অর্পিতা দত্ত কলেজের বার্ষিক ফিল্ড ট্রিপের ঘোষণা হতেই যেন এক ঝড় বয়ে গেল ক্লাসের ভেতর। যে ক্লাসরুমের বাতাস এতদিন ধরে শুধু পাঠ্যবই আর ল্যাবরিপোর্টের ভারে ভারী হয়ে থাকত, সেদিন সেখানে উচ্ছ্বাসের গুঞ্জন। সবাই ব্যস্ত নিজের মতো করে পরিকল্পনা করতে—কে কোন ব্যাগ নেবে, কে কী পোশাক পরবে, কোথায় ছবি তুলবে। এই উত্তেজনার ভিড়েই নিঃশব্দে বসে ছিল শ্রেয়সী। শ্রেয়সী সবসময়ই একটু গম্ভীর মেয়ের মতো। সহপাঠীদের চোখে সে পড়াশোনায় সিরিয়াস, অন্তর্মুখী, প্রায় অদৃশ্য এক ছায়ার মতো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারও কেমন এক তৃষ্ণা ছিল—কলেজ জীবনের এমন এক ভ্রমণে অংশ নেবে, যা হয়তো মনে থাকবে সারাজীবন। যাত্রার দিন সকালে হাওড়া স্টেশন যেন মেলা। ছাত্রছাত্রীদের…
-
-
শ্রুতি পোদ্দার এক কলকাতার আকাশ সেইদিন সকাল থেকেই ভারী হয়ে ছিল, যেন অনেক পুরনো স্মৃতির মতন চেপে বসেছিল শহরের বুকে। কলেজ স্ট্রিটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে অর্ক চট্টোপাধ্যায় নিজের ছায়ার দিকেই তাকিয়ে ছিল, কিন্তু আসলে সে তাকিয়ে ছিল না কিছুতেই—সে যেন হাঁটছিল কোনো অভ্যন্তরীণ টানেই। প্রেসিডেন্সির লাল ইটের বিল্ডিংটা ভিজে গন্ধ ছড়াচ্ছিল, যেটা অর্কর অদ্ভুতভাবে ভালো লাগে। এ শহরের বৃষ্টির মধ্যে একটা নির্জনতা আছে, একটা নিরব অথচ উপস্থিতি-ময় শব্দ—যা ভীড়ের মধ্যেও নিজেকে একা করে তোলে। কলেজ গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে সে খানিকক্ষণ মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল—বৃষ্টির জল তখন টুপটাপ পড়ে চলেছে সিগনেট গেটের ওপর। তার পকেটে রাখা ছাতা সে…
-
ঐশী সেনগুপ্ত পর্ব ১: বৃষ্টির ব্রেক কলকাতার জুলাই মাসের বৃষ্টি ঠিক যেন কাকেই বা কখন চমকে দেবে বোঝা যায় না। সকালে রোদ, দুপুরে গুমোট, আর বিকেল গড়াতেই যেন মেঘ ভিজিয়ে দিয়ে যায় ব্যস্ত মানুষগুলোর অবসরের ফাঁকফোকর। তিথি সিংহরায় ঠিক সাড়ে তিনটে নাগাদ নামল গেটস টেক পার্কের সামনে। তার ল্যাপটপ ব্যাগটা আজ অদ্ভুত ভারি লাগছে, হয়তো বা ভেতরের টেনশনটাই বেশি। আজ যে প্রেজেন্টেশনটা দিতে হবে, সেটা হেড অফিস থেকে সরাসরি এসেছে—এবং সঙ্গে এসেছে তিনটি কোম্পানির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। পা রেখেই সে বুঝল, মেঘ জমছে। “দুপুরের পরে এমন আবহাওয়ায় বরাবরই কিছু একটা হয়,” নিজের মনেই বলে উঠল তিথি। অফিস ক্যান্টিনটা প্রায় ফাঁকা। আরেকটা…
-
সৃজন ঘোষ পর্ব ১ — শিবু কাকার দোকান ওরা দুজন দুটো আলাদা অফিসে কাজ করে। আলাদা ভবন, আলাদা ফ্লোর, আলাদা ম্যানেজার, আলাদা টাইমশিট—কিন্তু বিকেল তিনটা পঁচিশে দুজন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ে একটাই জায়গায়—শিবু কাকার চায়ের দোকানে। হ্যারিসন রোড আর ব্যাঙ্কশাল স্ট্রিটের সংযোগস্থলে ছোট্ট এক টিনের ছাউনি, তিনটে লাল চেয়ার, একটা কেরোসিন স্টোভ, আর একটা চুন-ছোপ খাওয়া কাঠের বেঞ্চ। এখানেই তুলি রোজ বিকেলে আসে মাথার ব্যথা সারাতে, আর রুদ্র আসে… আগে হয়তো কেবল চায়ের জন্যই আসত, এখন সে নিজেও জানে না ঠিক কেন আসে। তুলির অফিস ‘ইমার্জ ইভেন্টস’-এর তিনতলায়। একঘেয়ে মিটিং, থিম-পিচ, ক্লায়েন্ট ব্রিফ আর ইনস্টাগ্রামের ক্যাপশন নিয়ে সকাল থেকে বেলা পার…
-
রুক্মিণী ভট্টাচার্য পর্ব ১: মেঘ জমেছে হাজরা মোড়ের সেই পুরোনো বাস স্টপটায় দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটি। তার পরনে একটা সাদা-লাল ছাপার কুর্তি, হাতে একটা বই, মুখটা মেঘলা আকাশের মতো ভাবনায় ঢাকা। বৃষ্টি নামবে বুঝে ছাতাটা খুলে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু জানত না, এই ছাতাটাই একদিন একটা গল্প হয়ে উঠবে। পাঁচ মিনিট আগেই ট্রামলাইন বরাবর হাঁটছিল একটা ছেলেও। নাম তন্ময়। চোখে চশমা, কাঁধে ব্যাগ, আর কানে হেডফোন। ট্রামটা চলে গেছে, কিন্তু ছেলেটা থেমে দাঁড়ায়—বৃষ্টি তার চুল ভিজিয়ে দিচ্ছে, অথচ সে নড়ছে না। বৃষ্টি বাড়তেই দুজনেই একটু করে সরে আসে স্টপের ছাউনির নীচে। হঠাৎ একটা ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দেয় মেয়েটির কাঁধটা। ছেলেটি একটু এগিয়ে এসে…
-
ঋদ্ধিমান দাশ পর্ব ১: কাগজের পাতা, ধোঁয়ার রেখা ক্যাফে কুয়াশার দরজায় টাঙ্গানো পুরনো ঝোলানো ঘণ্টাটা বাজল, আরোহী ঢুকল ধীরে, একহাতে ব্যাগ, অন্য হাতে ফোন। অফিস থেকে সরাসরি আসছে, মাথাটা কেমন যেন ভারী, দিনের ঝাপসা ক্লান্তি তাকে গিলে খেতে চাইছে। কিন্তু এই ক্যাফেটার ভেতরটা যেন অন্যরকম—জানলার কাচ দিয়ে বিকেলের আলো এসে পড়ছে সোনালি ছায়ায়, দেওয়ালে ঝোলানো বইয়ের কভার আর পুরনো বাংলা গানের পোস্টার। তার প্রিয় টেবিলটা—ডান দিকের কোণারটা—আজ খালি। সে বসে, ব্যাগটা পাশে রাখে। ওয়েটার রাজু এসে জানতে চায়, “দিদি, এক কাপ স্পেশাল দার্জিলিং আর কালচার্ড বিস্কুট দেব?” “হ্যাঁ, আর একটা গরম জল দিও, মাথা ধরেছে,” বলে সে, চোখ বন্ধ করে…
-
ঈশিতা সেনগুপ্ত জানলার ওপারে কলকাতার উত্তরের এক পুরনো পাড়ায়, লাল ইটের তিনতলা বাড়িটা বহু দিনের সাক্ষী। উঠোনজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পুরনো ফুলদানি, জং ধরা বাইসাইকেল, আর সবথেকে দৃষ্টিনন্দন—একটা ঘন পাতা কদমগাছ। সেই গাছের নিচে প্রতিদিন সকালে বসে এক ছেলেটা, তার কোলে একটা স্কেচবুক, হাতে পেন্সিল—নিস্তব্ধ ঘোরে ডুবে যায় নিজের আঁকায়। ছেলেটির নাম অয়ন। অয়নের জীবনের ছন্দ বড়ো একঘেয়ে ছিল। আঁকাআঁকি আর কদমগাছের নিচে বসে থাকা ছাড়া সে খুব একটা কারো সঙ্গে মেশে না। পড়াশোনার দিন পেরিয়ে, সে এখন ঘরে বসেই গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করে। পাড়ায় বহুদিনের বাসিন্দা, তাই কারও চোখে নতুন নয়। তবে হঠাৎ করেই সব বদলে গেল, যেদিন জানালায় সে…