শৌনক দে গ্রামের সীমানা অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে অনিরুদ্ধ সেন অনুভব করলেন যে, এখানে কোনো সাধারণ শীতলতা নেই; বরং এক অদ্ভুত শীতলতা আছে, যা হাড় কাঁপানোর মতো ঠান্ডা না হলেও, মনকে স্থির করে, চুপচাপ করে রাখে। গ্রামটি চুপচাপ, রাস্তার ধুলো উঠছে নিঃশব্দে, এবং বাতাসে যেন অদৃশ্য কোনো দমনের গন্ধ ভাসছে। গ্রামের মানুষের চোখে এক অদ্ভুত আতঙ্ক, যা তাদের মুখের হাসিকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। তারা খুব সাবধানভাবে চলাফেরা করে, যেন কোনো অদৃশ্য চোখ তাদের প্রতি তাকিয়ে আছে। অনিরুদ্ধ একটি ছোট কুঁড়েঘরের কাছে রিকশা থামালেন, যেখানে গ্রামের মানুষ সাধারণ জীবনযাপন করছে বলে মনে হলেও, তাদের আচরণে যেন প্রতিটি মুহূর্তে এক অনিশ্চয়তার চাপ…
-
-
১ বৃষ্টির রাত। এমন এক বৃষ্টি, যা যেন শুধু রাতের নীরবতা চুরমার করে দিতে আসে। সরলা দেবী জানালার পাশে বসে পুরনো কাঠের দোলনায় আস্তে আস্তে দুলছেন। তাঁর সামনে ছোট টেবিলে রাখা একটি মাটির প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছে, এবং তার পাশে রাখা একটি ফ্রেম করা ছবি—অমিতের, তাঁর একমাত্র ছেলে, যিনি গত তিন বছর আগের এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এখনো সেই দিনটার কথা ভাবলে সরলার বুকের মধ্যে একধরনের ঠান্ডা ঢেউ খেলে যায়। ছেলের শেষ জন্মদিনের সময় তোলা ছবি—চোখে হাসি, মুখে আত্মবিশ্বাস, যেন বলছে, “মা, আমি আছি তো!” অথচ সেই হাসির পেছনে কি লুকিয়ে ছিল কোনো গোপন কথা? কিছুদিন ধরে সরলার মনে…
-
ছত্তিসগড়ের গভীর জঙ্গলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। চারদিকটা যেন অদৃশ্য কোনো চাপা রহস্যে ঘেরা—গা ছমছমে নিরবতা, ঘন কুয়াশা আর মাঝে মাঝে শোনা যায় অজানা পাখির ডানার শব্দ। ডঃ নীলয় সেনগুপ্ত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান, জিপ থেকে নেমেই চারপাশটা একবার ঠান্ডা চোখে স্ক্যান করলেন। পিছনে তাঁর দলের বাকি সদস্যরা: তরুণ তথ্যচিত্র নির্মাতা অরিন্দম পাল, প্রত্নতাত্ত্বিক চিত্র বিশারদ ডঃ শ্রুতি দত্ত, ইতিহাসের গবেষক তনুশ্রী মুখার্জী এবং স্থানীয় গাইড兼ফিল্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট রাহুল কোসলে। তাঁরা আজ যে জায়গায় এসে পৌঁছেছেন, তার হদিশ পেয়েছিলেন কিছু দুর্লভ আদিবাসী নকশা বিশ্লেষণ করে। কথিত আছে, এই নির্জন জঙ্গলের মধ্যেই আছে এক প্রাচীন মন্দির, যার অবস্থান এতদিন…
-
তন্ময় লাহিড়ী নবান্নের আগে বর্ষা থেমে গিয়েছিল, কিন্তু গ্রামের কাঁচা রাস্তা এখনও স্যাঁতসেঁতে। হালকা কুয়াশায় মোড়া মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে সাব্যসাচী রায় তাকিয়ে ছিল ভগ্ন জমিদারবাড়িটার দিকে। ক’টা জানালার কাঁচ নেই, ছাদে আগাছার রাজত্ব, আর দেয়ালগুলোয় গাঢ় সবুজ শ্যাওলা লেপে আছে—তবু, সেই কুঠির যেন সময়ের ভিতর দাঁড়িয়ে আছে এক অমোচনীয় অভিযোগ নিয়ে। শহর কলকাতার জীবন থেকে দূরে, বহু বছর পর সে আবার ফিরে এসেছে বাপ-ঠাকুর্দার ভিটেয়—কিন্তু এভাবে? কুড়িয়ে পাওয়া এক পুরনো চিঠির টানে, যেখানে লেখা ছিল—“কুঠির জেগে উঠেছে, সাব্যসাচী, ফিরে আয়।” পাঠিয়েছিলেন ভবানী দাসী, যিনি তার ছোটবেলায় তাদের বাড়িতে কাজ করতেন, এখন একা থাকেন গ্রামের উপান্তে। সাব্যসাচীর মধ্যে একটা অদ্ভুত টান…
-
অনুপমা চ্যাটার্জী এক নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ, ঠান্ডা কলকাতা নিজের ছায়া ধীরে ধীরে ছড়িয়ে দিচ্ছে শহরের কোণায় কোণায়। সন্ধের আলো মিশে যাচ্ছে গলির অন্ধকারে। দেবাঞ্জন ঘোষাল, সবে মাত্র শেষ করল তার ফটোগ্রাফি অ্যাসাইনমেন্ট — এক পুরনো হাভেলির ধ্বংসপ্রাপ্ত দরজার ক্লোজআপ, ছেঁড়া পর্দার ফ্রেমে বন্দী বিকেলবেলার সূর্য। তার ক্যামেরা ব্যাগ কাঁধে ঝুলে আছে, পায়ে এক ক্লান্ত অথচ সন্তুষ্ট হাঁটা। হ্যারিসন রোড ধরে উত্তরদিকে হেঁটে চলেছে, উদ্দেশ্য কোনো চায়ের দোকান খুঁজে গরম পানীয়ে ঠান্ডা হাড়কে কিছুটা আরাম দেওয়া। কিন্তু গলির এক মোড়ে পৌঁছেই সে থেমে যায়। এক অচেনা রকমের নীরবতা তাকে টেনে ধরে, যেন সময় হঠাৎ থেমে গেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা একজন নারী—কালো…
-
অধ্যায় ১ ড. শৌনক ভট্টাচার্য বসেছিলেন নিজের স্টাডি রুমে, জানলার বাইরে কুয়াশা নামছিল ধীরে ধীরে। কলকাতার ডিসেম্বরে এমন হিমেল সন্ধ্যা যেন তার প্রিয় — নিঃশব্দে পুরনো বইয়ের পাতা উল্টে দেওয়ার মতো। কাঁপা আলোয় টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিল কিছু নীলচে বিবর্ণ মানচিত্র, কয়েকটি পুরনো পাণ্ডুলিপি আর একটি হলুদ হয়ে যাওয়া খাম। সেই খামের ভেতর থেকে বেরিয়ে ছিল একটি চিঠি, যা সম্ভবত ১৯২০ সালের দিকে লেখা — পাঠক ছিল ‘নলিনীপ্রসাদ ভট্টাচার্য’, যিনি ছিলেন তাঁর প্রপিতামহ। চিঠিতে লেখা ছিল এক প্রাচীন শহরের নাম — ‘বোধানগর’। শহরটির নাম ইতিহাসে প্রায় উধাও, কিন্তু লোককথায় মাঝেমাঝে ওঠে আসে; বলা হয়, “বোধানগর আজও জেগে ওঠে কাঁদতে।” শৌনকের…
-
বোধিসত্ত্ব চক্রবর্তী (১) কলকাতার নারকেলডাঙার থানায় সদ্য বদলি হয়ে আসা অফিসার অরিত্র বসু জানতেন না, এই বদলি তার জীবনের সব যুক্তি-পরম্পরাকে ভেঙে দেবে। সেই সময় বর্ষা শেষের দিন, আকাশে ছাইরঙা মেঘের স্তর ঝুলছে। সকালবেলা থানায় বসেই অরিত্রর হাতে এসে পড়ে এক বিশেষ চিঠি—দক্ষিণ ২৪ পরগণার এক প্রত্যন্ত গ্রাম ‘ছায়ামাটি’তে পরপর তিন বছর একদিনে আগুন লেগে গেছে, গ্রামের একাংশ ছাই হয়ে গেছে, এবং আজও কেউ জানে না কেন বা কীভাবে। চিঠির নিচে স্বাক্ষর করেছেন ডি.এস.পি. গগন সরকার—অরিত্রকে বলা হয়েছে, ঘটনাটি তদন্ত করে বিস্তারিত রিপোর্ট জমা দিতে হবে। অরিত্র প্রথমে ভাবলেন, এ তো ফায়ার ব্রিগেডের ব্যাপার, পুলিশের কী? কিন্তু পড়তে পড়তে চোখ…
-
মনোরঞ্জন পাল ১ চন্দননগরের সেই বিকেলটা ছিল একেবারে অন্য রকম। গরম আর স্যাঁতসেঁতে বাতাসে ভরা বাতাবরণে অরিজিৎ সেনগুপ্তের শরীর বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল, কিন্তু তার মন পড়ে ছিল প্রাসাদের ভেতরের অজানা ইতিহাসে। ট্রেন থেকে নেমে রিকশায় চড়ে আসা পথটুকুতে সে শহরের ফরাসি স্থাপত্যের ছাপ লক্ষ্য করছিল—ভাঙা কলাম, জং ধরা ল্যাম্পপোস্ট, আর গঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অতিকায় প্রাসাদ, যা যেন কালের ভারে নুয়ে পড়েছে। বাড়িটার বিশাল লোহার ফটক খুলে যাওয়ার শব্দ শুনে তার হৃদয়ে কেমন যেন অজানা শিহরণ জাগল। সে ভাবল, এমন একটা জায়গা, যেখানে ইতিহাস ঘুমিয়ে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, সেখানে নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে কোনো অজানা রহস্য, কোনো…