শুভেন্দু মুখোপাধ্যায় ১ সকাল সাতটার ঠিক আগেই, গলির মাথার সেই ছোট্ট চায়ের দোকানে যেন জীবনের রিহার্সাল শুরু হয়। শিবুর দোকান—আসলে এক বাঁশের ফ্রেমে প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে বানানো, একটা মোড়া আর তিনটে বেঞ্চ, পাশে একটা রেডিও ঝুলছে সুতোর টানে—এইখানেই বসে ভবানী কাকু তাঁর রাজত্ব চালান। পাঞ্জাবি-ধুতি পরা, সাদা চুলে হালকা তেল, আর সেই চিরচেনা গোল চশমার আড়ালে মুখভর্তি আত্মবিশ্বাস। হাতে এক কাপ লাল চা নিয়ে বসে থাকেন সবার অপেক্ষায়, যেন এই পাড়ার সকল কথোপকথনের তিনি কর্ণধার। চা-র তাপ, পত্রিকার খবর আর ফুটবল-রাজনীতি-সিনেমা নিয়ে তাঁর ধ্রুপদী বিশ্লেষণ—সব মিলে এক নিখুঁত সকাল তৈরি হয়। “শিবু, চিনি কম নিস! কালও চাপে পড়ে রেণুদি বলল,…
-
-
অতুল ব্যানার্জী ১ সকাল সকাল ঘুম ভাঙে সুবলের। তার ঘুমটা গাঢ় হলেও, সীমান্তে গর্জে ওঠা ট্রাকে চেপে আসা বিএসএফের পেট্রল-জিপের শব্দ যেন কানে লেগে থাকে স্বপ্নের মধ্যেই। তাদের ছোট কুঁড়েঘরটা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের একেবারে ধারঘেঁষে। কাঠের বারান্দা নেই, কুয়োর জল রোদে শুকিয়ে থাকে আধা বালতির মতো। মা জাহানারা বিবি তখনো হাঁড়িতে জল চড়িয়ে রাখেন, আর কাঁটাতারের ওপাশের ঝোপের দিকে কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে থাকেন। তিনি জানেন, সেই দিকে নজর রাখতে হয়—সীমান্তে যেসব ঘটনা ঘটে, তা অনেক সময় পাছে এসে ঘরেও থাবা বসায়। সুবল আজ আর স্কুলে যেতে চায় না। স্কুল মানে ধুলো জমা বেঞ্চ, অসহ্য গরম, আর মাস্টারের কাঠের স্কেলের ঠক…
-
সৌম্যজিৎ বসু অধ্যায় ১: কলকাতার শহরটা যখন প্রথম সূর্যকিরণে লালচে আভা পেতে শুরু করে, তখনও ময়লা পলিথিন, ইটের টুকরো আর টিনের ছাউনি ঘেরা বস্তি ঘুম থেকে পুরোপুরি জাগেনি। তবে বস্তির মধ্যে কুমুদ আগেই জেগে উঠেছে। চারদিকে নিস্তব্ধতা, কেবল দূর থেকে হালকা করে শোনা যায় ট্রামের ঘণ্টার টুং টুং শব্দ, আর মাঝে মাঝে কোনো বাসের গর্জন। কুমুদ একহাত দিয়ে চোখের ঘুমের ছাপ মুছে নিয়ে অন্য হাতে চোঙা প্যান্টটা ঠিক করে পরে নেয়। গায়ে পরনের ছেঁড়া গেঞ্জিটা রাতের ঘাম আর বস্তির ধুলোবালিতে আরও বিবর্ণ হয়ে গেছে। সে জল আনার পিতলের কলসি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, সরু গলিটা পেরিয়ে পাশের পাম্পের দিকে। পাম্পের…
-
রৌদ্রদীপ লাহা এক সকালবেলা হাওড়ার গলি ঘুপচি ভেঙে আস্তে আস্তে সূর্যের আলো ঢুকতে শুরু করে। লোহার রেললাইনের ধারে, টালির ছাউনি দেওয়া ঘরগুলোয় তখনও ঘুমিয়ে থাকা মানুষদের মুখে এক চিলতে আলোর রেখা এসে পড়ে। শহরের কোলাহল তখনও শুরু হয়নি, কিন্তু বস্তির গলিতে গলিতে জীবনের আর্তনাদ যেন ঘুম ভাঙিয়ে দেয় পিন্টুর মতো হাজারো শিশুকে। সেই গলির এক কোণে মায়ের কোল থেকে আলতো করে উঠে দাঁড়ায় পিন্টু। বয়স দশ বছর, গায়ে মলিন ফাটা হাফ প্যান্ট, গায়ের ওপর পাতলা ছেঁড়া জামা। চোখদুটো বড় বড়, মলিন হলেও তার মধ্যে লুকানো থাকে অজস্র স্বপ্নের আভা। পিন্টু ধীরে ধীরে চোখ কচলে জেগে ওঠে। রাতের ঘুম তার স্বপ্নে…
-
মৌসুমী ধর চক্রবর্তী ১ শিউলির বয়স এখন পঁয়তাল্লিশ। একটা সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়ান তিনি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার প্রত্যন্ত এক গ্রামে ওঁর বসবাস—চারপাশে ইটভাটার ধোঁয়া, জলাভূমির নিঃশব্দতা, আর শালবনের ঘন ছায়ায় ঘেরা জনপদ। এখানকার রাস্তাগুলো বর্ষায় কাদায় ভরে যায়, গ্রীষ্মে ধুলো উড়তে থাকে, আর শীতে শীতল হাওয়া হাড়ে হাড়ে কাঁপিয়ে দেয়। অথচ এই সব কিছুর মাঝেও শিউলি যেন এক টলমলে আলো, যিনি কখনও নিভে যান না। তাঁর সকাল শুরু হয় খুব ভোরে। মাটি ছোঁয়া ধোঁয়া আর পাখির ডাকের মধ্যেই শুরু হয় রান্না-বান্না, বাড়ির কাজ। তারপর শাড়ি পরে ঝোলা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটা শুরু করেন প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের স্কুলের দিকে। অনেক…