মালবিকা সেনগুপ্ত ঢাকার ধুলো-ধোঁয়া আর ট্র্যাফিকের চক্রব্যূহ পেরিয়ে যখন জয়িতা নামল মেঘনাঘাটের ছোট্ট ফেরিঘাটে, তখন সূর্য মাথার উপর একচিলতে আগুন হয়ে দাঁড়িয়ে। চারপাশে জনমানবশূন্য প্রান্তর, দুটো হেমন্তের কাক আর কয়েকটা শুকনো পাতার ঝটপট আওয়াজ ছাড়া অন্য কোনও শব্দ নেই। ঠিক এইখানেই সে শুট করবে তার নতুন ট্র্যাভেল ভ্লগ: “Unfiltered Bengal”-এর এক বিশেষ পর্ব। “মোবাইল ডেটা কাজ করছে না? নো টাওয়ার?” – ক্যামেরাম্যান শান্তু মাথা চুলকে বলল। জয়িতা মাথা নাড়ল। ও জানত এই চর অঞ্চলে ঢুকলেই নেটওয়ার্ক ঘুমিয়ে যায়, মানুষের শব্দের চেয়ে নদীর শব্দ বেশি জোরালো হয়। “চর বলরামপুর”, গুগল ম্যাপে মাত্র একটা বিন্দু। কিন্তু সেই বিন্দুর মধ্যে যেন সারা…
-
-
ঋতুপর্ণা চৌধুরী পর্ব ১: সেই দিনের আলো নীলপাহাড়ের গায়ে রোজ সন্ধ্যে নামে অদ্ভুত এক নরম রঙে। যেন আকাশ নিজেই তার ক্লান্তি গায়ে মেখে পাহাড়ের কোলে শুয়ে পড়ে। সেই রঙের নাম কেউ জানে না, কিন্তু ঊর্মির চোখে সে রঙের ছায়া আজও লেগে থাকে, বছর পেরিয়ে গেছে তবু। শিলারি-গাঁওয়ের গায়ে ছোট্ট কাঠের হোমস্টের বারান্দায় বসে সে দিনভর বই পড়ে। কিন্তু বইয়ের পৃষ্ঠায় শব্দগুলো যেন আবছা হয়ে আসে — যেন বই পড়ছে না, বরং অতীতের পাতাগুলোতেই বারবার হারিয়ে যাচ্ছে। তিন বছর আগে ঠিক এই জায়গাতেই প্রথম দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে — অয়ন। অয়ন, পুরো নাম অয়ন সেনগুপ্ত, ছিল উত্তর কলকাতার ছেলে। পলিটেকনিক কলেজে…
-
সৃজন ঘোষ পর্ব ১ — শিবু কাকার দোকান ওরা দুজন দুটো আলাদা অফিসে কাজ করে। আলাদা ভবন, আলাদা ফ্লোর, আলাদা ম্যানেজার, আলাদা টাইমশিট—কিন্তু বিকেল তিনটা পঁচিশে দুজন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ে একটাই জায়গায়—শিবু কাকার চায়ের দোকানে। হ্যারিসন রোড আর ব্যাঙ্কশাল স্ট্রিটের সংযোগস্থলে ছোট্ট এক টিনের ছাউনি, তিনটে লাল চেয়ার, একটা কেরোসিন স্টোভ, আর একটা চুন-ছোপ খাওয়া কাঠের বেঞ্চ। এখানেই তুলি রোজ বিকেলে আসে মাথার ব্যথা সারাতে, আর রুদ্র আসে… আগে হয়তো কেবল চায়ের জন্যই আসত, এখন সে নিজেও জানে না ঠিক কেন আসে। তুলির অফিস ‘ইমার্জ ইভেন্টস’-এর তিনতলায়। একঘেয়ে মিটিং, থিম-পিচ, ক্লায়েন্ট ব্রিফ আর ইনস্টাগ্রামের ক্যাপশন নিয়ে সকাল থেকে বেলা পার…
-
ঋদ্ধিমান দাশ পর্ব ১: কাগজের পাতা, ধোঁয়ার রেখা ক্যাফে কুয়াশার দরজায় টাঙ্গানো পুরনো ঝোলানো ঘণ্টাটা বাজল, আরোহী ঢুকল ধীরে, একহাতে ব্যাগ, অন্য হাতে ফোন। অফিস থেকে সরাসরি আসছে, মাথাটা কেমন যেন ভারী, দিনের ঝাপসা ক্লান্তি তাকে গিলে খেতে চাইছে। কিন্তু এই ক্যাফেটার ভেতরটা যেন অন্যরকম—জানলার কাচ দিয়ে বিকেলের আলো এসে পড়ছে সোনালি ছায়ায়, দেওয়ালে ঝোলানো বইয়ের কভার আর পুরনো বাংলা গানের পোস্টার। তার প্রিয় টেবিলটা—ডান দিকের কোণারটা—আজ খালি। সে বসে, ব্যাগটা পাশে রাখে। ওয়েটার রাজু এসে জানতে চায়, “দিদি, এক কাপ স্পেশাল দার্জিলিং আর কালচার্ড বিস্কুট দেব?” “হ্যাঁ, আর একটা গরম জল দিও, মাথা ধরেছে,” বলে সে, চোখ বন্ধ করে…
-
প্রীতম ১ শিয়ালদহ স্টেশনের বিকেলের চেনা ব্যস্ততা। প্ল্যাটফর্ম নম্বর পাঁচে লোকাল ট্রেন এসে দাঁড়ালে যে শব্দটা ওঠে—লোকের হাঁটার, announcements-এর কণ্ঠস্বর, ভ্যাপসা গরমে বাতাসের কম্পন—সেইসব কৌশিকের কাছে নতুন কিছু নয়। গত ছয় মাস ধরে, রোজ এই সময়েই, সে দাঁড়ায় একই জায়গায়—একটা পুরনো চায়ের দোকানের পাশের হলুদ রঙের খুঁটির সামনে। তার রুটিন প্রায় যন্ত্রের মতো: অফিস থেকে বেরিয়ে ট্রাম ধরে স্টেশন, তারপর সেই নির্দিষ্ট কোচে উঠে বাড়ি ফেরা। কিন্তু আজ কৌশিকের মন একটু অস্থির। সে ঠিক জানে না কেন। হয়তো কারণ, গত তিন দিন ধরে সে যার মুখ খুঁজছিল, সেই মেয়েটিকে দেখতে পাচ্ছে না। মেয়েটির নাম জানে না কৌশিক। তারা কোনোদিন কথাও…
-
ঋতুপর্ণা বসু শীতের দুপুরে শীত তখন শহরের কাঁধে নেমে বসেছে। কলেজের লাইব্রেরির বাইরের কাঠের বেঞ্চে বসে ছিল অনিরুদ্ধ। তার পরনে ছিল ধূসর সোয়েটার, গলায় মাফলার, আর হাতে ছিল একটিমাত্র বই—জীবনানন্দ দাশের কবিতা। সে বইটা যেমন ছিল, তেমনই তার মনটাও—অদ্ভুত নিঃশব্দ, সময়ের গন্ধ মাখানো। বইয়ের পাতায় চোখ ছিল, কিন্তু মন ছিল বইয়ের বাইরের জগতে। প্রতিদিন বিকেলে লাইব্রেরির সিঁড়ি দিয়ে যে মেয়েটা নামে, আজও সে ঠিক সময়মতো নামছে। তার নাম প্রভা। ছিমছাম পরিপাটি সাজ, নীল-সাদা শাড়ি, কানে ছোট্ট ঝুমকা। চোখে এক অদ্ভুত আভা, যেন কোনো কথা না বলেই সে অনেক কিছু বলে যেতে পারে। অনিরুদ্ধ বহু দিন ধরেই তাকে লক্ষ করে, কিন্তু…
-
পল্লব দাস এক রোদ ফোটার আগেই ঘুম ভেঙে যায় বেণীমাধবের। দোকানের পাশেই তার ছোট্ট এক কামরা, সেখানেই শুয়ে শুয়ে ভোরের পাখির ডাক শোনেন তিনি। প্রতিদিনের মতো আজও সকালটা এক অদ্ভুত মায়ায় মোড়া—মৃদু কুয়াশা, রোদ উঠবার মুখে, আর দূরের ফুলের গাছগুলো থেকে ভেসে আসা একরাশ সুবাস। দোকানটা খুব বড় নয়। বাঁশ আর টিনের চালের ছোট্ট ঘর। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় যেন কোনো মেলার অস্থায়ী দোকান। কিন্তু বেণীমাধবের কাছে এটা তার জীবনের চেয়ে বেশি। “ফুলের দোকান”—নামটা সেভাবে কেউ দেয়নি, শুধু একটা ছোট কাগজের বোর্ডে হাতে আঁকা ‘ফুলের দোকান’ লেখা। দোকানজুড়ে সারি সারি ফুলের ঝুড়ি—রজনীগন্ধা, বেলি, জুঁই, গাঁদা, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, অর্কিড—যেন রঙের…
-
ঈশিতা সেনগুপ্ত জানলার ওপারে কলকাতার উত্তরের এক পুরনো পাড়ায়, লাল ইটের তিনতলা বাড়িটা বহু দিনের সাক্ষী। উঠোনজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পুরনো ফুলদানি, জং ধরা বাইসাইকেল, আর সবথেকে দৃষ্টিনন্দন—একটা ঘন পাতা কদমগাছ। সেই গাছের নিচে প্রতিদিন সকালে বসে এক ছেলেটা, তার কোলে একটা স্কেচবুক, হাতে পেন্সিল—নিস্তব্ধ ঘোরে ডুবে যায় নিজের আঁকায়। ছেলেটির নাম অয়ন। অয়নের জীবনের ছন্দ বড়ো একঘেয়ে ছিল। আঁকাআঁকি আর কদমগাছের নিচে বসে থাকা ছাড়া সে খুব একটা কারো সঙ্গে মেশে না। পড়াশোনার দিন পেরিয়ে, সে এখন ঘরে বসেই গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করে। পাড়ায় বহুদিনের বাসিন্দা, তাই কারও চোখে নতুন নয়। তবে হঠাৎ করেই সব বদলে গেল, যেদিন জানালায় সে…