দেবব্ৰত মণ্ডল ১ গ্রামের প্রাচীন মন্দিরটির অবস্থান যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। জনবসতি থেকে খানিকটা দূরে, গা ছমছমে বটগাছের ছায়ায় ঢাকা পড়া এই মন্দিরের অস্তিত্ব আজও গ্রামের মানুষের কৌতূহল আর ভয়ের কেন্দ্রবিন্দু। শতবর্ষ আগে নির্মিত হয়েছিল এই দেবালয়—পাথরের খোদাই, দেয়ালে পুরনো লিপি আর ভাঙাচোরা অলঙ্করণ এখনো ম্লান হয়ে গেলেও স্পষ্ট করে বলে দেয় তার গৌরবময় অতীতের কথা। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে মন্দিরের মূল দ্বার, যেটি লাল রঙের বিশাল কাঠের কপাট দিয়ে বন্ধ, কখনোই খোলা হয়নি গ্রামবাসীর চোখের সামনে। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন, সেই লাল কপাট শত বছর আগে হঠাৎ একদিন বন্ধ হয়ে যায়, তারপর থেকে কেউ আর সাহস করেনি তা খোলার। বলা হয়,…
- 
				
 - 
				
উৎসব মুখার্জী মেদিনীপুর শহরের প্রান্তে যখন অর্ণবের ট্রেন এসে দাঁড়াল, তখন সকালের কুয়াশা এখনও পুরোপুরি কাটেনি। সে নেমে চারদিকে তাকাল—পরিচিত অথচ অচেনা লাগছিল জায়গাটিকে। ছোটবেলায় সে এখানে বহুবার এসেছে, মামার বাড়ি ছিল এই শহরে, কিন্তু তারপর থেকে কলকাতার ব্যস্ততা, পড়াশোনা, চাকরি আর শহুরে জীবনের দৌড়ঝাঁপ তাকে এই মাটির গন্ধ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। এখন আবার ফিরে আসার একটাই কারণ—তার বোন অনন্যা। বহু বছর আগে, অদ্ভুতভাবে অনন্যা হারিয়ে যায়। পরিবারে সেই ক্ষত আজও শুকোয়নি। বাবা-মা বোনের নাম শুনলেই কেঁদে ফেলেন, আর আত্মীয়রা চুপ করে যায়। অর্ণব একসময় চেষ্টা করেছিল খোঁজার, কিন্তু অল্প বয়সে তার কিছুই করার ছিল না। এখন যখন সে…
 - 
				
সৌম্য বক্সী অধ্যায় ১: রহস্যময় প্রাসাদের ডাক শহরের ব্যস্ততা থেকে দূরে, উত্তর কলকাতার এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে জোড়াসাঁকোর পুরনো প্রাসাদ। চারপাশে আধুনিক ভবন, গাড়ির কোলাহল, হর্নের শব্দ—সবই ভেসে আসে, তবু প্রাসাদটিকে ঘিরে যেন এক অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি হয়েছে। ভাঙা রেলিং, শ্যাওলা ধরা দেয়াল, আধভাঙা সিঁড়ি আর অন্ধকারমাখা জানালা, সব মিলিয়ে জায়গাটা যেন সময়ের গর্ভে আটকে গেছে। মানুষজন এদিক দিয়ে এলে দূর থেকেই চোখ সরিয়ে নেয়, কারণ দীর্ঘদিন ধরেই এর চারপাশে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। কারও দাবি, রাতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখা যায় সাদা শাড়ি পরা এক নারীকে। কেউ বলে, জানালার কাচে প্রতিফলিত হয় অদ্ভুত ছায়া। আবার অনেকেই বিশ্বাস করে, প্রাসাদের…
 - 
				
১ অমল ছিল এক সাধারণ গ্রামীণ ডাকপিয়ন, যার জীবন প্রতিদিনের রুটিন আর নির্দিষ্ট পথেই আবদ্ধ ছিল। সকালবেলায় সে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ত, চিঠির ব্যাগ কাঁধে নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি যেত, আর বিকেলের মধ্যেই সব বিলি শেষ করে বাড়ি ফিরত। কিন্তু সেদিনটা অদ্ভুতভাবে ভিন্ন হয়ে দাঁড়াল। অফিসে কিছু অতিরিক্ত কাজের জন্য তাকে দেরি হয়ে গেল, আর সন্ধ্যার আলো যখন ম্লান হতে শুরু করল, তখনও অমল চিঠির ব্যাগ নিয়ে রওনা দেয়নি। সে জানত, গ্রামের মানুষরা চিঠির অপেক্ষায় থাকে, আর দেরি করলে তাদের মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে। তাই অমল নিজের ক্লান্তি উপেক্ষা করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। পথে হাঁটতে হাঁটতে সে লক্ষ্য করল,…
 - 
				
ঋতম মুখাৰ্জী ১ কলকাতার এই শতবর্ষপ্রাচীন গ্রন্থাগারটির নাম আজকাল প্রায় কেউই উচ্চারণ করে না, অথচ একসময় তা শহরের বৌদ্ধিক প্রাণকেন্দ্র ছিল। উচ্চ সিলিং, কাঠের খোদাই করা বুকশেলফ, আর দীর্ঘ করিডরজুড়ে পেতলের ল্যাম্পের আলো—এমনই ছিল এককালের আভিজাত্য। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে নতুন প্রজন্মের পাঠকরা ইন্টারনেটের মোহে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, আর গ্রন্থাগার রয়ে যায় বিস্মৃত, প্রায় পরিত্যক্ত। দিনের আলোতেও ভেতরে ঢুকলে কেমন এক চাপা অন্ধকার অনুভূত হয়; কাঠের পুরোনো টেবিলগুলো কেমন যেন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, আর বুকশেলফে সাজানো চামড়ার বাঁধাই বইগুলোর গায়ে জমে থাকা ধুলো যেন কালের সাক্ষী হয়ে নীরবতা রক্ষা করে। অদিত্য, কলকাতারই এক কলেজপড়ুয়া ছাত্র, পড়াশোনার কাজে প্রয়োজনীয় রেফারেন্স…
 - 
				
অনিৰ্বাণ দাস ১ গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ভিলাটির জন্ম একেবারে ইতিহাসের গর্ভে লুকিয়ে আছে। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন চন্দননগর ছিল ফরাসি উপনিবেশের এক প্রধান কেন্দ্র, তখন ফরাসি কনসাল জ্যঁ-ব্যাপটিস্ট দ্য ল্যাঁক তাঁর পরিবারের জন্য এই ভিলাটি নির্মাণ করেছিলেন। গঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চল তখন ছিল বাণিজ্যের জন্য অমূল্য সম্পদ—রেশম, নীল, আফিম, মসলিনের ব্যবসায় মত্ত হয়ে উঠেছিল ফরাসি বণিকেরা। ইউরোপীয় জাহাজ এসে ভিড়ত বন্দরঘাটে, আর গঙ্গার জলে প্রতিদিন প্রতিফলিত হতো সাদা পালের ছায়া। ভিলাটি ছিল তাঁদের ঐশ্বর্যের প্রতীক—সাদা চুনে মোড়া দেওয়াল, নীল রঙে রাঙানো কাঠের জানালা, আর রোমান খিলানের মতো খোলা বারান্দা। চারদিকে ছায়াঘেরা বাগান, যেখানে ইউরোপ থেকে আনা গাছপালা যেমন ছিল,…
 - 
				
গৌতম ভৌমিক ১ শরৎকালীন আকাশে সাদা মেঘের পালক যেন উড়ে বেড়াচ্ছে। দূরে সবুজ ধানের ক্ষেতে হালকা বাতাস বয়ে যায়, তার সঙ্গে মিশে আছে কাশফুলের দোল খাওয়া, গোধূলি রঙে রাঙা হয়ে ওঠা আকাশ, আর তারই ভেতর গ্রামজুড়ে শুরু হয়েছে দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি। গ্রামের চৌমাথার কাছে কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে প্যান্ডেল—এবার থিম ‘নবরূপিণী দুর্গা’। গ্রামের কারিগররা দিনরাত খেটে যাচ্ছেন, বাঁশের গাঁথুনির উপর কাপড়ের ক্যানভাস টাঙিয়ে তুলছেন মণ্ডপ, মাটির মূর্তির গায়ে তুলির টান টেনে আনছেন দেবীর সৌন্দর্য। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মুগ্ধ চোখে সেই কাজ দেখে বেড়ায়, আর যুবকেরা আলোর তার ঝোলাচ্ছে গলিপথে। বাজারে পুজোর ভিড় জমেছে; সবাই নতুন কাপড়, ধূপ, মিষ্টি, উপহার…
 - 
				
অরিন্দম এবং মাধুরী দীর্ঘদিনের পরিশ্রম আর সঞ্চয়ের ফলস্বরূপ অবশেষে তাদের স্বপ্নের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করল। শহরের ব্যস্ততম এলাকাগুলো থেকে দূরে, একটি আধুনিক কমপ্লেক্সের উচ্চতর তলার এই অ্যাপার্টমেন্ট যেন তাদের নতুন জীবন শুরু করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। বাইরের কোলাহল এবং ধুলো-ময়লা থেকে একেবারেই আলাদা, চারপাশে প্রশান্ত নীরবতা, সবকিছু সুন্দরভাবে সাজানো লবি, এবং প্রতিটি ফ্ল্যাটে আধুনিক সুবিধা—এগুলো সবই তাদের নতুন জীবনকে স্বাগত জানাচ্ছিল। অরিন্দম বেশ উদ্দীপনায় নতুন ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণ ঘুরে দেখছিল, তার চোখে আনন্দ আর সাফল্যের প্রতিফলন স্পষ্ট। মাধুরী, যদিও আনন্দিত, কিন্তু তার মনে মাঝে মাঝে এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছিল। ফ্ল্যাটের নিখুঁত নীরবতা মাঝে মাঝে যেন তার কানে অদ্ভুত শব্দের…
 - 
				
পল্লব সেনগুপ্ত ১ প্রতি বছর শরৎকালের সেই বিশেষ সকালটি যেন গ্রামটির বুকের ভেতর এক অদ্ভুত উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। রাতভর কুয়াশা আর শিশিরে ভিজে থাকা বাতাস যখন আস্তে আস্তে আলোয় গা ভিজিয়ে নেয়, তখনই শুরু হয় সেই সুর—চণ্ডীপাঠের গম্ভীর ও সুরেলা ধ্বনি। গ্রামটি খুব সাধারণ, মাটির ঘর, কাঁচা রাস্তা, পুকুর আর ধানখেত দিয়ে ঘেরা, অথচ প্রতি মহালয়ার ভোরে এই গ্রাম হয়ে ওঠে রহস্যময়। সূর্যের প্রথম কিরণ ওঠার আগেই দূর থেকে ভেসে আসে ধ্বনি, যেন দেবীর আহ্বান চলছে। যারা গ্রামে থাকে তারা সবাই জানে, এই সুর অন্য কোনো মাইক থেকে নয়, কিংবা মন্দির থেকেও নয়। এটা ভেসে আসে সেই পুরোনো, ভগ্নপ্রায় বাড়ি…
 - 
				
এক গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে, বাঁশঝাড়ের আড়ালে এক বিস্মৃত কূপ বহুদিন ধরে অচল পড়ে আছে। সময়ের ভারে তার ইটগুলো ভেঙেচুরে এক অদ্ভুত শৈবাল-ঢাকা রূপ নিয়েছে, যেন প্রকৃতি নিজেই কূপটিকে ঢেকে রাখতে চায়। চারপাশে গজিয়ে ওঠা কাঁটাঝোপ, শুকনো ডালপালা আর বনলতা মিলেমিশে এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে যেখানে দিনের আলোও প্রবেশ করতে চায় না। গ্রামের শিশুরা দূর থেকে কূপটিকে দেখে আঁতকে ওঠে, আর বয়স্করা ভয়ে নামও মুখে আনে না। শোনা যায়, একসময় এ কূপই ছিল গ্রামের প্রধান পানির উৎস। মানুষজন প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা জল তুলতে আসত, কূপপাড়ে হাসি-ঠাট্টার আসর বসত। কিন্তু প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে এক ভয়াবহ ঘটনার পর হঠাৎ করেই কূপটি অশুভের প্রতীক…