প্রদীপ মালাকার এক ঈহিত কর্ণিক নদীর দিকে তাকিয়ে বসেছিল লোকাল বাসের জানালায়, কাঁচের ওপারে ভেসে যাচ্ছিল আধা ঝাপসা একচিলতে সবুজ, দূরের সোনালি সর্ষে আর মাঝেমাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছের সারি। কলকাতার শীতের দুপুর ফিকে হয়ে আসছিল, আর তারই ফাঁকে ফাঁকে গ্রামের শান্ত ধুলোপথ যেন পুরনো কাহিনির বইয়ের মতো পাতা উল্টাচ্ছিল। ঈহিত, পেশায় অনলাইন নিউজ পোর্টালের রিপোর্টার, কিন্তু আসলে একজন কৌতূহলী অনুসন্ধানকারী—যে ভয় আর যুক্তির মাঝখানে দাঁড়িয়ে খুঁজে বেড়ায় সত্য। গত দুই মাস ধরে সে অনুসরণ করছিল এই নদীপারের পুরনো প্রাসাদের গল্প, যেখানে নাকি রাতের গভীরে বাঁশির সুর ভেসে আসে, আর যাদের সে সুর ছুঁয়ে যায় তারা কখনো ফিরে আসে…
-
-
দেবযানী চৌধুরী কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদগামী বাসটা যখন রাতের অন্ধকারে গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে এগোচ্ছিল, তখন অভিষেক মুখার্জি জানালার কাঁচের বাইরে তাকিয়ে ভাবছিল, সে কি সত্যিই এমন কিছু পাবে যেটা রিপোর্টে ব্যবহারযোগ্য? বছর দুয়েক হল সে এক অনলাইন নিউজ চ্যানেলে কাজ করছে—”রিয়েল শ্যাডো”—যেখানে তাকে পাঠানো হয় গ্রামীণ অলৌকিক ঘটনার অনুসন্ধানে। ভূত, প্রেত, চুড়েল, পেত্নী—এইসব নিয়ে সাধারণত ভিডিও বানানো হয়, আর টাইটেল হয় “Real Ghost Spotted in West Bengal” টাইপের। কিছুটা বিরক্তি, কিছুটা কৌতূহল নিয়েই সে এসেছিল। কিন্তু এইবারের গন্তব্য একটু আলাদা। মুর্শিদাবাদের এক অজপাড়া গ্রাম—ভাঙ্গাড়িপুর, যেখানে এক বৃদ্ধা থাকেন একা, শ্মশানের পাশে। গ্রামবাসীরা বলেন, তার ঘরে মৃতরা কথা বলেন। তাকে সবাই…
-
ঐন্দ্রিলা চক্রবর্তী কলকাতার সাউথ সিটি কলেজে নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছে মাত্র এক সপ্তাহ। ঐশী চৌধুরী ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে যখন ট্যাক্সি থেকে নামল, তখন বিকেলের আলো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছিল। দক্ষিণ কলকাতার এক কোণায় অবস্থিত ‘সুবর্ণ পল্লী আবাসন’ – চারতলা একটি পুরনো ফ্ল্যাট কমপ্লেক্স, বাইরের রঙ প্রায় উঠে গেছে, জানালার লোহার রেলিংয়ে জং ধরেছে আর ছাদের ড্রেনপাইপ থেকে পানির ফোঁটা ঝরছে টুপটাপ। ঐশী নিজের নতুন ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটের চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলল—দরজার কপাটটা একটা ধাতব আর্তনাদের মতো শব্দ তুলে খুলে গেল। ভিতরে ঢুকেই একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ তাকে অভ্যর্থনা জানাল, তবে সে এমন গন্ধে অভ্যস্ত। ছোটবেলা থেকেই সে পুরনো জিনিসে টান…
-
সৌমিক ভট্টাচার্য ১ পাহাড়ি রাস্তাগুলো যেন কোনও অজানা গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল অভিজিৎ সেনগুপ্তকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের গবেষক, লোকবিশ্বাস এবং পাহাড়ি সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘদিনের আগ্রহ ছিল তার। একটি গবেষণা প্রকল্পের সূত্রে সে এবার রওনা দিয়েছিল উত্তরবঙ্গের এক অদ্ভুত দূরবর্তী গ্রামে—সিংরিপাহাড়। ট্রেন থেকে নামার পর পায়ে হেঁটে, জিপে চড়ে, শেষমেশ খচ্চর পিঠে চেপে পৌঁছাতে হয়েছিল তাকে সেই দুর্গম স্থানে। পাহাড়গুলো যেন দাঁড়িয়ে ছিল এক অভেদ্য প্রাচীর হয়ে—মানুষের সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন, অথচ নিজেদের মতো করে সাজানো এক অলৌকিক গ্রাম। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অবস্থিত ছোট্ট গ্রামটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ল ছায়াঘেরা গাছপালা, পাথরের বাড়ি, আর সন্ধ্যার আগেই বন্ধ হয়ে আসা কুড়িটি দরজা-জানালা। অভিজিৎ…
-
দেবযানী মিত্র ১ নদীয়ার ‘গিরিজামোহিনী বালিকা বিদ্যালয়’ বরাবরই শান্ত, ছায়াস্নাত পরিবেশে গড়া একটি পুরনো স্কুল, যার পেছনে ছড়িয়ে আছে রহস্যে মোড়া এক আভা। বারো মাসে একদিন, পূর্ণিমা রাতে, হঠাৎ যেন স্কুলের প্রাচীরের আড়ালে নেমে আসে এক অদৃশ্য ছায়ার করাল উপস্থিতি। মেয়েরা জানে, কোনো অলীক কথা নয়, কেউ বা কিছু ওই স্কুলের পেছনের বিশাল বটগাছটিকে ঘিরে জেগে থাকে। দশম শ্রেণির ছাত্রী রিমা সাহা এই ধরনের গুজবে বিশ্বাস করে না, বরং হাসি ঠাট্টায় উড়িয়ে দেয় সবকিছু। কিন্তু সেই রাতটা ছিল আলাদা—পূজা ছুটি শেষে স্কুলে ফেরার আগের সন্ধ্যা, আকাশে টানা মেঘের ছায়া, তবু এক নিখুঁত গোল চাঁদ ঝলসে উঠেছে পশ্চিমের আকাশে। বাড়ির ছাদে…
-
এক নদীয়া জেলার এক প্রান্তে, হুগলি নদীর ধারে, লুকিয়ে আছে চন্দ্রবদনী নামের এক ঘাট—যা আজকাল কেউ খুব একটা চেনে না। দিনের আলোয় ঘাটটা যেমন সাধারণ আর নিরীহ, ঠিক সন্ধ্যা নামার পর থেকেই তার চেহারা পাল্টে যায়। কুয়াশা নামতে থাকে এক নিঃশব্দে, নদীর জলে বয়ে আসে অদ্ভুত একটা গন্ধ, যেন শ্যাওলার ভেতরে দীর্ঘদিনের জমে থাকা কান্না। গাঁয়ের লোকেরা সন্ধ্যার পর ঘাটমুখো হয় না, এমনকি নামও মুখে আনে না। তারা বলে, “ওইখানে জল শুধু জল না, ওখানে কেউ আছে।” তমাল মল্লিক, একজন লোকসংস্কৃতি গবেষক, এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না। কলকাতা থেকে আসা এই তরুণ ইতিহাসবিদের মনে ছিল জেদ—যেখানে ভয়, সেখানে সত্য। সে…
-
কলকাতার উত্তরে অবস্থিত “চন্দ্রমোহন কলেজ”-এর হোস্টেলটা শহরের মধ্যে হলেও একেবারে বাইরের অংশে পড়ে। চারদিকের কোলাহলের মধ্যেও হোস্টেলের গেট পেরোনোর পরেই যেন এক অদ্ভুত নীরবতা আচ্ছন্ন করে রাখে জায়গাটাকে। পুরনো লাল ইটের বিল্ডিং, জংধরা লোহার গ্রিল, আর হোস্টেলের চারপাশে ছড়ানো অশ্বত্থ ও কৃষ্ণচূড়ার গাছগুলো যেন দিনের বেলাতেও ছায়া ফেলে রাখে আশপাশে। সোহম মুখার্জি, সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া ছাত্র, বাবা-মায়ের সঙ্গে এসে উঠল ওই হোস্টেলে। তার সঙ্গে একই ঘরে থাকবে রাহুল দে, ওর স্কুলজীবনের বন্ধু, আর তুষার সাহা — এক আধুনিক, সদ্য দেখা হওয়া ফেসবুক-বন্ধু। রুম নম্বর ৭ — তিনতলার এক কোণে, যেটা দেখে মনে হয় অনেক বছর কেউ পরিষ্কার করেনি। সিলিং…