নীলাদ্রি দে এক হাসপাতালের বহির্বিভাগের করিডোরে হাঁটছিলেন ড. অর্ণব মুখার্জী, সবে মাত্র দুপুর গড়িয়েছে। এক হাতে কফির কাপ, অন্য হাতে মেডিকেল ফাইল। এই হাসপাতালেই তিনি রেডিওলজি বিভাগের প্রধান, গত আট বছর ধরে। সবকিছুই যেন রুটিনের মতো চলছিল, যতক্ষণ না রিসেপশন থেকে ফোন আসে—“ডাক্তারবাবু, একজন নতুন রোগী এসেছেন, বুকের ব্যথা নিয়ে, কিন্তু একটু অদ্ভুত আচরণ করছেন।” ড. অর্ণব চোখ কুঁচকে রুমে ঢুকলেন। রোগীর নাম রোহিত সেন, বয়স আনুমানিক সাতাশ-আটাশ, স্মার্ট পোশাক, চুপচাপ চোখ। প্রথমে দেখে মনে হয় না খুব গুরুতর কিছু, তবে রোহিতের চোখদুটো যেন ঘুমহীন আতঙ্কে ধকধক করছিল। প্রশ্নের জবাব দিল সংক্ষেপে—“বুকটা মাঝে মাঝে এমন টান মারে, যেন কেউ ভিতর…
-
-
কলকাতার উত্তরে অবস্থিত “চন্দ্রমোহন কলেজ”-এর হোস্টেলটা শহরের মধ্যে হলেও একেবারে বাইরের অংশে পড়ে। চারদিকের কোলাহলের মধ্যেও হোস্টেলের গেট পেরোনোর পরেই যেন এক অদ্ভুত নীরবতা আচ্ছন্ন করে রাখে জায়গাটাকে। পুরনো লাল ইটের বিল্ডিং, জংধরা লোহার গ্রিল, আর হোস্টেলের চারপাশে ছড়ানো অশ্বত্থ ও কৃষ্ণচূড়ার গাছগুলো যেন দিনের বেলাতেও ছায়া ফেলে রাখে আশপাশে। সোহম মুখার্জি, সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া ছাত্র, বাবা-মায়ের সঙ্গে এসে উঠল ওই হোস্টেলে। তার সঙ্গে একই ঘরে থাকবে রাহুল দে, ওর স্কুলজীবনের বন্ধু, আর তুষার সাহা — এক আধুনিক, সদ্য দেখা হওয়া ফেসবুক-বন্ধু। রুম নম্বর ৭ — তিনতলার এক কোণে, যেটা দেখে মনে হয় অনেক বছর কেউ পরিষ্কার করেনি। সিলিং…
-
শুভ্রনীল দে ১ নতুন শহরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো দোতলা বাড়িটা প্রথম থেকেই ইরার ভালো লাগেনি। বাইরে থেকে একরকম, ভেতরে ঢুকলেই মনে হয়, সময় যেন এখানে আটকে গেছে— দেওয়ালের ছোপ ধরা রঙ, কাঠের সিঁড়ির আর্তনাদ, আর অলিন্দে সারাদিনই একটা চাপা ছায়া। ইরার মা স্মিতা এক বড়ো কোম্পানিতে কাজ করে, রাতে দেরি হয় প্রায়শই, ফলে স্কুল থেকে ফিরে ইরাকে বেশিরভাগ সময় একাই কাটাতে হয়। প্রথম কয়েকদিন তেমন কিছু মনে হয়নি— নতুন স্কুল, নতুন পাড়া, নিজের ছোট একটা ঘর— সবকিছু মিলিয়ে একরকম উত্তেজনা ছিল। কিন্তু ঠিক সপ্তম দিন রাতে শুরু হয় প্রথম অস্বস্তি। রাতে ঘুম ভেঙে যায়, পাশে টেবিল ঘড়ির কাঁটায়…
-
দেবজয় ঘোষ (এক) কলকাতার উত্তর শহরের শোভাবাজার অঞ্চলে শীতকাল প্রবেশ করার আগেই বাতাসে একটা অদ্ভুত শিরশিরে অনুভব জাগে — যেন গলির অন্ধকার কোণাগুলো আরও গভীর হয়, পুরনো বারান্দাগুলো থেকে ছায়ারা লাফিয়ে পড়ে রাস্তায়। সেই শহরেরই এক কোণে, চৌবাগান স্ট্রিটের শেষ প্রান্তে পড়ে থাকা একটি পুরনো, বন্ধ হয়ে যাওয়া দুর্গা মণ্ডপ — “মিত্র চৌধুরী পরিবার মণ্ডপ” নামে পরিচিত — আজও বেঁচে আছে স্মৃতির মধ্যে, কিন্তু সকালের আলোয়ও কেমন ছায়াচ্ছন্ন লাগে। ঋদ্ধিমা রায়, কলকাতার এক সাহসী তদন্তকারী সাংবাদিক, বহুদিন ধরে এই স্থানটির গুজব নিয়ে শুনে এসেছে— আশ্বিন মাসের প্রতি দশমীর রাতে এখানে ঘটে কিছু অলৌকিক, তান্ত্রিক আচার, যেগুলোর স্বাক্ষী শুধু বাতাস আর…
-
সুব্রত ভট্টাচার্য অধ্যায় ১: লাল মাটির ছায়া বাঁকুড়ার শেষ প্রান্তে পাহাড়পুর যেন একটা ঘুমন্ত ছবি—যেখানে সময়ের গতি থেমে গেছে। লালমাটির আঁকাবাঁকা পথ, থমথমে গাছপালা আর দিনের আলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিস্তব্ধতা যেন দখল নেয় চারপাশ। গ্রামের ঠিক মাঝখানে, এক পুরনো পাকাঘর—মাটির দেওয়াল কাঁচা, চালের উপর শুকনো ধানখড় আর ধোঁয়াটে ছাপ। এখানেই থাকেন শশাঙ্ক দাস, এক সময়কার ইতিহাসের শিক্ষক, এখন গ্রামের প্রবীণতম মুখ। দিনের আলোয় তিনি মাটির উঠোনে বসে পুরনো কাগজ ঝাড়েন, আর সন্ধ্যেবেলা কুপি জ্বালিয়ে গল্প বলেন গ্রামের ছেলেমেয়েদের। এই গ্রামটা কেবল মানুষ নিয়ে গঠিত নয়, তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে আছে অলক্ষ্য ছায়া—গাছের খোলে, মাটির নিচে, বাতাসের গন্ধে। সেদিন সন্ধেয়,…
-
রূপক হালদার অধ্যায় ১ মুর্শিদাবাদের শেষপ্রান্তে, ভগ্নপ্রায় এক জমিদারবাড়ি — ‘নির্বাণ ভিলার’ — দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের শোকস্তব্ধ কঙ্কালের মতো। ছায়ায় ঢাকা তার প্রবেশপথ, দেয়ালজুড়ে শ্যাওলা আর বিস্মৃতির ছাপ। প্রত্নতত্ত্ববিদ অচিন্ত্য লাহা এই বাড়ির কথা প্রথম শোনেন পুরাতন নথিপত্র ঘাঁটতে গিয়ে—বর্ণনা ছিল সংক্ষিপ্ত: “রায়চৌধুরী রাজপরিবারের ধ্বংসপ্রাপ্ত ভিলা, অচেনা এক আয়নার রহস্য।” এতেই কৌতূহলের জন্ম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী অচিন্ত্য, যিনি বিলেতে প্রত্নবিদ্যার উপর ডক্টরেট করে ভারতের একাধিক প্রাচীন নিদর্শন উদ্ধার করেছেন, এমন রহস্যময় বর্ণনা উপেক্ষা করতে পারলেন না। ভরা গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে, তিনি পৌঁছালেন সেই জমিদারবাড়ির সামনে—ক্যামেরা, স্কেচবুক, কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি আর এক বুক ইতিহাস-জিজ্ঞাসা নিয়ে। কেয়ারটেকার মাধবচরণ, একটি শীর্ণকায় বৃদ্ধ, প্রায় নিঃশব্দে…
-
অনির্বাণ ঘোষ পর্ব ১ চামেলী মেমসাহেবের বাংলোটা অনেকদিন পর আবার দেখতে এলাম। ঠিক যেমনটা ছোটোবেলায় দাদুর হাত ধরে প্রথম দেখেছিলাম, অনেকটা তেমনই রয়ে গেছে—আধাভাঙা লাল ছাদের দোতলা কাঠের বাড়ি, সামনের দোলা চেয়ারে শিকল পড়ে আছে, বারান্দার রেলিং ধরা ধরেই বুনো লতা উঠে গেছে ছাদের কিনারা ছুঁয়ে। কুয়াশায় মোড়া রাস্তা ধরে গাড়িটা যখন বাঁক ঘুরে বাংলোর সামনে এসে দাঁড়াল, তখন সূর্য পাহাড়ের পেছনে হারিয়ে যেতে বসেছে। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশে একটা ফিকে কমলা রেখা, আর পাখিরা গাছপালা ছেড়ে ফিরে যাচ্ছে কোথাও। আমি অর্ণব, বয়স তিরিশ ছুঁই ছুঁই। কলকাতায় একটা কর্পোরেট কোম্পানিতে চাকরি করি, জীবন বলে কিছু তেমন আর অবশিষ্ট নেই,…
-
ঋত্বিক বসু ১ শীতকাল তখন ঠিক জমে ওঠেনি, তবে পাহাড়ি হাওয়ায় একটা ঝাঁঝালো ঠান্ডা সকাল নিয়ে হাজির হয়েছিল অভিষেক দাশগুপ্ত। দার্জিলিঙের চৌরস্তা থেকে আরও পঁচিশ কিলোমিটার উপরের দিকে, ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্রাম — ‘চাংথাং’। কেউ শোনেনি শহরে এই গ্রামের নাম, আর যারা শুনেছে, তারা এটাকে এড়িয়ে গেছে বছরের পর বছর। অভিষেক কিন্তু ইচ্ছা করেই এখানে এসেছে। কলকাতার এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞ লোকজ বিশ্বাস ও লোকশ্রুতি নিয়ে। উত্তরবঙ্গের গা ছমছমে প্রাচীন গল্প-গাথা নিয়ে একটা গবেষণাপত্রের কাজ চলছে তার। এই চাংথাং গ্রামের কথা সে প্রথম শুনেছিল একটি অজানা তিব্বতি চিঠিতে, যেটা পাওয়া গিয়েছিল সিকিম সীমান্তের এক পুরনো গুহায়, সঙ্গে একটা…
-
শুভদীপ দাস ১ কলকাতার সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর এক কোণে লুকিয়ে থাকা সেই বুথটা আজও দাঁড়িয়ে আছে—একটি মৃত সাক্ষীর মতো, শহরের কোলাহলের মাঝেও তার গায়ে নেমে আছে এক নিস্তব্ধতার আবরণ। রাস্তার পাশে এক পুরনো বাজারের পেছনে, ছোট্ট একটা গলিতে ঢুকলে চোখে পড়ে সেই ভাঙা টেলিফোন বুথটি—যার কাচ অর্ধভাঙা, ভিতরে ধুলো জমে ছাইয়ের মতো বসে আছে, আর তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাগজের ঠোঙা, পচা ফলের খোসা, আর মাঝে মাঝে ভবঘুরে বিড়ালদের বিশ্রামের স্থান। অনেক বছর ধরেই কেউ ওখানে ফোন করতে আসে না, কারও দরকার পড়ে না এমন একটা প্রযুক্তির যা এখন কেবল ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে। তবুও, রাত বারোটার পর, ঠিক নির্দিষ্ট একটা…
-
অমিয় দাসগুপ্ত 📜 অধ্যায় ১ বীরভূমের বুক চিরে যে সরু মেঠো পথগুলো কুড়ুলগাছ, শিমুলগাছের ছায়ায় মিশে গেছে শূন্যের অতলে, সেই পথে রাতের নিস্তব্ধতায় শুধু শোনা যায় দূরের শিয়ালের ডাক আর ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা সুর। সেদিনের রাত যেন আর পাঁচটা রাতের মতো নয়। পূর্ণিমার আলোয় ভিজে থাকা সেই রাত কেমন এক গা ছমছমে হাওয়ায় কেঁপে উঠছে বারবার। মহলপুরের সেই বিশাল প্রাসাদ—যার উঁচু মিনারগুলো আকাশ ছুঁয়েছে, যার সিংহদ্বারে দু’পাশে পাথরের বাঘ দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে, যার অন্দরমহলের অজস্র জানালা দিয়ে মৃদু বাতাস ঢুকে পড়ছে, সেই প্রাসাদের মধ্যে জ্বলছে শুধুমাত্র দুটি প্রদীপ। জমিদার অনন্ত নাথ রায় একাকী বসে আছেন দোতলার দক্ষিণ কোণের…