বিভাস সেনগুপ্ত এক নীলয় রায় জানালার ধারে বসে ছিল ট্রেনের কামরায়, মাথায় হেডফোন, চোখ দু’টো দৃঢ়ভাবে বাইরে, কিন্তু মন দূরে, একেবারে অন্যখানে। বাইরের কুয়াশায় ঢাকা দৃশ্যপট যেন তার ভেতরের অস্পষ্ট অনুভূতিগুলোরই প্রতিচ্ছবি ছিল। তার ব্যাগে একটি Nikon DSLR, দুটি লেন্স, একটি নোটবুক আর মুঠোফোন ছাড়া তেমন কিছু ছিল না। কলকাতা শহরের কোলাহল থেকে পালিয়ে সে চলেছে পুরুলিয়ার দিকে—এইবার শুধু একটি প্রজেক্টের জন্য নয়, বরং নিজের ভেতরের এক চাপা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য। সে শুনেছিল শঙ্খ নদীর পাড় ঘিরে একটি লোককথা—“নদী নাকি কথা বলে, যদি তুমি কান পেতে শোনো।” শহুরে যুক্তিবাদী মানুষদের কাছে হয়তো এসব নিছক রূপকথা, কিন্তু নীলয়ের কাছে…
-
-
শ্রীজিত সাহা অধ্যায় ১: হাটের হদিস কলকাতার গাঢ় ধূসর সকালে শহরের বুক চিরে যখন শরদ রায় তাঁর পুরনো অ্যাম্বাসাডার গাড়ি নিয়ে রওনা দিলেন, আকাশে তখনও কুয়াশার বৃষ্টি লটকে ছিল। পেছনের সিটে রাখা ছিল একটি ধুলোমাখা ক্যামেরা, নোটবই, এবং বছর তিরিশেক পুরনো বাংলার লোকশিল্প বিষয়ক একটি জীর্ণ বই। শরদ একজন খ্যাতনামা শিল্প সংগ্রাহক হলেও তাঁর সংগ্রহ মানেই কেবল গ্যালারির ঝকঝকে ফ্রেম বা বিদেশ থেকে আনা মিনিয়েচার নয়—তিনি খোঁজেন মাটির গন্ধে মাখা হারিয়ে যাওয়া শিল্প, লোকজ ঐতিহ্য। আর তাই আজ তিনি চলেছেন নদিয়ার ধারের এক প্রাচীন গ্রামে, যেখানে প্রতি বছর বসে “মারগাঁ হাট”—এক আশ্চর্য হাট, যেখানে লোকশিল্পীরা নিজেদের সৃষ্ট পট, মুখোশ, মাটির…
-
অমৃতা রায় চৌধুরী অধ্যায় ১: কলকাতার উত্তরপ্রান্তের এক মফস্বলি ফ্ল্যাটের বারান্দা ধরে ছড়িয়ে পড়া সকালের আলোয় বসে ছিল অর্ণা সেনগুপ্ত, হাতে ছিল এক কাপ লিকার চা আর চোখ ছিল ল্যাপটপের স্ক্রিনে আটকে থাকা। তার চোখে লালচে রেখা, সারারাত ঘুম হয়নি ঠিকঠাক—নিউজরুমের মধ্যরাতের মিটিং, তার পরে হঠাৎ করে সিনিয়র এডিটরের একটি নির্দেশ—“ঝাড়খণ্ডে একটা মেয়ের মৃত্যুর খবর এসেছে, গ্রামবাসীরা বলছে ডাইনি, কিন্তু তুই গিয়ে দেখে আয়। কিন্তু এবার শুধু নিউজ রিপোর্ট নয়, আমি চাই এক্সপোজে—তুই পারবি।” অর্ণা পারবে না? অর্ণা জানে, এই সমাজ কিভাবে নারীর অস্বাভাবিকতা বা স্বাধীনতা দেখলেই তাকে ‘ডাইনি’, ‘অশুভ’, বা ‘অতিমাত্রায় শক্তিশালী’ বলে আখ্যা দেয়। কিন্তু সাংবাদিকতা মানে কি…
-
তনুশ্রী বসাক অধ্যায় ১: জন্মের অশনি নীলডিহি গ্রামের পূর্বপাড়ার শেষে, একটি জরাজীর্ণ কুঁড়ে ঘর। শিউলি ফুলের গাছ তার সামনের উঠোনে ঝুঁকে পড়েছে, আর ঘরের ভিতর থেকে এক আর্তনাদ ভেসে আসছে—এক প্রসূতির কষ্টকর আর্তি। গ্রামের বয়স্কা ধাইমা চৈতালী বুড়ি দরজা বন্ধ করে ভেতরে নিঃশব্দে কাজ করছে। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে দু-তিনজন নারী, চোখে ভয়, কানে হাওয়ায় ভেসে আসা শতাব্দী পুরনো গুজবের প্রতিধ্বনি। আজকের এই জন্ম আলাদা। ঠিক একশো বছর পর আবার সেই অমঙ্গল বার্তাবাহী ‘শঙ্খচক্ষু কন্যা’ জন্ম নিচ্ছে — এমনটাই বলছে লোককথা। সন্ধ্যা নামছে, তালগাছের মাথায় দাঁড় টেনে সূর্য ডুবে যাচ্ছে পশ্চিমে, আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এক নবজাতকের…
-
তন্ময় পাল ঘটনাটা শুরু হয়েছিল বর্ষার ঠিক আগের সময়ে, যখন আকাশ সারাদিন ধরেই ঝিম মেরে থাকে আর বাতাসে একটা ভিজে মাটির গন্ধ হালকা হালকা দোলা দেয়। আমি, শীর্ষ, তখন সদ্য কলেজে উঠেছি। আমার বাবা একজন পুরাতত্ত্ববিদ, মাটি খুঁড়ে ইতিহাসের হাড়গোড় জোগাড় করাই তার কাজ। সেবার বাবার এক বন্ধুর আমন্ত্রণে আমরা গেলাম নদিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে, নাম—চৌবাগান। গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা ভাঙাচোরা খাজাঞ্চিঘর, যেখানে ব্রিটিশ আমলে নাকি রাজবাড়ির সম্পদ রক্ষিত থাকত। সেই ঘরটা নিয়েই যত রহস্য। আমরা যে বাড়িটায় উঠলাম, সেটা ছিল একটা পুরোনো বনেদি দোতলা, লাল ইটের দেয়াল, আর জংধরা লোহার দরজা। ঘরের চারদিকে ঘন অশ্বত্থ আর পাকুড় গাছ, আর…
-
সিঞ্জিনী চক্রবর্তী আগমন নদিয়ার চন্দ্রপুর গ্রামটা সময়ের দিক থেকে যেন অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। শহরের তুলনায় এখানে সময় যেন একটু ধীরে চলে। দিনগুলো এখানে বড় শান্ত, নিঃসঙ্গ; সন্ধ্যা নামতেই ঘরবাড়ির দরজা জানলা বন্ধ হয়ে যায়, কুকুরের ডাকে চমকে ওঠে মানুষ। গ্রামটা যেন নিজেই একটা দীর্ঘশ্বাস। পাকা রাস্তা নেই, মোবাইল টাওয়ারের সংকেত আসে-যায়। চায়ের দোকানে বিকেলের আড্ডাও যেন কেমন নিরুত্তাপ। আর সন্ধ্যে নামলেই চারপাশে এমন এক নীরবতা নামে, যেন শব্দ করাটাই পাপ। এই চন্দ্রপুর গ্রামেই আসে রক্তিম সেন—কলকাতার যুবক, ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের ছাত্র। সে আসছে তার মামাবাড়িতে, গরমের ছুটির জন্য। পুরনো দিনের মতো চিঠি বা ফোন করে নয়, হঠাৎ করেই একদিন চেপে…