শ্রেয়া বসু প্রথম পর্ব গ্রীষ্মের দুপুরে দক্ষিণবঙ্গের এক অখ্যাত গ্রাম—নাম কুড়ুলিয়া। এখানে আসলে যেন সময় থেমে আছে। মাটির পথ, দুই ধারে শাল, সেগুন, আমগাছের সারি, আর একেবারে প্রান্তে গিয়ে হঠাৎ ভেসে ওঠে বিরাট এক ধ্বংসস্তূপের মতো ইমারত—কুড়ুলিয়া জমিদারবাড়ি। একসময় এখানে ছিলো উৎসব, মহাফেজখানা, পূজোর জাঁকজমক, বেহালার সুর। এখন শুধু ভাঙা দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে জন্মানো লতাগুল্ম, আর মাঝে মাঝে রাতের বেলা শেয়ালের ডাক। লোকজন বলে, জমিদারের ভোগঘরটা বহু বছর ধরে বন্ধ। ভোগঘর মানে দেবদেবীর নৈবেদ্য রাখার জায়গা নয়, এখানে তার আলাদা মানে। বলা হয়, জমিদারের ভোগঘরে রাজপ্রাসাদের গোপন আনন্দ-আয়োজন হত। দাসী, নর্তকী, সঙ্গীত, মদ আর রাতভর ভোগ। কিন্তু সেই ভোগঘরের ভিতরেই…
-
-
অরিত্র ভট্টাচার্য আমাদের গ্রামের নাম হিজলতলা, চারদিকে জলাভূমি, তালডোবা, মাঝেমধ্যে ধানক্ষেতে চিলের পাখা লেগে বাতাস কেটে যায়, আর মাঝখানে বটগাছের ছায়ায় পড়েই আছে যে জিনিসটা নিয়ে এত কথা—পুরনো প্রাইমারি স্কুলঘর। টালির ছাদে শ্যাওলা, দরজায় মরচে, জানালার কাঠ নড়ে উঠলেই যেন লম্বা ককিয়ে ওঠা কান্না, আর ভেতরে ধুলো জমা বেঞ্চ-ডেস্ক যাদের ওপর আমরা কোনোদিন বসিনি, কারণ স্কুলটা বন্ধ হয়ে গেছে অনেক বছর। কেন বন্ধ, সেটা নিয়ে গ্রামের লোকের হাজার গল্প। কেউ বলে, শিক্ষক আত্মহত্যা করেছিলেন, কেউ বলে একটা মেয়ের সঙ্গে তাঁর গোপন সম্পর্ক ছিল, কেউ বলে রাতে চক ঘষার শব্দ শুনে পাগল হয়ে যান। এসব কথার সঙ্গে সঙ্গে আমরা—আমি, বাপন, শুভ,…
-
ৰজনী কুমাৰ দাস ভাগ ১: আগন্তুক বিহুৰ ঢৌ বহু আগতেই আচলালে গাঁওখনৰ মাটি; খৰা বিহানৰ আকাশত তৰা নোহোৱা নীলৰ ওপৰত টিপ টিপে মেঘৰ টোপোলা কিবা এটি উশাহত থকাৰ দৰে নাচি থকাৰ লগে লগে কেঁচা পথাৰৰ পাথৰুৱা লেনত ধূলি উৰি গ’লহি, আৰু তাৰ মাজেৰে হাঁহনি-চাহনি বাৰে বাৰে সলনি কৰি একোটা ছাতি ধৰি এগৰাকী ডাঙৰী বুঢ়ী নোৱাৰৰি এচাম তৰুণী বিদ্যালয়লৈ দীঘল পখিলাৰ ছাঁলৈ আগুৱাই গ’ল; ঠিক সেইসময়তে, গাঁৱৰ উত্তৰফালে পুখুৰীৰ পাৰত বাঁহৰ জালনি থোক থোক কৰি গুচা মাৰি থোৱা ঘৰৰ কাষৰ কেদাৰাত বহি থকাৰ পৰা দুজন মানুহ উঠে মেল খাই ক’লে—“আহিছে, আহিছে, ক’ত যে স্কুলৰ নতুন গৰু!” শব্দটো শুনা নাই যেন, ক’লা…
-
ঋত্বিক দাশগুপ্ত পর্ব ১ : হারিয়ে যাওয়া ডায়েরি কোলকাতার পুরোনো উত্তর শহরের ভাঙাচোরা গলির ভেতর এক নিস্তব্ধ বিকেলে অরিন্দম দত্ত নিজের বাবার কাঠের আলমারিটা খুলে বসেছিল। ধুলো জমে থাকা পুরোনো কাগজ, শুকনো কালির দাগ, আর অচেনা হিজিবিজি আঁকায় ভর্তি খাতাগুলো সবসময়ই তাকে টানত। বাবা ছিলেন একসময়ের ভ্রমণপিপাসু, যিনি চাকরি আর সংসারের চাপে সেই টানকে গুছিয়ে রেখেছিলেন আলমারির অন্ধকারে। বাবার মৃত্যুর দু’বছর পরেও অরিন্দম প্রায়ই এই আলমারিটা খুঁজে খুঁজে দেখত, যেন কোথাও লুকিয়ে আছে বাবার জীবনের অজানা কোনো গল্প। সেই বিকেলেই তার চোখে পড়ল চামড়ার মলাট বাঁধানো এক ডায়েরি। হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাগুলো ছুঁয়ে অরিন্দমের শরীরে কেমন এক অদ্ভুত শিহরণ জাগল।…
-
অর্ণব মুখার্জি পর্ব ১ — নতুন স্কুলশিক্ষক বর্ষার শেষে যে ভেজা গন্ধ মাটির ভেতর পর্যন্ত ঢুকে থাকে, সেই গন্ধ নিয়েই অরিন্দম প্রথম দিন গ্রামে পা রাখল। ছোট্ট স্টেশন, নামটি শিলালিপির মতো খসে পড়া বোর্ডে, প্ল্যাটফর্মে দু-একটা কেরোসিনের ল্যাম্প টিমটিম করছে, আর দূরে শালগাছের রেখা এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন কারও পুরোনো হাতের লেখা— থরথর করে, তবু পড়া যায়। কলকাতা থেকে ট্রেনে নামার পর একটা ভাঙা টেম্পো তাকে স্কুল পর্যন্ত পৌঁছে দিল। স্কুল বলতে ইট-সিমেন্টের দুটো দোচালা ঘর, সামনের মাঠে ঘাস বুনোভাবে উঠে এসেছে, তালগাছের ছায়া পড়ে লম্বা কালচে দাগ। প্রধান শিক্ষক ছুটিতে; সাময়িক দায়িত্বে থাকা ক্লার্কটি, নাম হারাধন, পাতলা গলার লোক,…
-
অয়ন চক্রবর্তী পর্ব ১: উত্তরাধিকার কলকাতার ব্যস্ত জীবন থেকে অনেক দূরে, পুরোনো গ্রাম বাড়িটায় পা রাখতেই অর্কের মনে হল যেন সময় থমকে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিক নিস্তব্ধ, কেবল বাতাসে খেজুরপাতার শোঁ-শোঁ শব্দ। অর্ক বহু বছর পর ফিরেছে এখানে—তার ঠাকুরদার মৃত্যুর খবর পেয়েই। ছোটবেলা কেটেছিল এই বাড়িতেই, তারপর বাবা-মায়ের সঙ্গে শহরে উঠে যাওয়া। ঠাকুরদা ছিলেন একেবারে গ্রামীণ মানুষ, কিন্তু তার চোখে একটা অদ্ভুত দীপ্তি ছিল, যেন তিনি অনেক অজানা কিছু জানতেন। বাড়ির ভেতর পা রাখতেই ধুলোমাখা গন্ধ নাকে এল। মাটির দেওয়ালে ফাটল ধরেছে, সিঁড়িতে শেওলা জমেছে। কিন্তু ঠাকুরদার ঘরটা ছিল যেমন ছিল, তেমনই আছে। বাঁশের খাট, একপাশে বইয়ের তাক, আর পুরোনো কাঠের…
-
ঋত্বিক বসু পর্ব ১ শ্মশানের ধোঁয়া যেমন ধীরে ধীরে রাতের বাতাসে মিলিয়ে যায়, তেমনই গোপালচন্দ্রর জীবনও এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় মিশে গেছে। সে এই শ্মশানকর্তার কাজ করছে প্রায় পনেরো বছর। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত—কখনও কফিনে ঢাকা শরীর, কখনও শবযাত্রার সানাই, আবার কখনও হাহাকার করা আত্মীয়দের চোখের জলে ভিজে যাওয়া কাঠের চৌকি। তার কাছে সব যেন একই রকম। শ্মশান মানেই মৃত্যু, মৃত্যু মানেই চুপচাপ এক ছায়ার দিকে মিলিয়ে যাওয়া। কিন্তু সে রাতে কিছু যেন অন্যরকম ছিল। আগুন নিভে এসেছে, শেষ কাঠটুকু ছাইয়ে পরিণত হয়েছে। গোপালচন্দ্র বাঁশের ঝুড়ি হাতে গঙ্গার জলে ভিজিয়ে ছাই ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। চারদিক নির্জন, কেবল রাতের পেঁচার ডাক আর…
-
ঋতুপর্ণা দাশগুপ্ত পর্ব ১: নদীর ডাক গাঁটা যেন অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় মোড়ানো ছিল। শীতল দমকা হাওয়া ভোরের আকাশে নীলচে ছাপ রেখে দিত আর দূরে শাল-সেগুনের বনের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসত নদীর গুঞ্জন। এই নদীর নাম ছিল কুলেশ্বরী। তবে মাধুরী ছোটবেলা থেকেই জানত, নামটা পুরোটা নয়—এই নদীর আরেকটা নাম আছে, একেবারে গোপন নাম, যা শুধু রাতের আঁধারেই ফিসফিস করে শোনা যায়। মাধুরী তখন দশ বছরের মেয়ে। প্রতিদিন বিকেলে সে বাঁশের ডাল দিয়ে বানানো কঞ্চির দোলনা নিয়ে নদীর ধারে যেত। নদীর পাড়ে বসেই তার পড়াশোনা, খেলাধুলো সবকিছু। কিন্তু এক পূর্ণিমার রাতে, হঠাৎ করেই সে শোনে অদ্ভুত একটা আওয়াজ—যেন নদী গুনগুন করছে। প্রথমে ভেবেছিল…
-
ঋতব্রত চক্রবর্তী পর্ব ১ : স্বপ্নের শুরু রাতের নিষ্প্রভতা যেন লালচে ছাই হয়ে উঠে বসে আছে স্বপ্নের ভেতরে—একটা শ্মশান, পাঁচটি নিবিড় প্রদীপ, নিরাবেগ নদীর ধারে কাঁসার থালায় রাখা কালচে ধূলি, আর কোথাও থেকে ভেসে আসা অসম্পূর্ণ শব্দ: “হ্রীং… ক্রৌঁ… শৌঃ… ন—” তারপরই ফাঁকা, এমন এক ফাঁকা যা নিঃশব্দ নয়; অদৃশ্য কণ্ঠের ভাঙন-ধ্বনি সেখানে ঘণ্টার মতো পাক খেতে থাকে, মাটির নিচে চোরা জলের শব্দের মতো সরে যায়, আবার ফিরে আসে। সেই স্বপ্ন থেকে পাঁচজন পাঁচ জায়গায়, পাঁচটি শরীর ভিন্ন ভিন্ন ঘামে, একই আতঙ্কে জেগে উঠল—যেন কোনো অদেখা আঙুল তাদের বুকের ওপর অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে লিখে রেখে গেল একটি মাত্র বৃত্ত, যার ভিতরে…
-
ঋত্বিক দত্ত পার্ট ১: যাত্রার প্রথম সকাল শহরের ভিড়ভাট্টা থেকে সমুদ্রের দিকে যাত্রা শুরু করার মুহূর্তটাই যেন এক অদ্ভুত মুক্তি। কলকাতা বিমানবন্দরের জানালার কাচের ওপার থেকে ভোরবেলা আকাশের নীলচে আলো যখন সোনালি হতে শুরু করছিল, তখন আমার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক উৎকণ্ঠা কাজ করছিল। দীর্ঘদিন ধরে স্বপ্ন দেখেছিলাম আন্দামান যাওয়া হবে—কেবল হাভলক বা নীল দ্বীপের সমুদ্রস্নান নয়, আমি চেয়েছিলাম খুঁজে বের করতে অজানা এক কোণ, যেখানে পর্যটকদের কোলাহল নেই, নেই রঙিন বিজ্ঞাপনমাখা হোটেলের ছায়া, আছে কেবল নির্জনতার ঘন অরণ্য আর সমুদ্রের শ্বাস। বিমান মেঘ কাটিয়ে নামতে শুরু করতেই জানালার বাইরে নীলের উপর সবুজের ছোপ দেখা গেল। দূর থেকে যেন অসংখ্য…