিপুণ স্পর্শে উপস্থিত। কলকাতার এই উত্তরাঞ্চলের রাস্তা—যেখানে রাতের আলোও নিজেকে পুরোপুরি প্রমাণ করতে পারে না—শীতল বাতাসে ভাসছে। দিকহীন হাহাকার যেন বাতাসে মিশে গেছে; এক সময়কার রঙিন লণ্ঠনগুলো আজ নিঃশব্দ, অন্ধকারে ধীরে ধীরে গলিয়ে যাচ্ছে। অল্প আলো, দূরের হাওয়াই বাতি, এবং খণ্ড খণ্ড কাঁচের জানালার ঝকঝকে আলো মিলেমিশে এক ধরণের রহস্যময় আবহ সৃষ্টি করেছে। পাড়ার পুরনো বাড়িগুলো, যেখানে আগে শিশুদের চিৎকার আর পথচারীর কণ্ঠ শোনা যেত, আজ নিস্তব্ধ; এক অদ্ভুত আতঙ্কের ছায়া…
-
অর্ণব দাশগুপ্ত পর্ব ১: লাল সূচকের সকাল শেয়ার বাজারের দালালদের জীবনকে বাইরের লোকেরা চকচকে ভেবে নেয়। যেন প্রতিদিনই টাকার বৃষ্টি হয়, প্রতিটি ডাকে লেনদেনের ঝলমলে খেলা। কিন্তু ভেতরে যারা থাকে, তারা জানে আসলে কেমন চাপ, কেমন দমবন্ধ করা দৌড়, আর কেমন গোপন ভয়ের সঙ্গে প্রতিদিনের হিসাব মেলাতে হয়। সৌমিক চৌধুরী সেই ভেতরের মানুষ। সবার কাছে সে “সৌমিক দা”—কলকাতার ডালহৌসির এক পুরোনো শেয়ার ব্রোকারেজ অফিসের নির্ভরযোগ্য দালাল। তার হাতে ক্লায়েন্টরা তাদের সঞ্চয় তুলে দেয়, তাদের স্বপ্ন, তাদের ভরসা। আজকের সকালটা শুরু হয়েছিল আশ্চর্যভাবে ভারী এক নীরবতায়। টিভির স্ক্রিনে তখনও বাজার খোলেনি, কিন্তু সূচকের আগে-পরে ছুটে চলা লাল আর সবুজ রেখাগুলো যেন…
-
এক ড. অমিতাভ সেনগুপ্ত ছিলেন দেশের অন্যতম খ্যাতিমান পদার্থবিদ, যিনি সময় ও শক্তি-সম্পর্কিত গবেষণায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নাম কুড়িয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি, উত্তর কলকাতার এক পুরনো দোতলা বাড়ি, যেন বিজ্ঞান আর প্রাচীনতার এক অদ্ভুত মেলবন্ধন—একদিকে আধুনিক ল্যাবরেটরি, অন্যদিকে কাঠের আসবাব, পুরনো বইয়ের তাক, আর দেয়ালে টাঙানো বিরল ঘড়ি। সেই বাড়ির স্টাডি রুমে, এক শীতল নভেম্বরের রাত, পুলিশ এসে দেখতে পেলেন—ড. সেনগুপ্ত মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন, তাঁর ডান হাত ছড়ানো, মুখে এক অদ্ভুত বিস্ময়ের ছাপ। চোখ আধখোলা, যেন মৃত্যুর মুহূর্তে তিনি কিছু দেখেছিলেন যা তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। ঘরের বাতাসে ভাসছে পুরনো কাঠের গন্ধ, জানলার ফাঁক দিয়ে ঢুকছে ঠান্ডা হাওয়া, আর দেয়ালে…
-
প্রিয়ম চক্রবর্তী শরতের শেষ ভাগ, আকাশে তুলোর মতো ভাসমান মেঘ আর বাতাসে ধানের গন্ধ মিশে আছে। কলকাতার ইতিহাসবিদ অনিন্দ্য মুখার্জী ও তাঁর স্ত্রী সায়ন্তী ট্রেনে চেপে যাচ্ছেন বীরভূম জেলার এক অখ্যাত গ্রামে, যেখানে স্থানীয় কলেজে আয়োজিত গ্রামীণ ঐতিহ্য ও লোককথা নিয়ে একটি সেমিনারে বক্তৃতা দিতে হবে অনিন্দ্যকে। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সায়ন্তী ক্যামেরা হাতে ধানক্ষেত, নদীর ধারে চরাচর, আর মাটির ঘরের ছবি তুলছিলেন। তাঁর চোখে গ্রামের সরলতা সবসময়ই এক আলাদা আকর্ষণ রাখে, আর অনিন্দ্যর কাছে লোককথা মানে ইতিহাসের ভেতরে লুকোনো এক অদেখা দরজা। সেমিনার ভেন্যুটি ছিল গ্রামপঞ্চায়েত ভবনের বড় হলঘর, যেখানে বাঁশের মাচা দিয়ে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে, কাগজের…
-
অর্জুন ধর দ্য কল ব্যাক দিল্লির পুরোনো চাঁদনি চকের গলির ভেতরে এক ছোট্ট বইয়ের দোকান। নাম স্মৃতির আড্ডা। কাঠের তাকজোড়া ভরে আছে পুরোনো গোয়েন্দা উপন্যাস, ইংরেজি ক্লাসিক, বাংলার কবিতার বই। দোকানের মালিক অর্ণব সেন—চল্লিশ ছুঁইছুঁই, চশমা পরা, গম্ভীর মুখের মানুষ। তার বুকশপে দুপুরগুলো শান্ত, শুধু পাখির ডাক আর বাইরের যানজটের আওয়াজ ভেসে আসে। কেউ তাকে চিনে না, কেউ জানে না, এই নিরীহ বই বিক্রেতা একসময় ভারতের সবচেয়ে তীক্ষ্ণ গুপ্তচর ছিল। অর্ণবের দিনগুলো কাটছিল সহজেই—সকালে দোকান খোলা, দুপুরে ক’জন ছাত্রছাত্রী আসে নোটস খুঁজতে, সন্ধ্যায় তিনি একা বসে থাকেন। কিন্তু এই শান্তজীবন হঠাৎই ভেঙে দিল এক পুরনো ফোনকল। রাত তখন সাড়ে দশটা।…
-
তমাল দাস ১ কলকাতা, ২০২৫ সালের গরমে দম বন্ধ করা এক সন্ধ্যা। সল্টলেকের এক সরু গলির ভেতরে সাজানো আধুনিক গেমিং ক্যাফেতে তখন ভিড় জমেছে একদল কিশোরের। বাহারি নিয়ন আলো, হেডফোন আর ভিআর হেডসেটের ভেতরে ডুবে থাকা তাদের চেহারায় যেন বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই। ওই ভিড়ের মধ্যেই বসে ছিল অর্ণব, বয়স মাত্র ষোলো। হাত ঘামছে, নিঃশ্বাস দ্রুত হচ্ছে, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত উন্মাদনা—কারণ সে পৌঁছে গেছে গেমের শেষ স্তরে, যেখানে জেতা মানে শহরের গেমার মহলে নায়ক হয়ে ওঠা। স্ক্রিনে ছুটে চলেছে এক ভয়ঙ্কর দানব, তাকে এড়াতে অর্ণব লাফাচ্ছে, দৌড়াচ্ছে, আঘাত করছে। আশপাশের বন্ধুরা উল্লাসে তাকিয়ে আছে, কেউ কেউ মোবাইলে…
-
ঋতা মিত্র পর্ব ১: কাঁচের নাম বিকেলের আলো যেদিন জঙ্গলের কিনারায় ঢালু হয়ে পড়ে, সেদিনই নীলার ক্যামেরা সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকে; যেন আলোটা সরে যাওয়ার আগেই তা ধরে ফেলতে চায়। শহরের উত্তর-পশ্চিমে, পুরনো রেললাইনের পাশে, গলানো টার আর ঘাসের গন্ধমেশানো একটা ফাঁকা জমিতে দাঁড়িয়ে ছিল কবরস্থানটা—চুনসুরকির মলিন রঙ, বুজে থাকা লোহার ফটক, আর তার উপর দিয়ে বুনো লতাগুল্মের চক্রাকার আঁচড়। জায়গার নাম বোর্ডে নেই, মানচিত্রে নেই; তবু গুগল ম্যাপে জুম করলে একটা অচেনা ছোপ, যেন পুরনো দাগের মতো, চোখে পড়ে। নীলা প্রথমে ভেবেছিল বোধহয় এটা একটা ব্যক্তিগত জমি—পুরনো পরিবারের কবরখানা—যেখানে কেউ আসে না, কেবল সময় এসে পড়ে থাকে। কিন্তু লোহার…
-
মায়া মুখোপাধ্যায় পর্ব ১: অদৃশ্য কালি রাত সাড়ে বারোটার পর কলকাতার গলিগুলো এমন এক শ্বাসে ঢুকে পড়ে, যাকে আলাদা করে বোঝানো যায় না— যেন শহরটা এক বিশাল ঘড়ির কেসিং, ভেতরে অদেখা গিয়ারেরা ধীরে ধীরে ঘোরে, আর প্রতিটি ক্লিকের মাঝে কোথাও একটুখানি অন্ধকার জমে ওঠে। সেই অন্ধকারে পায়ের শব্দ মিশিয়ে দ্রুত হাঁটছিল শায়ন্তনী সেন— শহরের ছোট্ট এক সংবাদমাধ্যমের ক্রাইম রিপোর্টার। এক ঘণ্টা আগেই তার কাছে এসে পৌঁছেছে একটি অদ্ভুত খাম— কোন প্রেরকের নাম নেই, শুধু টপাটপ করে বসানো তিনটি কালো ডট, যেন কেউ ইচ্ছা করে বাকিটুকু গিলে ফেলেছে। খামের ভেতরে একটিই কাগজ, তাতে মাত্র এক লাইন: “ঘরের নিশ্বাস শুনতে পেলে বুঝবে…