অনিন্দ্য দে ১ গ্রামের রাত সবসময়ই শান্ত, বিশেষ করে শীতের শেষে ফাগুনের সন্ধ্যায় যখন চারপাশে পেঁচা ডাকে আর দূরে কোথাও শেয়ালের ডাক ভেসে আসে। সেদিনও তেমনই এক রাত। আকাশে চাঁদ নেই, শুধু অন্ধকারের চাদর মাটিকে ঢেকে রেখেছে। দূরে দূরে ক্ষেতজমির মাঝে জোনাকিরা আলো জ্বালাচ্ছিল ক্ষুদ্র প্রদীপের মতো। গ্রামের লোকেরা তখন গভীর নিদ্রায়, কেবল কয়েকজন কৃষক কাজের ফাঁকে রাত জেগে বসেছিল মচানঘরে। হঠাৎই নিস্তব্ধতার বুক চিরে ভেসে এল এক অদ্ভুত শব্দ—শাঁখের আওয়াজ। শাঁখ বাজানোর সেই সুর গ্রাম্য পূজার সময় সবাই শুনেছে, কিন্তু আজকের সেই সুর ভিন্ন ছিল—অত্যন্ত দীর্ঘ, করুণ আর বেদনায় ভরা। কৃষকরা প্রথমে ভেবেছিল হয়তো কোনো বাড়িতে পূজা চলছে, কিন্তু…
-
-
অনিৰ্বাণ সেনগুপ্ত ১ কলকাতার গঙ্গার ধারে সন্ধ্যার পরই এক অদ্ভুত আবহ ছড়িয়ে পড়ে। দিনের ব্যস্ততা, মালবোঝাই বার্জের হর্ন, নৌকার ভিড় আর ঘাটের চেঁচামেচি—সব মিলিয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত জায়গাটা থাকে কর্মচঞ্চল। কিন্তু সূর্য নামলেই চেনা ছবিটা ধীরে ধীরে বদলে যায়। ঘাটের ধারে বসে থাকা চায়ের দোকানদার আলো নিভিয়ে বাড়ি ফেরে, কাঁকড়া বা ছোট মাছ বিক্রির টাটকা হট্টগোল স্তব্ধ হয়ে যায়, আর গঙ্গার কালো জল যেন আরও ঘন হয়ে ওঠে। সেই অন্ধকারেই দাঁড়িয়ে থাকে পুরনো ব্রিটিশ কবরস্থান—ধূসর পাথরের ক্রস, শেওলা ধরা সমাধিফলক আর আধভাঙা গম্বুজওয়ালা সমাধি। কবরগুলোর চারপাশে রাত নামলেই এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি পাহারা দিচ্ছে। যারা প্রতিদিন…
-
তনয়া সেন বিকেলের শেষ আলোয় যখন সূর্য পাহাড়ের গায়ে ধূসর হয়ে গলে আসছিল, তখনই অরণ্যের বাস এসে পৌঁছল ছোট্ট গ্রামটায়। বাস বলতে আসলে একটা পুরোনো মিনিবাস, জানালার কাচ ঝাপসা, সিটের চামড়ায় ফাটল। গাঁয়ের নাম রাধাপুর—এমন নাম মানচিত্রে খুঁজলেও পাওয়া মুশকিল। তবু অরণ্যের মতো ফটোগ্রাফারের কাছে এই জায়গার টান ছিল অন্যরকম। শহরের কোলাহল, নামজাদা প্রকল্প, নামী রিসর্ট নয়—বরং অচেনা, অনাবিষ্কৃত জায়গার মধ্যে লুকোনো প্রকৃতির ছবি তুলতে তার সবচেয়ে ভালো লাগে। অরণ্যের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা ভারী, ভিতরে ক্যামেরা, লেন্স, ত্রিপড আর কিছু নোটবুক। বাসস্ট্যান্ডে নেমে চারপাশে তাকাতেই সে বুঝল, এই গ্রাম যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচা রাস্তা, খড়ের চালের ঘর, বাচ্চাদের…
-
অভ্রজ্যোতি সেন ১ সকালবেলা কলকাতার হাওড়া ঘাটে জমে উঠেছিল এক অদ্ভুত রকম উত্তেজনা। পা ছুঁয়ে চলা কুয়াশার ফাঁক দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল একটি বড় ট্রলার, যার মাথায় লটকে থাকা লাল কাপড় বাতাসে কেঁপে উঠছিল। রুদ্র সেনগুপ্ত, ক্যামেরা ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, চোখে ছিল অদ্ভুত এক আলোকছায়ার খেলা। তার চোখে যেন শুধুই দ্বীপ, শুধু রহস্য। এই ডকুমেন্টারি তার জন্য শুধু পেশাদার প্রজেক্ট নয়, বরং এক অদ্ভুত টান—অজানা কিছুর ভিতরে পা ফেলার খিদে। তার সঙ্গেই ছিল ক্যামেরাপার্সন মৃণালিনী পাল—সবাই মিরা বলে ডাকে। চোয়াল শক্ত, চোখে নির্ভীকতা, যেন জঙ্গলও তাকে ভয় পায়। অর্কদীপ সাহা, যাকে সবাই অর্ক নামে জানে, সদা চঞ্চল, সাউন্ড রেকর্ডারের…
-
অদ্রিজ লাহিড়ী ১ নতুন বছরের প্রথম সকালটা যেন অলিখিত এক দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে এল জলপাইগুড়ির ছোট্ট শহরতলি এলাকায়। চারদিকে কুয়াশার ঘন চাদরে ঢাকা, গাছের পাতা থেকে জলের ফোঁটা টুপটাপ পড়ছে, আর দূরে কোথাও একটি কাঠঠোকরার ডাক শোনা যাচ্ছে। সকাল ছ’টার সময় বাজারে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়েছিলেন তুষার দে’র কাকা, সুশোভন দে। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। প্রথমে তুষার ভেবেছিল, হয়তো কাকা পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে চলে গেছেন, কিংবা ফোনের ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেগ ঘনিয়ে আসে। কাকার মোবাইল বন্ধ, বাজারের দোকানিরা বলে, তাঁরা তাঁকে দেখেইনি। আশেপাশে খোঁজ করতে গিয়ে মা একসময় বললেন, “আবার কী ১…
-
পুরুলিয়ার দিকে রওনা দেওয়ার সময় কলকাতার আকাশ ছিল রৌদ্রঝলমলে, কিন্তু দলের ভিতরে যেন এক চাপা উত্তেজনার ঘূর্ণি চলছিল। রুদ্র, অভিজিৎ, ইরা আর সঞ্জনা – এই চারজনের দলটার নেতৃত্বে ছিল রুদ্র, একজন বাস্তববাদী ডকুমেন্টারি নির্মাতা যিনি সব কিছুকে যুক্তির চোখে দেখতে অভ্যস্ত। তবু এই বিশেষ প্রজেক্টটা ছিল অন্যরকম – কারণ এটি ছিল একটি পরিত্যক্ত আদিবাসী গ্রামের লোককাহিনি নিয়ে, যেখানে কথিত আছে, পূর্ণিমার রাতে মৃতরা উঠে আসে মাটির নিচ থেকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, তারা পুরুলিয়ার এক গভীর শালবনের ভেতর অবস্থিত জামদা নামের একটি গ্রামে যাবে – একটি গ্রাম যা দীর্ঘদিন আগে উধাও হয়ে গেছে, যেখানে আর কেউ থাকে না, অথচ গ্রামের গল্প আজও…
-
ঋতব্রত সেন [১] জুলাইয়ের এক মেঘলা দুপুরে মিহির তার ঠাকুরদার পুরনো কাঠের আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, যেখান থেকে ধুলোমাখা বই আর ভাঙা পুতুলের গন্ধ ভেসে আসছিল। ঠাকুরদা, বিশ্বেশ্বর পাল, এককালে ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন—তার চোখে এখনও সেই অতীতের আলো জ্বলে। মিহির ছুটির দিনে তার কাছ থেকে নানা কাহিনি শুনতে ভালোবাসত, বিশেষ করে কৃষ্ণনগরের পুতুলশিল্প ও রাজাদের গোপন ইতিহাস। সেই দিন, যখন বৃষ্টি বাইরের দিগন্ত ঘিরে রেখেছিল, ঠাকুরদা হঠাৎ এক গল্প শুরু করলেন—একটা পরিত্যক্ত বাড়ির, যেটি সবাই ‘পুতুলবাড়ি’ বলে চিনত। সেই বাড়ি নাকি এক কালে ছিল রামানন্দ পাল নামের এক পুতুলশিল্পীর, যিনি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের দরবারে কাজ করতেন। কথিত আছে, রাজপরিবারের গুপ্তধন…
-
অভ্র মিত্র অধ্যায় ১: অমাবস্যার আগে শ্যামনগর—পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এক নিঃস্তব্ধ গ্রাম, যেখানে রাত নামে আগেভাগেই আর কুকুর ডাকে না। চারদিকে যেন অদৃশ্য কিছু চেপে বসে, হাওয়া নিঃশব্দ হয়, আর মাটির ঘরের জানালার কাঁচে প্রতিফলিত হয় না কোনও আলো। অমাবস্যা ঘনিয়ে এলে গ্রামের জীবন থমকে যায়, শিশুদের মুখে হাঁসি থাকে না, আর মায়েরা বাচ্চাদের চোখে কাজল পরে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, যেন অজানা কিছু চোখে না পড়ে। শতবর্ষ আগের কথা, এক চণ্ডীপাঠের মঞ্চে নাকি অদ্ভুত এক যজ্ঞ হয়েছিল, যেখান থেকে এক আগুন উঠে পুরো মন্দির গ্রাস করে নেয়। তখন থেকেই চণ্ডীমণ্ডপ ধ্বংসপ্রাপ্ত, আর ওই দিনটিকেই অনেকে গ্রাম ইতিহাসের বিভীষিকা বলে চিহ্নিত করে।…
-
অদ্রিজ দাশগুপ্ত বিকেলের রোদ যেন পাকা শালপাতার মতো গায়ের ওপর নেমে এসে বসে ছিল। আজনা গ্রামের রেলস্টেশনটি ছিল খুব ছোট, একটা মাত্র প্ল্যাটফর্ম, তাও অর্ধেকটা ঘাসে ঢাকা। কলকাতা থেকে লোকাল ধরে এসে নামল নয়ন দত্ত—একটা পুরনো রঙচটা ব্যাগ কাঁধে, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, আর ঠোঁটের কোণে একরকম দ্বিধা। ট্রেনটা চলে গেল ধোঁয়ার লেজ রেখে, আর নয়ন একবার ঘড়ি দেখল—বিকেল চারটে দশ। রিকশা নেই, টোটো নেই, সামনে মাঠের ধার দিয়ে কাঁচা রাস্তাটা নেমে গেছে গ্রামের দিকে। সে একটু থেমে ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে কপালে ঘাম মুছে নিল। এই গ্রামের নাম আজনা—সে অনেক দিন আগে একবার এসেছিল, খুব ছোটবেলায়। তখন তার মা…
-
অরিজিৎ দে পর্ব ১: কুসুমবাড়ির ডাইনি পাহাড়ের কিনারে ছুঁয়ে বইছে জলঢাকা নদী। নদীর পাড়ে একটা গ্রাম—ছোট্ট, চুপচাপ, নাম তার কুসুমবাড়ি। দিনের বেলা গাছেদের ছায়ায় এখানে শিশুরা খেলে, বুড়োরা বিড়ি টানে আর মহিলারা কলতলায় গান ধরে। কিন্তু রাত নামলে? রাত নামলে কুসুমবাড়ি নিঃশব্দ হয়ে যায়। যেন কেউ বা কিছু পুরো গ্রামটাকে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেয়। এই কুসুমবাড়িতেই এসেছেন কমলিনি বসু। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি লোককাহিনি নিয়ে গবেষণা করছেন। তার বিষয়—“উত্তরবঙ্গের নারী-কেন্দ্রিক অপ্রাকৃত লোককাহিনির সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ।” বলতে গেলে, ভূতের গল্প নিয়ে গবেষণা। কিন্তু তিনি বলেন, “আমি গল্প খুঁজি, ভূত না। গল্পের পেছনে লুকিয়ে থাকা সমাজকে দেখাই আমার কাজ।” গ্রামে পৌঁছে তাকে নিয়ে যাওয়া…