অর্পণ মিত্র অধ্যায় ১ – প্রথম ফোঁটা কলকাতার আকাশ কেমন যেন অচেনা রঙের ছিল সেই দিন, যেন বর্ষার প্রথম ফোঁটা এসে শহরের পুরনো রাস্তাগুলোকে নতুন জীবন দিতে চেয়েছে। ভেজা ইটের ফুটপাথ, নোনা কংক্রিটের দেওয়াল, আর রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট জলরঙের পুলের মধ্যে কেবল বৃষ্টির নরম শব্দই ভেসে আসছিল। মায়া, তরুণী যে বয়সেই শহরের কোলাহল থেকে একেবারে দূরে থাকতে ভালোবাসত, ভেজা ছাতার ভাঁজ মাথায় নিয়ে ধীরে ধীরে “নীলবাতি” নামের চায়ের দোকানের দিকে এগোয়। দোকানের ছোট্ট নীল বাতিটি দূর থেকে তাঁকে আহ্বান করছিল—এক ধরনের অদ্ভুত আকর্ষণ, যেন শহরের সব ভিড় ও আওয়াজ এই এক জায়গায় মিলিত হয়। ভেতরে ঢুকে মায়া যেন…
-
-
নীলাক্ষি বসু বর্ষার রাত। আকাশ যেন কারও অন্তহীন শোক মেখে ভিজে উঠেছে। জানালার কাচের ওপরে টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে, ছোট ছোট দাগ টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিচের দিকে, আর তার সাথে মিশে যাচ্ছে দূরের বজ্রপাতের সাদা ঝলকানি। হোস্টেলের পুরনো দালানটা বৃষ্টির ঝাপটায় কাঁপছে, বাতাসের ঠান্ডা স্রোত বারবার জানালা ভেদ করে ঢুকে পড়ছে ছোট ঘরটায়। কক্ষের ভেতরে ম্লান আলোয় এক কোণে বসে আছে অর্পণ, সামনের টেবিলে খোলা সরকারি চাকরির প্রস্তুতির মোটা বই। পৃষ্ঠাগুলো ভিজে যাচ্ছে আর্দ্রতায়, মাঝে মাঝে পাতার কিনারা উল্টে উঠছে বাতাসে। অর্পণ খেয়াল করে, প্রতিবার জানালার কাচে বৃষ্টির আঘাত হলে তার বুকের ভেতরটাও অদ্ভুতভাবে ধকধক করে ওঠে। এ যেন…
-
অতনু হালদার সকালবেলার শান্তিনিকেতন সবসময়ই আলাদা এক আবহ তৈরি করে রাখে। সূর্যের সোনালি আলো যখন গাছপালার পাতার ফাঁক দিয়ে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে, তখন গোটা গ্রামটাই যেন এক অদৃশ্য ক্যানভাসে আঁকা হয়ে ওঠে। এলিসা সেই সকালেই পৌঁছেছিল এই মাটির শহরে, তার বহু প্রতীক্ষিত ফটোগ্রাফি প্রজেক্ট নিয়ে। ইউরোপের একটি নামকরা ফটোগ্রাফি ম্যাগাজিন তাকে বেছে নিয়েছিল ভারতবর্ষের গ্রামীণ শিল্প, প্রকৃতি ও মানুষের হাসিমুখ তুলে ধরার জন্য। সে আগে বহু বই ও নথিতে পড়েছে শান্তিনিকেতন নিয়ে—রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত এই জায়গার সংস্কৃতি, রঙ, মাটির গন্ধ, শিল্প ও গানের গল্প। কিন্তু বাস্তবে সেই সকালেই প্রথমবার সে হাঁটছিল লাল মাটির পথ ধরে। চারপাশে সোনাঝুরির গাছ, যার পাতার ঝিরঝির…
-
সৌমাভ গুহ ভোর থেকে দুপুর হয়ে গেছে, কিন্তু আকাশ যেন একরকম ম্লান নীলচে ধোঁয়াটে রঙে আচ্ছন্ন। মায়া কলেজের ক্লাস শেষ করে নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে বের হয়, মনে ঘুরপাক খাচ্ছে দিনের কাজের ক্লান্তি আর বন্ধুর সঙ্গে কেচ্ছা। রাস্তা ধুয়ে ধুয়ে যাচ্ছে হালকা হাওয়ায়, কিন্তু আকাশে কোনও পূর্বাভাস নেই যে, খুব শীঘ্রই যেন সেই ধুয়ে যাওয়া রং একটি প্রবল বৃষ্টিতে বদলে যাবে। মায়া ব্যস্ত, চোখে পড়ছে পাশের দোকানের রঙিন শাটার আর গাছের পাতায় জমে থাকা শিশিরের পানি, আর হঠাৎ মনে হলো আকাশে ঘন কালো মেঘ জড়ো হতে শুরু করেছে। মুহূর্তের মধ্যে কুঁড়ে কুঁড়ে বৃষ্টির কণাগুলো ঝরে পড়তে শুরু করে, আর মায়া…
-
অর্কপ্রভ দাস এক শুভঙ্কর সেন নামটা অফিসে নতুন কেউ শোনে না, যতক্ষণ না কেউ রিপোর্টে তার নাম দেখে বা মিটিংয়ে প্রশ্ন করে—“শুভ, তুমি কি এনালাইসিসটা রেডি রেখেছো?” সহকর্মীদের মুখে “শুভ” নামটাও যেন একটা দায়সারা উচ্চারণ, আর শুভঙ্করের জীবন ঠিক ততটাই নিষ্প্রভ। দক্ষিণ কলকাতার একটা একতলা বাড়িতে বৃদ্ধ মা আর একটা বিড়াল নিয়ে তার একঘেয়ে রুটিন চলে—সকালে অফিস, রাতের খাবারের পর বিছানা, তার মাঝে কেবল একটা জায়গায় সে নিজের মতো করে বাঁচে—সোশ্যাল মিডিয়ায়। “Mr. SilentVerse”—এই ছদ্মনামে সে একটা ফেসবুক পেজ চালায়, যেখানে সে তার নিজের লেখা কবিতা, দু-চার লাইন প্রেম, আর জীবনের অন্ধকার কোণার কথা শেয়ার করে। আশ্চর্যভাবে, সেখানে হাজার তিনেক…
-
অরুণিমা বসু শিলিগুড়ির শহুরে আলোর ঠিক সীমারেখা পেরিয়ে, যেখানে পিচঢালা রাস্তা কাঁকরবিছানো পথের সঙ্গে হাত বদল করে, সেখানেই শুরু হয় জলদাপাড়ার রেঞ্জ—প্রায় ছয় হাজার হেক্টর জুড়ে বিস্তৃত এক জীবন্ত নিঃশব্দতা। অরিন্দম সরকার এখানে নতুন পোস্টিং পেয়েছে তিন মাস হল। ছোটবেলা থেকেই তার প্রকৃতির প্রতি অনুরাগ, কিন্তু সেটা কখনো উচ্চস্বরে বলা হয়নি। শান্ত, অল্পভাষী, সাদামাটা এই মানুষটা সদ্য কলকাতা থেকে বদলি হয়ে এসে একেবারে জঙ্গলের মাঝখানে এসে বসবাস শুরু করেছে—যেখানে সন্ধে নেমে এলে মানুষের অস্তিত্ব হারিয়ে যায়, আর কেবল গাছেদের ফিসফাস শোনা যায় হাওয়ার সঙ্গে। অরিন্দমের দিন শুরু হয় সূর্য ওঠার আগে। নিজের কঞ্চির তৈরি চায়ের কাপ হাতে করে সে বনপথ…