সুদীপ্ত পাল ১ অর্পণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনে এই মুহূর্তটি ছিল এক অদ্ভুত উত্তেজনা এবং অস্থিরতার মিশ্রণ। তার দীর্ঘদিনের গবেষণার অবসানপ্রাপ্তি তাকে এক নতুন অভিযানে নিয়ে আসছে—পুরুলিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলের গভীরে লুকানো একটি প্রাচীন নগরীর সন্ধানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির আবর্জনায় তিনি বহু পুরনো মানচিত্র এবং বিভিন্ন ধরণের প্রাচীন খণ্ডচিত্র পরীক্ষা করেছিলেন। নিখুঁত বিশ্লেষণ এবং শতাধিক নথি পরীক্ষা করার পরও নগরীর অবস্থান আজও রহস্যময় ছিল। কিন্তু স্থানীয় গ্রামবাসীদের মুখে ছড়িয়ে থাকা কাহিনী এবং মূর্তিভঙ্গিতে উপস্থিত সতর্কবার্তাগুলি তাকে ভয় দেখাতে পারেনি; বরং প্রতিটি গল্পে লুকানো রহস্য তাকে আরও উত্তেজিত করে তুলেছিল। গ্রামের বৃদ্ধরা বলেন, “যারা সেই বনপথে প্রবেশ করেছে, তারা আর ফিরে আসেনি, কিংবা ফিরে এলে…
-
-
অধ্যায় ১: অশরীরীর আগমন ধনপুর নামের ছোট্ট গ্রামটি যেন প্রকৃতির এক নিভৃত কোলে বসে আছে। শরৎকালের শুরুতে গ্রামজুড়ে এখন পুজোর প্রস্তুতি তুঙ্গে, মেঘের আড়াল থেকে নীল আকাশ উঁকি দিচ্ছে, কাশফুলে ঢাকা মাঠে বাতাসের খেলায় দুলছে সাদা ফেনার মতো শিরীষের তুলো। গ্রামের প্রাচীন ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রতি বছর দুর্গাপুজোর প্রতিমা গড়ার দায়িত্ব থাকে মৃৎশিল্পী নিবারণ পাল ও তাঁর পরিবারের হাতে। নিবারণের হাতে তৈরি মূর্তির খ্যাতি আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে বহু বছর ধরেই। গাঁয়ের মানুষ বিশ্বাস করে, নিবারণের আঙুলের ছোঁয়ায় যেন দেবীর জীবন্ত ছায়া ফুটে ওঠে। দিনভর কাদা মাটি আর রঙের ঘ্রাণে ভরা কর্মশালায় চারদিক গমগম করে, কিন্তু রাত নামলেই সে ঘর একেবারে…
-
উৎসব তরফদার ১ গ্রামের উত্তর প্রান্তে ভাঙাচোরা ইটের দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে সেই অদ্ভুত জমিদারবাড়ি—যেন সময়ের আঘাতে ক্ষয়ে যাওয়া এক প্রাচীন স্মারক। একসময় এখানে ছিল উজ্জ্বল আলো, অতিথিদের কোলাহল, শঙ্খধ্বনি আর ঢাকের তালে উৎসবের জোয়ার। আজ সবই ম্লান হয়ে গেছে। পুরু দরজায় মরচে, জানালার শিক ভাঙা, ঘাস-লতাপাতা ক্রমে ঢেকে ফেলেছে সিঁড়ির পাটাতন। দিনের বেলায়ও ভেতরে ঢোকার সাহস করে না কেউ, কারণ ভাঙা ছাদের ফাঁক দিয়ে আলো এলেও, ঘরগুলোতে যেন চাপা অন্ধকার জমে থাকে। অথচ এই অন্ধকারের মাঝেই আছে সেই রহস্যময় বাগান—যা এখনো গ্রামজুড়ে লোককথার বিষয়। বাড়ির পিছনের দিক থেকে শুরু হয়েছে এক বিশাল বাগান, যেখানে আজ আর নিয়মিত যত্ন হয়…
-
১ ঈশা দত্ত ট্রেনে দীর্ঘ যাত্রার পর যখন সুন্দরবনের ভেতরের ছোট্ট জনপদের ধুলোমাখা স্টেশনে নেমে এলো, তখন তার মনে হচ্ছিল যেন শৈশবের স্বপ্ন আর ভয় দুটো একসাথে হাত ধরে হাঁটছে। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে স্টেশন থেকে বেরোনোর সময় চারপাশের গন্ধটা প্রথমেই তাকে আঘাত করল—আধভেজা কাদা, নোনা বাতাস, গাছের পাতা, আর নদীর জলে লবণাক্ততার মিশ্র গন্ধ। এ সবকিছুর ভেতরে সে যেন শুনতে পাচ্ছিল অজস্র গল্পের প্রতিধ্বনি, যেগুলো ছোটবেলায় শোনানো হয়েছিল তাকে দাদার ঠোঁট থেকে। সেই জলমহল—এক ভগ্নপ্রায় জমিদারবাড়ি, নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ধেক ডুবে যাওয়া প্রাসাদ—যেটাকে নিয়ে লোকজন বলে অসংখ্য অদ্ভুত কথা। ঈশার মনে পড়ে গেল শৈশবের সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে থাকা, হাতে…
-
প্রনব কুমার সিনহা এক কলকাতার এক ব্যস্ত সন্ধ্যায়, শহরের কোলাহলের ভেতর থেকে অর্ণব সেনের মনটা যেন ছুটে যাচ্ছিল অন্য এক জগতে। তিনি পেশায় সাংবাদিক, কিন্তু নেহাত সংবাদ সংগ্রহ নয়, অর্ণবের আলাদা দুর্বলতা ছিল ইতিহাস ও লোককথার প্রতি। কলেজের সময় থেকেই তার অভ্যাস—শহরের পুরোনো ঘাট, অজানা গলি বা অচেনা গ্রামে গিয়ে স্থানীয় লোকেদের কাছ থেকে অদ্ভুত গল্প শোনা। সেদিনও একে একে রাত নেমে আসছিল বাগবাজার ঘাটে, হাওয়ায় ভেসে আসছিল ভেজা কাদার গন্ধ আর গঙ্গার জলে তরঙ্গের গুঞ্জন। সেই সময়েই হঠাৎ তার সঙ্গে পরিচয় হলো এক বৃদ্ধ নাবিকের, যার মুখে জড়ানো ছিল বহু বছরের লোনা জলের স্মৃতি। ঝাপসা চোখ, মুখে সাদা দাড়ি,…
-
এক গ্রামের নাম শালপুকুর। নদীর ধার ঘেঁষে, সবুজ ক্ষেত আর তালগাছে ঘেরা এই গ্রাম বরাবরই শান্ত, নিরিবিলি। কোলাহলহীন জীবনযাত্রায় মানুষজন এখনো প্রথা মেনে চলে। গ্রামের মাঝখানে একটি পুরনো পুকুর—যার নাম থেকেই গ্রামটির নামকরণ। শালগাছ আর পুকুরের শাপলা মিলেমিশে গ্রামটিকে সাজিয়ে রেখেছে অন্যরকম আবহে। আধুনিকতার ছোঁয়া খুব কমই পৌঁছেছিল এই গ্রামে। ইন্টারনেট ধরা দিত কেবল পাহাড়ি মেঘের মতো—কখনো আসত, আবার হঠাৎ হারিয়ে যেত। ঠিক এই কারণে সরকার ও মোবাইল কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে শালপুকুর গ্রামে একটি আধুনিক 5G টাওয়ার বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই গ্রামের মানুষজন প্রথমে খুশি হয়ে ওঠে। তারা ভাবে, অবশেষে তাদের ছেলে-মেয়েরা শহরের মতো ভিডিও কল করতে…
-
১ শান্তিনিকেতনের আকাশে সেই রাতে চাঁদের আলো ম্লান, যেন সেও কোনো অজানা শোকের আভাস বহন করছে। গ্রীষ্মের শেষ প্রান্তে শরতের হালকা শীতল হাওয়া এসে পৌঁছেছে, চারপাশে অদ্ভুত এক নীরবতা, মাঝে মাঝে শুধু দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। মজুমদার বাড়িটি লাল ইটের পুরনো দোতলা, চারদিকে শিউলি আর শিরীষ গাছ, যেগুলোর ছায়া পড়ে গেছে বাড়ির বারান্দায়। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ হঠাৎই ভেসে আসতে শুরু করল বেহালার সুর—এমন সুর, যা একদিকে কোমল অথচ তীব্র বেদনা বহন করছে। প্রতিবেশীরা প্রথমে ভেবেছিল অনিন্দ্যবাবু হয়তো নতুন কোনো রাগ নিয়ে পরীক্ষা করছেন, কারণ তিনি প্রায়ই গভীর রাতে সঙ্গীত চর্চা করতেন। কিন্তু এই সুরে ছিল অন্যরকম…
-
অভ্রজ্যোতি সেন ১ সকালবেলা কলকাতার হাওড়া ঘাটে জমে উঠেছিল এক অদ্ভুত রকম উত্তেজনা। পা ছুঁয়ে চলা কুয়াশার ফাঁক দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল একটি বড় ট্রলার, যার মাথায় লটকে থাকা লাল কাপড় বাতাসে কেঁপে উঠছিল। রুদ্র সেনগুপ্ত, ক্যামেরা ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, চোখে ছিল অদ্ভুত এক আলোকছায়ার খেলা। তার চোখে যেন শুধুই দ্বীপ, শুধু রহস্য। এই ডকুমেন্টারি তার জন্য শুধু পেশাদার প্রজেক্ট নয়, বরং এক অদ্ভুত টান—অজানা কিছুর ভিতরে পা ফেলার খিদে। তার সঙ্গেই ছিল ক্যামেরাপার্সন মৃণালিনী পাল—সবাই মিরা বলে ডাকে। চোয়াল শক্ত, চোখে নির্ভীকতা, যেন জঙ্গলও তাকে ভয় পায়। অর্কদীপ সাহা, যাকে সবাই অর্ক নামে জানে, সদা চঞ্চল, সাউন্ড রেকর্ডারের…
-
অরুণাভ মৈত্র ১ কলকাতার উত্তর শহর মানেই পুরনো দিনের ছাপ, সময়ের ধুলো জমে থাকা মেঝে, কাঠের জানালার ফাঁকে ঢুকে পড়া রোদের রেখা, আর সেইসব রাস্তা—যেগুলো একসময় কুচকাওয়াজ দেখেছে, আবার অন্যদিকে ত্রাস হয়ে উঠেছে নিঃসঙ্গ রাতে। এমনই এক গলির নাম ‘বটতলা লেন’। নামটা শুনলেই মনে পড়ে যায় বইয়ের পাতা, নাটকের পোস্টার, কিম্বা উনিশ শতকের বিপ্লবীদের গা ঢাকা দেওয়ার কাহিনি। কিন্তু এই গলির ইতিহাস শুধু কাগজে-কলমে নয়—এখানে অলৌকিকতার এক অদৃশ্য ছায়া যেন ছায়ার মতো ঘোরে। লোকে মুখে মুখে বলে, “এই গলিতে কিছু একটা আছে।” কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারে না কী—কেউ বলে রাত্তিরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর, কেউ বলে দরজার ফাঁক…
-
জয়ন্ত পাল ১ কলকাতার আকাশে সেদিন অদ্ভুত এক মেঘ ছিল, যেন কেউ কালির কুয়াশা ছড়িয়ে দিয়েছে শহরের উপর। দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়া মোড়ের চতুষ্পথে বিকেলবেলার ব্যস্ত ট্রাফিক হঠাৎ যেন স্তব্ধ হয়ে গেল, যখন এক ভবঘুরে মানুষ মাঝ রাস্তায় এসে দাঁড়াল। তার গায়ে ছিল মলিন গেরুয়া পোশাক, মাথাভর্তি উসকো চুল, আর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কেউ কেউ বলেছিল, সে হয়ত ভবঘুরে কোনও পাগল সাধু; আবার কেউ চোখ কপালে তুলে দেখছিল, তার চোখে যেন আগুনের ঝলকানি। লোকটা দুই হাত তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা জপতে লাগল, ভাষা বোঝা যাচ্ছিল না—কিন্তু আশেপাশে এক অদ্ভুত গুঞ্জন সৃষ্টি হচ্ছিল, যেন শব্দ নয়, ধ্বনি নয়, বরং সময়…