সুমন্ত বসাক অধ্যায় ১: নতুন চাকরি অনির্বাণের বয়স মাত্র চব্বিশ। স্নাতক পাশ করার পর থেকেই কাজের খোঁজে এখানে-ওখানে ছুটছে, কিন্তু ভাগ্য যেন তাকে বারবার ঠকাচ্ছে। শহরে একসময় অনেক চেষ্টা করেছিল, কল সেন্টারের চাকরি থেকে শুরু করে প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতার জন্য সাক্ষাৎকার দিয়েছে, কিন্তু কোথাও ঠিকমতো জায়গা হয়নি। গ্রামে ফিরে আসতে হয়েছে খালি হাতে। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়েছে, আর মায়ের অসুখে ওষুধের খরচ মেটানোই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ অবস্থায় গ্রামের মুন্সি হঠাৎ একদিন খবর দিল—পঞ্চায়েতের তরফ থেকে প্রহরীর একটা পদ খালি আছে। তবে জায়গাটা হলো গ্রামসংলগ্ন পুরনো শ্মশান। শুনে অনির্বাণের শরীর শিউরে উঠেছিল। শ্মশান পাহারা দেওয়া…
-
-
সৌরদীপ ব্যানার্জী পর্ব ১ : থেমে যাওয়া সময় কলকাতার গ্রীষ্ম সন্ধ্যা। শহরের ব্যস্ততা তখনও ফুরোয়নি। কিন্তু শান্তিনিকেতন লেনের পুরনো তিনতলা বাড়িটা যেন অন্য জগতের মতো নিঃশব্দ। চারপাশে কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ, আর ভেতরে জমে উঠছে অস্বস্তিকর হাহাকার। সেই বাড়ির দোতলার পড়ার ঘরে নিথর হয়ে পড়ে আছেন অধ্যাপক অনিরুদ্ধ মুখার্জী—শহরের খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ। তাঁর শরীরটা একপাশে হেলে পড়ে আছে, টেবিলের ওপরে কাগজপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। মাথার কাছে পড়ে আছে একটি হাতঘড়ি—কাঁচ ভাঙা, কাঁটা থেমে আছে রাত ২টা ১৭ মিনিটে। পুলিশ আসে, চারদিক ঘিরে ফেলে। দারোয়ান অশোক ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জানায়— “সার, আমি তো বিকেল সাড়ে চারটের সময় ভেতরে ঢুকে লাশ দেখি। দরজা ভেতর থেকে…
-
অনিৰ্বাণ দাস ১ গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ভিলাটির জন্ম একেবারে ইতিহাসের গর্ভে লুকিয়ে আছে। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন চন্দননগর ছিল ফরাসি উপনিবেশের এক প্রধান কেন্দ্র, তখন ফরাসি কনসাল জ্যঁ-ব্যাপটিস্ট দ্য ল্যাঁক তাঁর পরিবারের জন্য এই ভিলাটি নির্মাণ করেছিলেন। গঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চল তখন ছিল বাণিজ্যের জন্য অমূল্য সম্পদ—রেশম, নীল, আফিম, মসলিনের ব্যবসায় মত্ত হয়ে উঠেছিল ফরাসি বণিকেরা। ইউরোপীয় জাহাজ এসে ভিড়ত বন্দরঘাটে, আর গঙ্গার জলে প্রতিদিন প্রতিফলিত হতো সাদা পালের ছায়া। ভিলাটি ছিল তাঁদের ঐশ্বর্যের প্রতীক—সাদা চুনে মোড়া দেওয়াল, নীল রঙে রাঙানো কাঠের জানালা, আর রোমান খিলানের মতো খোলা বারান্দা। চারদিকে ছায়াঘেরা বাগান, যেখানে ইউরোপ থেকে আনা গাছপালা যেমন ছিল,…
-
সৌমিলি দত্ত চন্দননগরের আলো উৎসবের রাতটি এক অন্যরকম জাদু উপহার দিচ্ছিল। নদীর ধারে ছড়িয়ে থাকা রঙিন আলো যেন জলরাশিকে আলোকিত স্বপ্নের মতো পরিণত করেছে। প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি রাস্তা, এমনকি ছোট্ট সরু গলিগুলোও আলোতে ভেসে ওঠে—লাল, নীল, হলুদ আর সবুজ রঙের ঝলমলে বাতিগুলো এক ধরনের মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। ফরাসি স্থাপত্যে ভরা পুরনো ভবনগুলো তাদের ঐতিহাসিক সৌন্দর্য ধরে রেখেছিল, কিন্তু রাতের আলো তাদের আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। সেতার আর ঢোলের সুর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছিল, যেন প্রতিটি সুর বাতাসে মিলেমিশে নাচছে। লোকেরা উৎসবমুখর, হাসি-আনন্দে ভরা, আর প্রতিটি মানুষের মুখে এক অদ্ভুত উত্তেজনা আর আনন্দের ছাপ। শহরটি যেন এক জীবন্ত চিত্রকর্ম হয়ে উঠেছে,…
-
সৌরভ বসু এক শহরের এক প্রান্তে, যেখানে আধুনিকতার কোলাহল ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যায় আর গলিপথের শেষে ঝোপঝাড়ে ঢাকা অন্ধকার ঘনিয়ে ওঠে, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে দত্তবাড়ি। এককালে প্রাচুর্য, ঐশ্বর্য আর গৌরবের প্রতীক ছিল এই প্রাসাদসদৃশ বাড়িটি, যার বিশাল খিলান, রঙচটা বারান্দা আর কাঠের দরজাগুলো একসময় শহরের মানুষকে বিস্ময়ে মুগ্ধ করত। কিন্তু এখন সময়ের সাথে সাথে যেন ইতিহাসও তাকে বিস্মৃত করেছে। কেউ আর কাছে আসে না, ধীরে ধীরে চারদিকের দেওয়ালে শেওলা জমেছে, ছাদ থেকে ইট খুলে পড়ে যায়, জানালার কাঁচ ভেঙে ঝুলে থাকে বাতাসে আর ভিতরের ঘরগুলো ধুলোয় ঢাকা অন্ধকারে ডুবে থাকে। মানুষ বলে—দত্তবাড়ি অভিশপ্ত, আর সেই অভিশাপের ছায়া পুরো বাড়িটার…
-
অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় পুরুলিয়ার লাল মাটির রাস্তা যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় ভিজে ছিল। ঋত্বিক সেনগুপ্তের বাস থেকে নামতেই ধুলো মেখে গেল জুতো। কলকাতা থেকে এখানে পৌঁছতে প্রায় নয় ঘণ্টা লেগেছে—স্টেশন থেকে বাস, বাস থেকে আবার চোট্টোখাটো জিপ। চারপাশে শুধু শাল, পিয়াল, মহুয়ার গন্ধ, দূরে টিলা আর ঝকঝকে নীল আকাশ। তার ক্যামেরার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়েই একবার চারদিক দেখে নিল সে। মনে হচ্ছিল, এ জায়গাটার বুকের ভেতরেই লুকিয়ে আছে কোনও গল্প, যে গল্প ফোটে না শহরের আলোয়, কেবল গ্রামবাংলার অচেনা অন্ধকারেই তার রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। ঋত্বিকের সঙ্গে এসেছিল তৃষা—বন্ধু, সহযাত্রী আর কৌতূহলী সঙ্গী। ওর চোখে এ ভ্রমণটা শুধু ফটোগ্রাফির জন্য নয়,…
-
অরিত্র ভট্টাচার্য আমাদের গ্রামের নাম হিজলতলা, চারদিকে জলাভূমি, তালডোবা, মাঝেমধ্যে ধানক্ষেতে চিলের পাখা লেগে বাতাস কেটে যায়, আর মাঝখানে বটগাছের ছায়ায় পড়েই আছে যে জিনিসটা নিয়ে এত কথা—পুরনো প্রাইমারি স্কুলঘর। টালির ছাদে শ্যাওলা, দরজায় মরচে, জানালার কাঠ নড়ে উঠলেই যেন লম্বা ককিয়ে ওঠা কান্না, আর ভেতরে ধুলো জমা বেঞ্চ-ডেস্ক যাদের ওপর আমরা কোনোদিন বসিনি, কারণ স্কুলটা বন্ধ হয়ে গেছে অনেক বছর। কেন বন্ধ, সেটা নিয়ে গ্রামের লোকের হাজার গল্প। কেউ বলে, শিক্ষক আত্মহত্যা করেছিলেন, কেউ বলে একটা মেয়ের সঙ্গে তাঁর গোপন সম্পর্ক ছিল, কেউ বলে রাতে চক ঘষার শব্দ শুনে পাগল হয়ে যান। এসব কথার সঙ্গে সঙ্গে আমরা—আমি, বাপন, শুভ,…
-
অধ্যায় ১ – গঙ্গার বুকে তৈরি সেই প্রাচীন সেতুটি এক অদ্ভুত সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্রিটিশ আমলে, প্রায় দেড়শো বছর আগে, সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছিল কলকাতার সাথে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সংযোগ সহজ করার জন্য। গাঢ় ধূসর পাথরে গড়া এই সেতুটি শুধু পরিবহনের জন্য নয়, ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের শক্তির প্রতীক। গঙ্গার স্রোতকে যেন অমানুষিক জোরে বেঁধে রাখার এক দম্ভ দেখাতে চেয়েছিল ব্রিটিশরা। বিশাল খিলান, উঁচু খুঁটি, আর পাথরের গায়ে খোদাই করা সেই সময়কার নকশা এখনও মানুষের বিস্ময় জাগায়। দিনের বেলায় সেতুটা যতই দৃঢ় আর স্থায়ী মনে হোক, রাতের অন্ধকারে তার রূপ একেবারে পাল্টে যায়। গঙ্গার কুয়াশায় ঢাকা সেই পাথরের খিলানগুলো অদ্ভুত ভৌতিক…
-
নীলয় বসাক এক অরণ্যের আঁকাবাঁকা রাস্তায় ভোরের প্রথম আলো ভেসে আসছিল। শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি ধরে বহুটা পথ পেরিয়ে রিচার্ড অবশেষে পৌঁছাল সেই প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে, যাকে স্থানীয়রা ‘রংভ্যালি’ বলে ডাকে। গ্রামের নাম মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না, পর্যটন গাইডবুকেও তার উল্লেখ নেই। তবু পাহাড়ের নিস্তব্ধতায় মোড়া জায়গাটির প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ টেনেছিল তাকে। মেঘলা আকাশের নিচে সিঁড়ির মতো সাজানো ধানক্ষেত, কুয়াশায় আধঢাকা ছোট ছোট কুঁড়েঘর আর মাটির রাস্তার ধারে পাথর বসানো ঢাল—সবকিছু যেন রিচার্ডের চোখে এক অলৌকিক দৃশ্যের মতো ভেসে উঠল। লম্বা দেহ, খয়েরি দাড়ি আর গলায় ঝোলানো ক্যামেরা নিয়ে গ্রামের সীমানায় পা রাখতেই লোকেরা থমকে তাকাল। এত দূরে, এত…
-
অধ্যায় ১: রাজবাড়ির ধনভাণ্ডার রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষের চারপাশে বিকেলের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। হাওয়ার সাথে সাথে মলিন দেওয়ালের ফাঁকফোকর দিয়ে শুকনো পাতা উড়ে এসে জমছে, যেন সময়ের স্তূপে চাপা পড়া একেকটি স্মৃতি। বহুদিন ধরে গ্রামবাসীর কাছে এই রাজবাড়িকে ঘিরে নানা গল্প প্রচলিত—কেউ বলে এখানে নাকি রাতে অদ্ভুত আলো জ্বলে ওঠে, আবার কেউ বলে রাজপরিবারের অশান্ত আত্মারা এখনও ঘুরে বেড়ায়। এসব কাহিনি শুনে অনেকে ভয়ে পা বাড়ায় না, কিন্তু নায়ক/নায়িকা ভেতরে এক ধরনের রহস্যময় টান অনুভব করে। আজ সেই টানেই সে প্রবেশ করেছে পুরনো রাজবাড়ির গা ছমছমে করিডোরে। ভাঙা ছাদের ফাঁক দিয়ে সূর্যের শেষ আলো ঢুকে পড়ছে, আর অচেনা আঁধারের সাথে মিলেমিশে তৈরি…