তনিমা বসাক রুদ্রাক্ষী জানত না ঠিক কোন মুহূর্তে তার রোগীর মুখে উঠে আসে সেই চিহ্নটা—একটা বৃত্তের মধ্যে ঘূর্ণায়মান চারটি রেখা, যেটা দেখে মনে হয় যেন কালি ছড়ানো হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে কিন্তু ভেতরে কোনও গাণিতিক ছন্দ লুকিয়ে আছে। রোগীটির নাম ছিল অনুকূল বসু—৬৫ বছরের এক প্রাক্তন স্কুলশিক্ষক, যার স্মৃতিভ্রংশের উপসর্গেই রুদ্রাক্ষী প্রথমে সন্দেহ করেছিল আলঝেইমার, কিন্তু দ্বিতীয় সেশনে সেই কাগজটা হাতে এল। পুরোনো, হলুদ হয়ে যাওয়া একটা ডায়েরির ভাঁজে তোলা সেই চিহ্ন দেখে হঠাৎ তার মনে পড়ে গিয়েছিল মায়ের শেষদিনগুলো—যখন মা অজান্তে কিছু চিহ্ন আঁকতেন বাতাসে, চুপ করে থাকতেন, বলতেন, “এই লেখাগুলো কারো জন্য নয়, শুধুই অগ্নির জন্য।” মা ছিলেন একসময় রবীন্দ্রভারতীর…
-
-
সঙ্ঘমিত্রা পাল পর্ব ১: ছায়ার চিঠি কলকাতা শহর নিঃশব্দে ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু সেই রাতে, মধ্যরাত্রির প্রান্তে দাঁড়িয়ে, অনির্বাণ ঘোষ বুঝে গিয়েছিল—ঘুম কেবল শরীরের হয়, শহরের নয়। তার জানালার নিচে রাখা কাঠের চেয়ারে, বাতাসে হেলে পড়া একটি খাম, যেন কোনো নিঃশব্দ ছায়া রেখে গেছে নিজের সাক্ষর। খামটা ছিল পুরোনো—হলুদ রঙের, সুতির দাগ লেগে থাকা কাগজে মোড়া, আর মুখ সিল করা রক্তরঙ মোম দিয়ে, যার গায়ে আঁকা ছিল এক অচেনা চিহ্ন—তিনটি পরস্পরসংযুক্ত ত্রিভুজ, যার কেন্দ্র ছিল শূন্য। সে প্রথমে ভেবেছিল, কেউ হয়তো ভুল করে রেখে গেছে। কিন্তু খামটা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ত্বক ঠান্ডা হয়ে এল—অস্বাভাবিক এক ঠান্ডা, যেন সময় তার…
-
ঋদ্ধি চক্রবর্তী পর্ব ১: কালির চোখ কলকাতা শহরের মধ্যভাগে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এক পুরোনো পাঠাগার—“রায় রে’ডিং রুম”—তেমন কোনও বিখ্যাত জায়গা নয়। অথচ সেখানে প্রতিদিন দুপুর তিনটার সময় ঠিক এক জন মহিলা এসে বসেন, বাম দিকের দ্বিতীয় সারির তৃতীয় টেবিলে। তাঁর নাম অনামিকা বাগচী। বয়স আটাশ। পেশায় গবেষক, জাদুবিদ্যা ও তন্ত্রশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে তাঁর আসল কাজ শুরু হয় যখন বইয়ের পাতাগুলো শেষ হয়, আর প্রশ্নগুলো মুখে না থেকে ঢুকে পড়ে মগজে। সেদিন দুপুরেও অনামিকা এসে বসেছিল টেবিলটায়। লাল কাপড়ে মোড়া একটা পুরনো খাতা তার সামনে। নাম নেই, লেখকের উল্লেখ নেই। পাতাগুলোতে শুধুই আঁকা—ত্রিকোণ, মন্ডল,…
-
মেঘলা রায় পর্ব ১: সেই চিঠি পূর্ব ক্যালকাটা কর্পোরেশনের ঘিঞ্জি কোয়ার্টার, হরিদেবপুরের বাসা। সেইখানেই প্রতিদিন ঠিক আটটায় ঘুম ভাঙে সৌম্য মিত্রর। ঘুম থেকে উঠেই বাম দিকের দেয়াল ঘেঁষে থাকা পুরনো লোহার আলমারিটা খোলে—চাবি নেই, সরাসরি তালা ভেঙে রাখা। সেই তালার ভেতরেই পুরোনো চিঠিগুলো থাকে, মায়ের লেখা, ভাইয়ের পাঠানো, কয়েকটা সরকারি চিঠি, দু-তিনটে কাটা টিকিট। কিন্তু আজ সকালটা যেন কেমন অন্যরকম। জানলা গলে ঢুকছে একরাশ ঝিরঝিরে ঠান্ডা আলো, যেটা কলকাতার চেনা আষাঢ়ে মেলে না। আর তার ফাঁক দিয়ে, ছেলেবেলায় শোনা মাধবীলতার ঘ্রাণ এসে পড়ছে বিছানার বালিশে। হাতের প্রথম চিঠিটা হলুদ হয়ে যাওয়া খামে মোড়া। উপরে কালো কালিতে বড় বড় হরফে লেখা—সৌম্য…
-
তিথি বসু পর্ব ১: সেই ভগ্নপ্রায় দরজার শব্দ নদীয়ার কুয়াশা ঢাকা বিকেলে ট্রেন থেকে নামতেই শুভমর মনে হলো সময়টা যেন হঠাৎ করে থমকে গেছে। বাইরের হাওয়া ঠান্ডা, কিন্তু বাতাসের মধ্যে কিছু একটা গুমোট। সে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রিকশাওয়ালার দিকে এগোল। “চৌধুরীবাড়ি যাবেন?” জিজ্ঞেস করতেই রিকশাওয়ালার মুখটা কেমন থমথমে হয়ে গেল। “চৌধুরীবাড়ি? ওই যে শ্মশানের পাশে যেটা?” শুভম মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, ওটাই। আমি গবেষণার জন্য এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুমতি আছে।” রিকশাওয়ালা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, “আমি ওইদিক যাই না বাবু। ওখানে এখন কেউ থাকেও না।” শেষমেশ অনেক বোঝানোর পরে একজন রাজি হলো। অন্ধকার নেমে আসছিল, আর চৌধুরীবাড়ির পথটা খড়ি গাছ…
-
নীলাভ্র মল্লিক অধ্যায় ১: অদৃশ্য পুরোহিত পুরীর আকাশটা সেইদিন অস্বাভাবিক শান্ত ছিল। জুন মাসের শেষ সপ্তাহ, কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই, কেবল একটা অচেনা গুমোট ভাব জমে ছিল বাতাসে। ভোর সাড়ে চারটায় সিংহদ্বারের ঘণ্টাধ্বনি যখন ধ্বনিত হচ্ছিল, তখনও কেউ টের পায়নি যে জগন্নাথ মন্দিরের প্রবীণ পুরোহিত আচার্য বিভূতিভূষণ পাঠক আর কখনো সাড়ে চারটার পূজায় উপস্থিত হবেন না। তিনি ছিলেন এই মন্দিরের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও সম্মানিত সেবায়েতদের একজন—মূর্তি সাজানো থেকে শুরু করে সপ্তপ্রহরের রীতি পর্যন্ত যাঁর জ্ঞান ও শুদ্ধাচার ছিল ঈর্ষণীয়। সেইদিন ঠিক যেমনটি রীতি, তেমন করেই তাকে সকাল চারটায় ঘুম থেকে উঠে স্নান করে পূজা শুরুর প্রস্তুতিতে থাকবার কথা, কিন্তু সেবায়েত…
-
অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায় পর্ব ১: প্রথম বার্তা সৌম্য মুখার্জী প্রথম দিন স্কুলে ঢুকেই বুঝেছিল, এই স্কুলটা একটু অন্যরকম। শান্তিনিকেতনের সীমানা ছুঁয়ে থাকা এই পুরনো হাইস্কুলটির নাম ‘চৈতন্য বিদ্যামন্দির’, তবে গেটের ওপরে নামটা আধফাটা, আর নিচে একটা ছেঁড়া ব্যানারে আজও ঝুলছে গত বছরের নববর্ষের শুভেচ্ছা। স্কুলের বিল্ডিংটা অনেক পুরোনো, লাল ইটের দেয়াল আর কড়ি-পাতার ছাদ। অথচ, ভেতরের পরিবেশে একটা অদ্ভুত স্তব্ধতা। যেন কেউ কথা বলতে ভয় পায়। যেন স্কুলটা চুপচাপ নিঃশব্দে কোন কিছু লুকিয়ে রাখছে। সৌম্য বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করে সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে, ইংরেজি পড়ায়। নিজের মধ্যেই গম্ভীর স্বভাব, কিন্তু আজ সকাল থেকেই বুকের ভেতর টানটান অস্বস্তি। প্রিন্সিপাল রুমে বসে থাকা মাঝবয়সী…
-
অভিজিৎ দাস পর্ব ১: আগমনী কলকাতার বিখ্যাত নাট্যদল ‘অভিনয়নগর’ তাদের পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে শহরের বাইরে একটা থিয়েটার রিট্রিটের আয়োজন করেছিল। স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল বিষ্ণুপুর—ইতিহাস আর সঙ্গীতের শহর। সেখানে গিয়ে নাটকের মহড়া, স্ক্রিপ্ট রিডিং, ওয়ার্কশপ, আর প্রকৃতির মধ্যে কিছুটা সময় কাটানো—এই ছিল উদ্দেশ্য। দলের অন্যতম প্রবীণ সদস্য অভিজিৎদা বলেছিলেন, “বিষ্ণুপুরে একটা পুরনো রাজবাড়ির মন্দির আছে। বহুদিন কেউ যায় না, একটু ভৌতিক, কিন্তু জায়গাটা একেবারে থিয়েটার-যোগ্য।” সবার কৌতূহল জাগল। নাটকের ছায়া পড়ার জন্য এমন পরিবেশই তো চাই। রওনা হয়েছিল দশজন—আটজন অভিনেত্রী, একজন মেকআপ আর্টিস্ট, আর রুদ্র—স্ক্রিপ্ট লেখক এবং নির্দেশক। দলটির গঠন ছিল যেন এক থ্রিলারের চাবিকাঠি। সকলেই নিজস্ব জীবনযন্ত্রণা…
-
ইমন দে পর্ব ১ শিলিগুড়ির দক্ষিণ চৌরঙ্গী এলাকায় একটা পুরনো দোতলা বাড়ি। লাল ইটের সেই বাড়িটা বেশিরভাগ সময়ই নির্জন। দিনের বেলায় স্থানীয়রা পাশ কাটিয়ে যায়, রাত হলে কেউই পথ মাড়ায় না। লোকজন বলে, বাড়িটার পাশের গলিতে মাঝরাতে কার যেন হেঁটে যাওয়ার শব্দ শোনা যায়, আবার জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় এক মেয়ের মুখ—মাথায় লাল ঘুঙুরের টিপ, চোখে নিঃশব্দ আর্তি। এই এলাকাতেই নবাগত পরিবার দত্তরা নতুন ভাড়া নিয়েছে। রণদীপ দত্ত, তার স্ত্রী পৌলমী এবং একমাত্র মেয়ে রিয়া। পৌলমীর স্কুলে চাকরি হয়েছে, আর রণদীপ ব্যাঙ্কে। বাড়িভাড়া কম, চারপাশে গাছপালা, তাদের বেশ ভালোই লেগেছিল। প্রতিবেশীরা প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে আর কিছু বলেনি।…