সৌম্যজিৎ বসাক ১ সকালের আলো জানালার পাতলা পর্দার ফাঁক গলে এসে পড়ছে বিছানার চাদরে। ঘড়ির কাঁটা আটটা বাজিয়ে থেমে গেছে—না, থেমে যায়নি, চলছে, কিন্তু তার কাছে যেন সব স্থির। ড. অরিজিৎ ধর ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন ছাদের দিকে। মস্তিষ্কে যেন কোনো শব্দ নেই, কোনো স্মৃতি নেই, কোনো প্রতিচ্ছবি নেই। তিনি উঠে বসলেন বিছানায়। মাথাটা ভারী লাগছে, যেমন হয় একটানা অনেকক্ষণ ঘুমালে। চারপাশে চেনা আসবাবপত্র, পরিচিত বইয়ের তাক, ল্যাম্পশেডের নিচে রাখা একটা পুরোনো পেন স্ট্যান্ড। কিন্তু এই ঘরটা যেন আজ নতুন মনে হচ্ছে—কিংবা মনে পড়ছে না একেবারেই। তিনি টেবিলের দিকে হাঁটলেন, যেখানে একটি নীলমাখা ডায়েরি খোলা পড়ে আছে। নিজের হাতের…
-
-
প্রশান্ত ভৌমিক এক ডঃ অনির্বাণ দত্ত ট্রেন থেকে নামলেন বোলপুর স্টেশনে, অগস্টের একটি অলস দুপুরে। তাঁর কাঁধে ক্যাম্ব্রিক কাপড়ের ব্যাগ, ভেতরে নোটবুক, একটি পুরনো ক্যামেরা, আর কিছু প্রয়োজনীয় গবেষণা-সামগ্রী। শান্তিনিকেতনের এই আশপাশের অঞ্চলে তিনি বারবার এসেছেন, কিন্তু এবারের উদ্দেশ্য কিছুটা ব্যতিক্রম। পূর্ব ভারতের লোকজ শিল্পের উপর একটি দীর্ঘ গবেষণাপত্রের কাজ করছেন তিনি, যার জন্য বিশেষ করে বীরভূম জেলার হারিয়ে যাওয়া পটচিত্রের খোঁজে এসেছেন। তিনি শুনেছিলেন, বোলপুর থেকে প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরে এক গ্রামে এমন একটি পটচিত্র আছে, যা কেবল শিল্পগুণের জন্য নয়, তার অদ্ভুত, অলৌকিক ইতিহাসের জন্যও লোকের মুখে মুখে ফেরে। এই গল্প প্রথম তিনি শুনেছিলেন তাঁর গুরু প্রণবেশ মিত্রর…
-
ইন্দ্রনীল লাহা ১ কলকাতার জানুয়ারি শীতভরা সকালে এসপ্ল্যানেড বাসস্ট্যান্ডটা যেন একটু বেশিই কোলাহলময় লাগছিল। চারপাশে ঠান্ডা কুয়াশা, পুণ্যার্থীদের গমগম আওয়াজ, ঠাকুরের প্রসাদের গন্ধ, আর চায়ের দোকানে জমে ওঠা ভিড়—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত উৎসবের আমেজ। অনির্বাণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল বাকিদের সঙ্গে, গলায় ম্যারুন রঙের একটা মাফলার পেঁচানো, চোখে একটা নিরুত্তাপ ছায়া। তার পাশে ঈশান ফোনে ব্যস্ত—বাসের টাইমিং, হোটেলের কনফার্মেশন মেল, সব কিছু একে একে দেখে নিচ্ছে। তৃণা বসে ছিল ওদের ব্যাগের পাহাড়ের পাশে, ঠান্ডায় হাত ঘষছে, আর বিক্রম তার নতুন DSLR ক্যামেরা নিয়ে একের পর এক ক্লিক করে চলেছে—কখনও ফুটপাথের বাউল, কখনও বাসের ছাদের ওপরে বাঁধা বস্তা। “এই মেলা কিন্তু মিথ্যা…
-
অধ্যায় ১: চিঠির মতো নিঃশব্দ পাহাড়ে ওঠার পথে হঠাৎ করে কুয়াশা ঘন হয়ে এল। ট্রেকিং পাথ বেয়ে যে ঘোড়ামারা ডাকে ওঠা গ্রামের দিকে এগোচ্ছিল অভিজিৎ সরকার, তার চারপাশে যেন হঠাৎই সময় থমকে গেল। বালির কাঁধে বয়ে আনা ছোট স্যুটকেস, একটা জলচৌকো ব্যাগ আর হাতে ধরা সরকারি ফাইলের খাম—সবই ভার হয়ে উঠল যেন হঠাৎ। এই ডাকঘরটা, পুরুলিয়ার এক পাহাড়ি অঞ্চলের প্রান্তে অবস্থিত, বহু বছর আগেই তালাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে রেকর্ডে লেখা ছিল। কিন্তু হেড অফিস থেকে অদ্ভুত এক চিঠির সূত্র ধরে, তাকে বদলি করা হল এই ‘বন্ধ’ ডাকঘরে। সে ভেবেছিল হয়তো কোনো ফাইলের গরমিল, অথবা ভুল পদক্ষেপ। কিন্তু বদলিপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন…
-
রক্তিম মজুমদার ১ কান্নার মতো এক বিষণ্ণ বাঁশির সুর যখন প্রথম শোনা গেল, তখন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সদ্য ঘুম থেকে উঠছিলেন। আসলে ঘুম বলে কিছু ছিল না—অচেনা বিছানা, কাঠের জানালার কড়চড় আওয়াজ, আর পাশের ঘর থেকে আসা থালার টুংটাং সব মিলিয়ে তার ঘুম গভীর হতে পারেনি। তিনি চোখ মেলে দেখলেন চারপাশ অন্ধকারে ডুবে, কেবল সামনের দেয়ালে রাখা ঘড়ির কাঁটা থেমে নেই। ৩টা ১০ বাজে। তিনি জানালার কপাট খুলে চেয়ে দেখলেন—বাইরে নিঃস্তব্ধতা; না কুকুরের ঘেউ ঘেউ, না পাখির ডানার শব্দ। কুয়াশায় ঢাকা মাঠের ওপারে কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে বাঁশির মায়াবী সুর। না, রবি ঠাকুরের মতো মন ভোলানো নয়; এই সুরে যেন…
-
এক রাজস্থানের জয়সলমের থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরে, বিস্তীর্ণ মরুভূমির বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে এক পরিত্যক্ত দুর্গ—সোনাভর কোট। কেবল উড়ে বেড়ানো ধুলো, জ্বলে ওঠা মরীচিকা আর কয়েকটা গাছের কঙ্কালই সাক্ষী ছিল যে একদা এখানে সভ্যতা ছিল। সেই দুর্গের কাছাকাছি স্থানে খনন কাজ শুরু হয়েছিল Archaeological Survey of India-এর তত্ত্বাবধানে, যার নেতৃত্বে ছিলেন দিল্লির প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ বিপ্লব রায়চৌধুরী। ইতিহাসের গায়ে জমে থাকা ধুলো সরাতে তাঁর হাতের জুরি ছিল না। তাঁর দলে ছিলেন গবেষক তানিয়া শেখাওয়াত, স্থানীয় শ্রমিক গণেশরাম, আর কিছু ছাত্রছাত্রী। খননের প্রথম তিন দিন কেটেছে কেবল পোড়ামাটির পাত্র, ধ্বংসপ্রাপ্ত ইটের খণ্ড এবং কিছু অনির্বচনীয় নিদর্শন খুঁজে পাওয়ায়। কিন্তু চতুর্থ…
-
অমাবস্যার সন্ধ্যা নামার অনেক আগেই আকাশে অদ্ভুত একটা চাপা গুমোট তৈরি হয়েছিল, যেন দিনের আলোও বাতাসে লুকিয়ে থাকা অজানা আশঙ্কাকে অস্বীকার করতে পারছিল না। নীরজ সেই সকাল থেকেই গুরুর নির্দেশমতো ঘর ছাড়িয়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি জিনিস জোগাড় করতে বেরিয়েছিল—একটি প্রাচীন লাল কাপড়ের টুকরো, কালো মোমবাতি, শিবের জীর্ণ মূর্তি, আর সেই দুর্লভ পুঁতির মালাটি, যা এক সময় গুরুর গুরু তার হাতে তুলেছিলেন। প্রতিটি জিনিস যেন নিজের ভেতর গোপন কোনো স্পন্দন বহন করছিল, নীরজ মনে মনে বুঝতে পারছিল, এ রাত শুধু আরেকটা সাধনার রাত নয়; এ রাতে এমন কিছু ঘটতে চলেছে, যার ওজন বহন করা সহজ নয়। শহরের ভাঙা প্রাচীন অলিগলি, গঙ্গার তীরের…
-
সায়ন ঘোষ এক শ্যামতলা সর্বজনীন দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর সন্ধ্যা, কলকাতার উত্তর শহরের এক পুরনো পাড়ার ভেতরে ছায়া-আলোয় জ্বলজ্বল করে ওঠা ঐতিহ্য আর বিশ্বাসের মেলবন্ধন। সন্ধ্যা ছ’টার পর থেকেই প্যান্ডেলে মানুষের ঢল নেমেছে—মেয়েরা নতুন শাড়িতে, ছেলেরা পাঞ্জাবি-পাজামায়, কারও হাতে ধূপকাঠি, কারও হাতে প্রসাদ আর সবার চোখে অদ্ভুত এক উজ্জ্বল আলো, যেন বছরের এই ক’টা দিনের মধ্যেই আটকে আছে জীবনের আসল আনন্দ আর আশা। ঢাকের বাজনা, কাঁসর-ঘণ্টা আর শঙ্খের ধ্বনি মিলে বাতাস ভারী হয়ে আছে, আর তার মধ্যেই বসানো হয়েছে মায়ের প্রতিমা—ছয় হাত উঁচু, সাদা সাঁকোয় দাঁড়িয়ে থাকা, সোনার গয়নায় সজ্জিত মুখ, যাকে ঘিরে রয়েছে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, আর পেছনে মহিষাসুরকে বধরত…
-
তমোঘ্ন সাহা অধ্যায় ১: চাঁদেরডিহির ছায়া পুরুলিয়ার পাহাড়ি রাস্তায় হেলেদুলে চলছিল জিপটা। চারপাশে যেন নিস্তব্ধতার শ্বাস পড়ে আছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। গাছের ডালে বসে থাকা বেজিগুলোও চুপ, যেন কোনও রহস্যের গন্ধ পেয়েছে। অগ্নিবেশ মুখার্জী জানালার ধারে বসে মোটা কাঁচের চশমা ঠেলে সামনে তাকিয়ে আছেন, তাঁর চোখে ক্লান্তি থাকলেও উৎসাহের ঝলক স্পষ্ট। তাঁর হাতে ধরা একটা পুরনো চামড়ার খাতা—চণ্ডীমুখার মন্দির থেকে সংগৃহীত এক তান্ত্রিক পাণ্ডুলিপি, যেখানে কপালকুণ্ডলিনীর গুহার উল্লেখ পাওয়া গেছে। সাথে রয়েছেন তাঁর সহকর্মী ডঃ সরোজিনী রায়, যার চোখে ঝকঝকে বুদ্ধি ও ঠোঁটে লেগে থাকা সংশয়। তাঁদের গাইড জয়ন্তী হাঁসদা বসে আছে সামনের সিটে, একদৃষ্টে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে। তার চিবুকের…
-
অর্ঘ্য দত্ত অধ্যায় ১: অজানা উত্তরাধিকার তীর্থর জীবনের সেই দিনটি যেন অন্য সব দিনের মতোই শুরু হয়েছিল, অথচ শেষ হয়েছিল এমন এক ঘটনার মধ্যে যা তার ভাবনার সীমার অনেক বাইরে। সকালে কলেজের ক্লাস শেষ করে বিকেলে বাড়ি ফিরতেই কাকা এসে বলল, দাদুর পুরনো ঘরের জিনিসপত্র কিছু বাছাই করতে হবে, আর সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তীর্থকে, কারণ দাদু নাকি প্রায়ই বলতেন কিছু জিনিস কেবল তার প্রিয় নাতির হাতেই থাকা উচিত। দাদুর সেই ঘরটায় ঢুকতেই তীর্থর মনে হল যেন পুরনো কালের গন্ধে ভিজে আছে প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি আসবাব। টালির চালের নীচ দিয়ে হালকা আলো এসে পড়ছে ধুলো জমা ট্রাঙ্ক আর বুকশেলফের ওপরে।…