কল্যাণ মুখার্জী শ্মশান ঘাটে সেই রাতে যেন অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল। চারিদিকে ঘন কুয়াশার চাদর, দূরে শ্মশানের পুরনো বটগাছের ডালে ডালে বাদুড়ের কর্কশ ডাক, আর মাঝেমধ্যেই কুকুরের হাহাকার যেন ভয়কে আরও ঘনীভূত করে তুলছিল। অমাবস্যার ঘন অন্ধকার নয়, তবু পূর্ণিমার আলোয় চারদিক সাদা হয়ে উঠলেও সেই আলোতে ছিল এক অস্বাভাবিক রক্তাভ আভা। যেন চাঁদ নিজেও এই রাতের সাক্ষী হতে গিয়ে অচেনা কোনো রূপ ধারণ করেছে। গ্রামের মানুষজন শ্মশানের সীমানা থেকে দূরে, পুকুরপাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে আতঙ্কে তাকিয়ে ছিল। কারও চোখে ভীতি, কারও চোখে কৌতূহল, কিন্তু সবার মনে একই প্রশ্ন—আজ রাতেই কি ভৈরবনাথ তাঁর বহুদিনের সাধনার সফলতা অর্জন করতে চলেছে? সেই…
-
-
দেবায়ন মুখোপাধ্যায় এক পিতার মৃত্যুর পরে বছরখানেক কেটে গেছে, কিন্তু ঋষভের জীবনে সেই শূন্যতা যেন আজও পুরোপুরি ভরেনি। শহরের ব্যস্ততা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ আর বন্ধুদের হাসিঠাট্টার মাঝেও কিছু একটা চুপচাপ গুমরে গুমরে উঠত ভেতরে—একটা অপূর্ণতা, একরকম গোপন আর অজানা অভাব। এবার গ্রীষ্মের ছুটিতে সে ফিরে এসেছে পুরনো বাড়িতে—উত্তর কলকাতার অন্ধকার আর ধূলিধূসর অট্টালিকা, যার প্রতিটি দেয়ালে, জানালায়, এমনকি বাতাসে লেগে আছে সেই মানুষটার ছায়া, যাঁকে সে পুরোপুরি চিনতেই পারেনি কখনও। দেবদ্যুতি সেন—ঋষভের বাবা—ছিলেন এক সময়ের বিখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত, কিন্তু পরবর্তী জীবনে তাঁর আচরণ হয়ে উঠেছিল রহস্যময়, চাপা, এমনকি ভীতিকরও কিছুটা। নিজের ঘরে একা একা ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা, কুঠুরি বন্ধ…
-
রক্তিম মজুমদার ১ কান্নার মতো এক বিষণ্ণ বাঁশির সুর যখন প্রথম শোনা গেল, তখন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সদ্য ঘুম থেকে উঠছিলেন। আসলে ঘুম বলে কিছু ছিল না—অচেনা বিছানা, কাঠের জানালার কড়চড় আওয়াজ, আর পাশের ঘর থেকে আসা থালার টুংটাং সব মিলিয়ে তার ঘুম গভীর হতে পারেনি। তিনি চোখ মেলে দেখলেন চারপাশ অন্ধকারে ডুবে, কেবল সামনের দেয়ালে রাখা ঘড়ির কাঁটা থেমে নেই। ৩টা ১০ বাজে। তিনি জানালার কপাট খুলে চেয়ে দেখলেন—বাইরে নিঃস্তব্ধতা; না কুকুরের ঘেউ ঘেউ, না পাখির ডানার শব্দ। কুয়াশায় ঢাকা মাঠের ওপারে কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে বাঁশির মায়াবী সুর। না, রবি ঠাকুরের মতো মন ভোলানো নয়; এই সুরে যেন…
-
দেবাশিস লাহা ১ হাওড়া স্টেশন তখনও ভোরের কুয়াশায় ঢাকা, ট্রেনের আওয়াজ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে প্ল্যাটফর্মজুড়ে। ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মে মানুষের ভিড় তখনও জমে ওঠেনি, শুধুই কিছু কুলি, এক-আধজন ঘুমন্ত ভিখারি আর স্টেশন মাস্টারের হ্যান্ডল্যাম্পের আলোয় ঝিম ধরা রেললাইন। ঠিক তখনই, সিসিটিভি ক্যামেরার আওতার বাইরের ছায়াঘেরা জায়গায় হঠাৎ দেখা যায় এক লোককে—মাথা ও মুখ ঢাকা, কাঁধে ব্যাগ, হাতে একটা লাল রঙের ট্রাঙ্ক। কেউ তাকে ভালো করে লক্ষ্য করেনি, শুধু কুলি কানু দে পরে বলেছিল, লোকটা যেন ছায়ার ভেতর থেকে উঠে এসেছিল, আর ওই ট্রাঙ্কটা রেখেই হাওড়ার ঝাঁকুনি মেশানো শব্দের ভেতর মিলিয়ে গেল। প্রথমে কেউ গুরুত্ব দেয়নি, এমনকি দু’ঘণ্টা পরেও যখন ট্রাঙ্কটি…
-
এক দার্জিলিঙের পথে ঋদ্বয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ি উঠছিল ক্রমাগত সর্পিল খাড়া রাস্তায়, আর আকাশে তখন নেমে এসেছে এক চিলতে কুয়াশা, যেন পাহাড় নিজেই ধোঁয়ার কুয়াশায় শরীর ঢেকে ফেলেছে। হিমেল হাওয়া জানালার কাচে ধুলো জমিয়ে দিচ্ছিল, আর দূর থেকে পাইন গাছের ছায়া যেন কোন গোপন সংকেত দিচ্ছিল তাকে। লেখার কাজে বেরোনো ঋদ্বয়ের পরিকল্পনা ছিল দার্জিলিঙের মূল শহরের একটু বাইরে, নির্জন এক হোমস্টেতে দু’সপ্তাহ থাকা, প্রকৃতির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে যান্ত্রিক জীবনের ধুলো ঝেড়ে ফেলা। কিন্তু পথ বদলে গেল সেই দুপুরেই, যখন হঠাৎ তার গাড়ি পাহাড়ি এক রাস্তার ধারে বিকল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে—আর মোবাইলে সিগনালও উধাও। সামনের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পেল একটা…