সৌম্যদীপ হালদার অধ্যায় ১ : অজানার ডাক কলকাতার ভিড়ভাট্টা আর নিরন্তর দৌড়ঝাঁপের মধ্যে তরুণ নায়কের দিনগুলো যেন ক্রমশ একরঙা হয়ে উঠছিল। প্রতিদিনের সকালে অ্যালার্মের কর্কশ শব্দ, অফিসের ফাইলের পাহাড়, এবং রাতের শেষ প্রহরে ফাঁকা বারান্দায় সিগারেটের ধোঁয়া—সবকিছুই যেন তাকে এক অদৃশ্য শিকলে বেঁধে ফেলেছিল। কলেজজীবনে সে যে স্বপ্ন দেখেছিল—দূরদেশের পাহাড়ে চড়বে, অচেনা জনপদে রাত কাটাবে, নক্ষত্রভরা আকাশের নিচে নিজের হারিয়ে যাওয়া সত্তাকে খুঁজবে—সেই স্বপ্নগুলো এখন কেবল পুরনো ডায়েরির পাতায় বন্দি। একঘেয়েমির এই জীবন তার ভেতরের কৌতূহল, দুঃসাহস, আর স্বাধীনতার তৃষ্ণাকে ধীরে ধীরে নিভিয়ে দিচ্ছিল। একদিন হঠাৎ বিকেলের অচেনা বৃষ্টি আর মেট্রোরেল স্টেশনের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে সে অনুভব করল, শহরের এই…
-
-
সৌমিলি দত্ত চন্দননগরের আলো উৎসবের রাতটি এক অন্যরকম জাদু উপহার দিচ্ছিল। নদীর ধারে ছড়িয়ে থাকা রঙিন আলো যেন জলরাশিকে আলোকিত স্বপ্নের মতো পরিণত করেছে। প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি রাস্তা, এমনকি ছোট্ট সরু গলিগুলোও আলোতে ভেসে ওঠে—লাল, নীল, হলুদ আর সবুজ রঙের ঝলমলে বাতিগুলো এক ধরনের মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। ফরাসি স্থাপত্যে ভরা পুরনো ভবনগুলো তাদের ঐতিহাসিক সৌন্দর্য ধরে রেখেছিল, কিন্তু রাতের আলো তাদের আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। সেতার আর ঢোলের সুর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছিল, যেন প্রতিটি সুর বাতাসে মিলেমিশে নাচছে। লোকেরা উৎসবমুখর, হাসি-আনন্দে ভরা, আর প্রতিটি মানুষের মুখে এক অদ্ভুত উত্তেজনা আর আনন্দের ছাপ। শহরটি যেন এক জীবন্ত চিত্রকর্ম হয়ে উঠেছে,…
-
অরিত্র কুন্ডু ১ দীর্ঘ দিনের যাত্রা শেষে ভ্রমণকারী যখন খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে এসে পৌঁছাল, তখন সূর্যের আলো ফিকে হয়ে আসছে, আকাশে ধূসর-নীল রঙের সন্ধ্যার আভা মিশে আছে। চারপাশে এক অন্যরকম নীরবতা, যেন পাহাড়ের বুকজুড়ে সময় থেমে আছে শুধু তার জন্য। পথজুড়ে ছোট ছোট ঝোপঝাড়, ঢেউ খেলানো সবুজের সমুদ্র আর বাতাসে ভেসে আসা অচেনা ফুলের গন্ধ তাকে এক অদ্ভুত স্বস্তি এনে দেয়। ভ্রমণের ক্লান্তি যেন মুহূর্তে মুছে যায় এই অপার্থিব দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে। দূরে সবুজে ঢাকা পাহাড়ের কোল, ঝরনার ঝিরঝির শব্দ আর কুয়াশার চাদরে মোড়া ছোট্ট গ্রাম তাকে এক মুহূর্তে অন্য জগতে টেনে নেয়। গ্রামের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়, এ…
-
অরিন্দম পাত্র প্রতিদিনের মতো সেই একঘেয়ে সকাল, অফিসে পৌঁছনোর আগে ট্রেনের দোল, ট্রামের ঘণ্টা, রাস্তায় অসংখ্য মানুষের ভিড় আর অসহনীয় শব্দে ভরা একটা শহর—কলকাতা। অফিসের কাজ, ক্লায়েন্টের ফোন, মিটিংয়ের চাপ সব মিলে তার দিন যেন একই ছকে বাঁধা। জানলার বাইরে উঁচু বিল্ডিং আর ধুলোভরা রাস্তাই তার প্রতিদিনের দৃশ্য। কিন্তু আজ যেন ক্লান্তি একটু বেশি, কপালের ভাঁজ একটু গভীর, আর বুকের ভেতর এক অদ্ভুত অস্থিরতা। ঘড়ির কাঁটা অফিস ছুটির সময় ছুঁতেই সে ব্যাগটা কাঁধে তোলে, কিন্তু হঠাৎই মন বলে দেয়—না, আজ সোজা বাড়ি ফেরা হবে না। প্রতিদিনের সেই রুটিনে হাঁটতে হাঁটতে তার ভেতরে জমা হচ্ছে একটা অজানা শূন্যতা, আর আজ সেই…
-
অনিন্দিতা কর্মকার এক মেঘলা সেনগুপ্ত কলকাতার ভিড়ভাট্টার ভেতর থেকে ট্রেনে উঠে বসেছে শিলাইদহের উদ্দেশ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী সে, বয়স একুশ, চোখে অগণিত প্রশ্ন ও স্বপ্নের ভিড়। বইয়ের পাতায় পড়ে এসেছে রবীন্দ্রনাথের কথা, পদ্মার ধারে তাঁর কুঠিবাড়ির গল্প, কবিতার জন্মের রহস্য, কিন্তু আজ সে যেন সেই সব গল্পের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাবে। ট্রেনের কামরায় বসে জানলার বাইরে তাকাতেই মেঘলার চোখে ধরা দিল অচেনা অথচ আপন গ্রামবাংলার চিত্র। দূর থেকে দেখা যায় বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, সবুজের ঢেউ, কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটা কৃষক, শাড়ি পরে মাথায় ঘড়া তোলা নারী—সব যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। কলকাতার ব্যস্ত শহর থেকে আসা মেঘলার কাছে এই দৃশ্য যেন…
-
ঋত্বিক দত্ত পার্ট ১: যাত্রার প্রথম সকাল শহরের ভিড়ভাট্টা থেকে সমুদ্রের দিকে যাত্রা শুরু করার মুহূর্তটাই যেন এক অদ্ভুত মুক্তি। কলকাতা বিমানবন্দরের জানালার কাচের ওপার থেকে ভোরবেলা আকাশের নীলচে আলো যখন সোনালি হতে শুরু করছিল, তখন আমার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক উৎকণ্ঠা কাজ করছিল। দীর্ঘদিন ধরে স্বপ্ন দেখেছিলাম আন্দামান যাওয়া হবে—কেবল হাভলক বা নীল দ্বীপের সমুদ্রস্নান নয়, আমি চেয়েছিলাম খুঁজে বের করতে অজানা এক কোণ, যেখানে পর্যটকদের কোলাহল নেই, নেই রঙিন বিজ্ঞাপনমাখা হোটেলের ছায়া, আছে কেবল নির্জনতার ঘন অরণ্য আর সমুদ্রের শ্বাস। বিমান মেঘ কাটিয়ে নামতে শুরু করতেই জানালার বাইরে নীলের উপর সবুজের ছোপ দেখা গেল। দূর থেকে যেন অসংখ্য…
-
শ্রীজিত বন্দ্যোপাধ্যায় ট্রেন ছাড়ার হুইসেল যখন শিয়ালদহ স্টেশনের কোলাহল কেটে রাতের নিস্তব্ধতাকে চিরে দিল, তখন আমি জানলার পাশে বসে সামনের সাত দিনের চিন্তায় ডুবে ছিলাম। ব্যাগে জুতসই জামাকাপড়, হাতে একটা নোটবুক, মাথায় শুধু একটাই ইচ্ছা—নিজেকে একটু খুঁজে পাওয়া। নামটা আগেই ঠিক ছিল—কালিম্পং। দার্জিলিং, কার্শিয়াং, মিরিক ঘুরে ফেলেছি অনেকবার, কিন্তু এই পাহাড়ি শহরটা আমার কাছে ছিল এক রহস্য। ট্রেন ছুটছে—কাঁচের বাইরে শহরের আলো এক এক করে ফিকে হয়ে আসছে। পাশে বসা সত্তরোর্ধ্ব ভদ্রলোক হঠাৎ কথা বলে উঠলেন, “উত্তরবঙ্গে যাচ্ছেন?” আমি হেসে বললাম, “হ্যাঁ, কালিম্পং।” তিনি চোখ মুছলেন, “কালিম্পং মানে আমার শৈশব। আপনার ভালো লাগবে, খুব ভালো।” রাত বাড়ছে, ট্রেন এগোচ্ছে শিলিগুড়ির…