সৌমিতা রায় শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের সকাল যেন মাটির গন্ধ, রঙের খেলা আর সুরের মায়ায় মোড়া এক অলৌকিক প্রভাত। ফাল্গুনের হাওয়া যেন হাতের তালুর মতো কোমল, তবু তার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক ধরণের উচ্ছ্বাস যা আকাশের নীলকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। আঙিনায় গাছের গায়ে গায়ে হলুদ-কমলা ফুলের মালা ঝুলছে, পথের ধারে আলপনার নকশা, আর সকালবেলার আলোতে লাল মাটির পথ যেন আরও গাঢ় রঙে রাঙিয়ে উঠেছে। কিরণময়ী বাবার দোকানে বসে রঙিন পোড়ামাটির গয়না সাজাচ্ছে—গোলাপি আর সবুজ রঙের কানের দুল, মাটির মালা, ছোট ছোট পায়েলের মতো নকশা করা ব্রেসলেট। বাবার হাতে তৈরি গয়নার উপর তার নিজের আঁকা নকশা উৎসবের ক্রেতাদের চোখে আলাদা করে…
-
-
অভিষেক মজুমদার ১ কলকাতার ব্যস্ত নাগরিক জীবনের কোলাহল থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরে শান্তিনিকেতনের উপকণ্ঠে ছোট্ট একটি গ্রাম। নাম তার—চৌরঙ্গীডাঙা। বাইরে থেকে এ গ্রাম দেখতে সাধারণ, কাঁচা রাস্তা, ধানের ক্ষেত, গরুর গাড়ি, বিকেলের আড্ডায় চায়ের দোকান, মেলার সময় পুতুলনাচ বা বাউল গান। কিন্তু এই গ্রামকে ঘিরে এক অদ্ভুত গল্প বহুদিন ধরে চলে আসছে, যা শুনে আশেপাশের গ্রামও শিহরিত হয়ে ওঠে। কথিত আছে, বর্ষা নামার আগে, বিশেষ করে আষাঢ় মাসের শেষ রাতে গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তের বাঁশবনে এক অদ্ভুত আচার হয়। সেই বাঁশবন খুব পুরোনো, অন্ধকারাচ্ছন্ন, সূর্যের আলোও সেখানে খুব বেশি প্রবেশ করে না। দিনের বেলায় সাধারণ মনে হলেও রাত নামলে তার…
-
ইরা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্ব ১ – প্রথম আলাপ কলকাতার শরৎকাল। পুজোর ভিড়, আলোয় মোড়া রাস্তা, প্রতিটি মোড়ে মোড়ে উলুধ্বনি আর ঢাকের তালে কেঁপে উঠছে শহর। অভ্রর মাথাটা অদ্ভুতভাবে ভারী লাগছিল। সে এক নামী বিজ্ঞাপন সংস্থার ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর। সারা বছর ধরে ক্লায়েন্টের চাপ, ডেডলাইনের ঝড়, কনসেপ্ট নিয়ে মিটিং আর টেনশনে ভরা রাতজাগা তার জীবনের রুটিন হয়ে উঠেছে। তবুও দুর্গাপুজো এলে কেমন এক ধরণের হাওয়ার পরিবর্তন হয়—শহর যেন অদৃশ্য আনন্দে ভেসে ওঠে। সেদিন ছিল ষষ্ঠীর সন্ধ্যা। অভ্র অফিস থেকে বেরিয়ে এক বন্ধুর টানে গেল ঢাকুরিয়ার কাছে এক বনেদি পরিবারের বারোয়ারি পুজো দেখতে। আলো, আলপনা, মণ্ডপে ঢোকার গেট—সবকিছুই যেন চমকপ্রদ। অথচ অভ্রর মন খারাপ।…
-
অর্পিতা সেনগুপ্ত ১ ২০২৫ সালের বসন্তকাল। শান্তিনিকেতনের কাঁচা রাস্তার ধুলো তখনো শীতের শেষ হাওয়ায় হালকা হয়ে উড়ছে, আর কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোতে ফুটতে শুরু করেছে লালচে ফুল। ভোরবেলা গ্রামের পূর্বদিকে হঠাৎ যেন এক অচেনা কোলাহল নেমে আসে। কাঁচা রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে ঢুকে পড়ে কয়েকটি বড় ট্রাক—কেউ বহন করছে বিশাল আলো ঝোলানোর স্ট্যান্ড, কেউ বা কাঠের বাক্সে ভরা অদ্ভুত যন্ত্রপাতি। সঙ্গে রঙিন কভার দিয়ে ঢাকা পোশাকের গাড়ি, আরেকটিতে খাবারের সরঞ্জাম। কয়েকজন লম্বা বিদেশি, গলায় ক্যামেরা ঝুলানো, আর চওড়া টুপিওলা কর্মীরা নামতেই গ্রামের শিশুরা কৌতূহলী চোখে ভিড় জমায়। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা খেজুর গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে, “ওরা নাকি সিনেমা তুলবে।” শ্যামলী দত্তের হোমস্টের উঠোন তখন…
-
সিদ্ধার্থ দে ১ শান্তিনিকেতনের ভোরবেলার আলোয় সবকিছু যেন অন্যরকম লাগে। কলকাতার ধূসর আকাশ, ধোঁয়া আর হর্নের ভিড় থেকে অনেক দূরে এই ছোট্ট শহরের গন্ধ আলাদা—সেগুনপাতার, শিউলির, আর লালমাটির ধুলো মিশে থাকা সেই গন্ধ। ঋজু বন্দ্যোপাধ্যায়ের শৈশব এই গন্ধের ভেতরেই কেটেছে। বাবা-মা কলকাতায় চাকরি করলেও পড়াশোনার সুবিধা আর নিরাপত্তার জন্য ঋজুকে রেখে গিয়েছিলেন দিদিমা অঞ্জনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। অঞ্জনার ছিল এক ধরনের নিঃশব্দ শক্তি—তিনি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষিকা, যিনি দিনের বড় অংশটাই কাটাতেন পড়ার টেবিলে বা হাতের কাজ নিয়ে। শীতের বিকেলে উঠোনে পিঁড়ি পেতে বসে হাতে সুই-সুতো নিয়ে কাজ করতেন তিনি, আর ঋজু এক পাশে বসে হয়তো বই পড়ত, নয়তো দিদিমার সেলাই করা…
-
অর্কদীপ ঘোষ ১ আষাঢ়ের এক শেষ বিকেল। ধূলিধূসর রাস্তা পেরিয়ে রাধিকার গাড়ি এসে দাঁড়াল শান্তিনিকেতনের এক পুরনো বাড়ির সামনে—দোতলা, লালমাটির ধুলোয় লেপা উঠোন, চারপাশে পেঁচিয়ে ওঠা মাধবীলতা আর ঘন পাতা গন্ধরাজ গাছের ছায়া। জানালার গরাদে কাঁটা লতাভরা স্মৃতি আটকে আছে, যেন কেউ সময়কে ছেঁচে রেখে দিয়েছে ওই দেয়ালের ফাটলে। এক সময় এই বাড়ির প্রতিটি কোণা তার চেনা ছিল—দাদুর বইয়ের আলমারি, মামিমার হাতের লুচির গন্ধ, আর উঠোনের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই বিশাল গন্ধরাজ গাছ, যার তলায় একদিন ঋষভ দাঁড়িয়ে বলেছিল, “তুই চলে যাবি তো ঠিকই, কিন্তু এই গন্ধটা থেকে যাবে। জানবি আমি কাছে আছি।” আজ বছর তেরো পর রাধিকা সেই…
-
মৈনাক দত্ত আখড়ার প্রথম আলো শান্তিনিকেতন ছাড়িয়ে কাঁকরপথ ধরে যত এগোয় প্রীতম, ততই যেন শব্দ কমে আসে, গন্ধ বাড়ে। মাঠে বাতাসে ধানগাছের ঘ্রাণ, পাখিরা গানের মতো ডাকছে, আর মাঝে মাঝে কোনো অজানা সুর কানে বাজে—কোনো একতারা, না কি সময়ের ধ্বনি, বোঝা যায় না। প্রীতম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। বিষয়—“বাউল দর্শনে দেহতত্ত্ব: এক সমকালীন পাঠ”। থিসিস লিখছে, কিন্তু বই পড়া আর কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করে তার মন ভরে না। সে চায় ছুঁয়ে দেখতে, শ্বাস নিতে। তাই এসেছে শান্তিনিকেতনের কাছের এই অখ্যাত বাউল আখড়ায়, নাম ‘উত্তরের পথ’। পৌঁছাতেই প্রথম যে জিনিস চোখে পড়ে, তা হল একটা তুলসী গাছ। উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে শান্ত, স্থির।…