ঐশী মুখার্জি ট্রেনটা আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ছিল পুরুলিয়ার ছোট্ট স্টেশনে। জানালার ফাঁক দিয়ে লালচে ধুলো হাওয়ায় উড়ছিল, যেন মাটির গন্ধে মাখানো কোনো অদৃশ্য ধোঁয়া। রিনি ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে বসেছিল জানালার ধারে। কলকাতার চাকরিজীবনের ব্যস্ত, ধাতব আওয়াজে ভরা দিনগুলো থেকে বেরিয়ে সে এসেছিল, ঠিক এক মাসের জন্য। নিজের ইচ্ছেতেই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে, বন্ধুদের কাছে এখনো সে সিদ্ধান্তটা অযৌক্তিক, অনেকটা পাগলামির মতো শোনায়। কিন্তু রিনির মনে হচ্ছিল, এই লালমাটি-ঢাকা পথই তাকে নতুন কিছু শিখিয়ে দেবে। স্টেশনটা ছোট, নিস্তব্ধ, বাইরে নামতেই সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি আর হকারের ডাক একসাথে কানে বাজলো। রোদটা ঝলমল করছিল, তবুও হাওয়ায় একটা শুষ্ক ঠান্ডা মিশে ছিল। রিনি বুকের ভেতর হঠাৎ…
-
-
অনির্বাণ সেন পর্ব ১ কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে এক বিশাল আবাসন—গ্লাসের বারান্দা, রঙিন আলো, লিফটে ওঠানামার শব্দে ভরা। সেখানকার অষ্টম তলার ফ্ল্যাটে থাকে দত্ত পরিবার। সুদীপ্ত দত্ত একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে উচ্চপদস্থ অফিসার, মাসের শেষে তার অ্যাকাউন্টে যে বেতন জমে, তাতে অনায়াসেই চলে যায় তাদের তিন সদস্যের সংসার। তার স্ত্রী মৌসুমি, একসময় কলেজে ইংরেজি পড়াতেন, কিন্তু এখন ঘরের দেখাশোনাই তার প্রধান কাজ। মেয়ে ঐশী—নবম শ্রেণির ছাত্রী, পড়াশোনায় মেধাবী, আঁকতে ভালোবাসে, আর মাঝে মাঝে পিয়ানো বাজাতে শিখছে। ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে তাকালে দূরে দেখা যায় আকাশচুম্বী সব টাওয়ার, আর একটু নিচে তাকালেই উল্টো দৃশ্য। ঝুপড়ি ঘরগুলোর ছাউনিতে টিন, কোথাও পলিথিন, কোথাও বা ভাঙা বাঁশ…
-
সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় পর্ব ১: আগমন কলকাতার শহরে কত রকমের গলি আছে—কোথাও শুধু হালচালহীন ইটের দেওয়াল, কোথাও পুরোনো বারান্দার ফাঁক দিয়ে নীচে ঝুলে থাকা ধুলো-কণার ঝালর, কোথাও অন্ধকার ড্রেনের কানা ধরে বাচ্চাদের খেলা। অথচ শহরের একই শরীরের ভেতরে কতগুলো ভিন্ন আত্মা বাস করে। অর্ণবের জন্য এই শহর ছিল চেনা—ক্লাসে যাতায়াত, কফিহাউসের টেবিলে আড্ডা, কলেজস্ট্রিটের বইয়ের দোকান। কিন্তু যেদিন সে উত্তর কলকাতার সেই গলিতে প্রথমবার ঢুকল, মনে হল অজানা এক শহর খুলে গেছে তার সামনে। মোড়ে একটা ছোট্ট চা-দোকান। দোকানি মিঠুন দা চেনা মানুষ, তবে এখানে দাঁড়িয়ে অর্ণবকে দেখে খানিকটা অবাক। বলল, —“কোথায় যাচ্ছিস? এই রাস্তাটা তোর পথ নয়।” অর্ণব ব্যাগ কাঁধে…
-
পৌলমী দে ১ শীতকাল তার নিঃশব্দ পায়ে গ্রামের উঠোনে নেমে এসেছে বেশ কিছুদিন হল। মাঠের ঘাসে জমে থাকা শিশিরের ওপর দিয়ে হাঁটলে পায়ের শব্দ হয় না, কিন্তু শীতে মোড়া সেই স্তব্ধতায় সায়ন্তী প্রতিদিন একটা পরিচিত শব্দের অপেক্ষা করে থাকে—স্কুলঘরের প্রথম ঘণ্টা বাজা। সে দিনের শুরুটা হয় ঘুম ভাঙা মায়ের কাশির আওয়াজে, চায়ের কাপ গুনে ফেরা সংসারে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মাথায় উলের চাদর জড়ানো, ব্যাগে খাতা বইয়ের ভার; বাকি সব দিনের মতোই যেন। কিন্তু আজকের সকালে কুয়াশাটা একটু বেশি জমাট, আর হাওয়াটা যেন অতীতের গন্ধ নিয়ে আসে। গলির ধারে সেই পুরনো দোতলা বাড়িটা, যেটায় একসময় খেলাধুলা চলত, কাঁঠাল গাছের ডালে…
-
সৃজা দত্ত ১ কলকাতার গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই গোলাপি দরজাটার পেছনে একটা দুনিয়া লুকিয়ে আছে, যেটা বাইরের চোখে শুধু একটা বিউটি পার্লার, কিন্তু ভেতরে জমে আছে আত্মত্যাগ, লড়াই আর পুনর্জন্মের ইতিহাস। ‘মোহর’ নামের সেই পার্লারটা খুব বড় নয়—দুটো চেয়ার, একটা আয়না আর একটা স্টিমার মেশিন—তবু এই ছোট্ট ঘরটাই মোহিনী সেনের জীবনের মূলমঞ্চ। সকালে কাঁচের জানালায় সূর্যের আলো পড়ে, আর সেটা যখন পার্লারের পুরনো দেয়ালে আঁকা রাধা-কৃষ্ণের ছবিতে পড়ে, তখন যেন গোটা ঘরটা একটা শান্তি আর সৌন্দর্যের আশ্রয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এই শান্ত দৃশ্যের আড়ালে ছিলো মোহিনীর শৈশবের তীব্র অন্ধকার, বর্ধমানে জন্ম, সমাজের সঙ্গে প্রথম বিরোধ, মায়ের চোখের জল আর…
-
অর্ণা মুখার্জী ১ সায়নী বসু দক্ষিণ কলকাতার মফস্বলি এলাকায় দাঁড়িয়ে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে ছিল একটি পরিত্যক্ত বাসস্ট্যান্ডের দিকে। নতুন প্রজেক্টের কাজে তাকে পাঠানো হয়েছিল এই অঞ্চলের একটি পুরনো জমি পরিদর্শনের জন্য, যেখানে একটা কমিউনিটি সেন্টার তৈরির পরিকল্পনা আছে। কিন্তু সেই জমির পাশেই পড়ে থাকা পুরনো বাসস্ট্যান্ডটি তার দৃষ্টি আটকে দেয়। নীল রং উঠে যাওয়া টিনের ছাউনি, ভাঙাচোরা কংক্রিটের বেঞ্চ, আর বৃষ্টির জল জমে থাকা ময়লা গর্ত — দেখলে মনে হতো এই জায়গায় কোনো স্বপ্নের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা এক ঝাঁক বাচ্চা ছেলেমেয়ে, কেউ বোতল কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে, কেউ চায়ের কাপে জল খাচ্ছে, কেউবা টায়ারের টুকরো নিয়ে খেলছে — ওদের…
-
সায়ন্তন বসু ১ ধনেখালির একচালা ছোট্ট প্রাইমারি স্কুলটার ক্লাসঘরে তখন দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, সূর্যের আলো বেখেয়ালে মেঝেতে খেলছে, কিন্তু সুধাংশু বেরা বুঝতে পারছিলেন, আজকের শিক্ষার আলো যেন কেমন ম্লান। ক্লাসরুমে মাত্র ন’জন ছাত্র—হাজিরার খাতা বলছে তেইশজন আছে রোল কল-এ। যাদের এসেছে, তাদের চোখে ঘুম নেই, আছে কেমন এক শূন্যতা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো মাথা নিচু করে বসে আছে, যেমনভাবে গরিব সংসারের শিশুরা বসে থাকে কোনো বড়লোক আত্মীয়ের সামনে—ভয়ে নয়, লজ্জায়। হঠাৎ চিন্ময় হালদার, চতুর্থ শ্রেণির সবচেয়ে শান্ত ছেলেটা, ধীরে ধীরে হেলে পড়ে। সুধাংশু ছুটে গিয়ে তাকে ধরে ফেলেন। ছেলেটার নিঃশ্বাস ঠিক আছে, জ্বর নেই, কিন্তু সে সংজ্ঞাহীন। মাথায় জল দিতে দিতে…
-
সন্দীপন ধর খামে মোড়া নীরবতা রমেশচন্দ্র বসু বসে আছেন জানালার ধারে রাখা সেই পুরনো বেতের চেয়ারে। জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া বিকেলের আলো তার রুপোলি চুলে খেলে যাচ্ছে। মাথার ঠিক পাশেই একটা ছোট কাঠের তাক, সেখানে রাখা তার স্ত্রীর একটা ছবি — মেঘলা শাড়ি, মৃদু হাসি, কপালে ছোট্ট টিপ। নাম ছিল তার — কাবেরী। আজ অনেকদিন পর আবার পোস্টম্যান এসেছিল। লাল-হলুদ ইউনিফর্ম, কাঁধে ব্যাগ। সে বলল, “বসুবাবু, আপনার পেনশনের শেষ চেকটা এসেছে।” রমেশচন্দ্র ধীরে হাত বাড়িয়ে খামটা নিলেন। যেন মৃদু এক স্নেহে ছুঁলেন। এই খামে শুধু টাকা নেই, আছে একটা দীর্ঘ জীবনের সমাপ্তি ঘোষণা। অফিসের শেষ বেতন মাসেরও বেশি…
-
স্নেহাশিষ রায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। জাদরেল রোদের আভা ছড়িয়ে পড়েছে শহরের স্টেশনে। গরম বাতাসে ছিন্ন কাপড়ের মতো ওড়ানো যাচ্ছে না কোনো মন। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ৩২ নম্বর লোকাল ট্রেনের কামরায় যেন আগুনের ঢেউ বইছে। সেই উত্তপ্ত কামরার মধ্যে দিয়ে হাঁটছে দশ বছরের একটি ছেলে—হাতে একগুচ্ছ তালপাতার পাখা। ছোট্ট শরীরে ঘাম জমে রেখার মতো গড়িয়ে পড়ছে, তবে চোখে কোনো ক্লান্তি নেই। তার ঠোঁটে এক মৃদু ডাক—“তালপাতার পাখা নিন… গরমে আরাম… পাঁচ টাকায় একখানা…”। প্রতিটি যাত্রীকে দেখে সে যেন কল্পনা করে, কে কিনবে, কে ফিরিয়ে দেবে। কেউ মুখ ফিরিয়ে নেয়, কেউ তিরস্কার করে—“যাও যাও, বিরক্ত করো না।” তবু সে এগিয়ে যায়।…
-
সুব্রত দাশগুপ্ত ১ রিমার চোখে এই শহর ছিল এক স্বপ্নময় চিত্রপট — বড় বড় বিল্ডিং, আলোর রোশনাই, গাড়ির একটানা শব্দ, আর ছাদের ওপর নীল আকাশে উড়তে থাকা সাদা পায়রার মতো সুখ। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভাঙতে সময় লাগেনি। মায়ের মৃত্যুর পরে মামা তাকে শহরে নিয়ে আসে, একটা “ভালো” বাড়িতে কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। বয়স দশ হলেও, রিমা জানত কাজ বলতে কী — খাটুনি, হাঁটু পর্যন্ত ঝাঁপ দেওয়া, বকুনি খাওয়া আর সবশেষে নিঃশ্বাস ফেলার সময়টুকুতে ঘুমিয়ে পড়া। প্রথম দিন শহরে এসে মালবিকার বাড়িটা দেখে তার মনে হয়েছিল, এ যেন এক রাজপ্রাসাদ। চারপাশে ঝকঝকে কার্পেট, অচেনা গন্ধে ভরা ঘর, দেয়ালে টাঙানো ছবি আর…