অমিতাভ ধর অধ্যায় ১: কুয়াশার পথ রাত দশটা বাজে। রাহুল গাড়ির জানালার কাচ খুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। হিমেল হাওয়া গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে। গাড়ি উঠছে পাহাড় বেয়ে—চুনাভাট্টি, দার্জিলিং-এর এক বিস্মৃত পাহাড়ি গ্রাম, যেটা এখনো পর্যটনের খাতে উঠে আসেনি। পাশে বসা অর্ণব, হাত গুটিয়ে মোবাইলে পাহাড়ি মানচিত্র ঘাঁটছে।— “এটা নিশ্চয়ই শেষ মোড়,” বলে নয়না, জানালার কুয়াশা মোছার চেষ্টা করতে করতে।— “নিশ্চয়ই?” হেসে ওঠে ঋদ্ধি, “অবশ্যই না! এখনো এক ঘণ্টা বাকি।”— “এই ট্রিপটা তুই কেন ঠিক করলি ঋদ্ধি?” প্রশ্ন করে রাহুল।ঋদ্ধি কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দেয়, “ঠাকুমার ডায়েরিতে এই গ্রামের কথা ছিল। ছোটবেলায় অনেকবার শুনেছি… কিন্তু এবার দেখতে এলাম।” গাড়ির ড্রাইভার—একজন চুপচাপ…
-
-
ঋতবান চ্যাটার্জী হারিয়ে যাওয়া সকাল পুরুলিয়ার ঘাঘরা গ্রাম যেন একটানা নিঃশব্দে বেঁচে থাকে। এই গ্রামের গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে শীতল সুবর্ণরেখা, আর মাথার ওপর ছায়া ফেলে রেখেছে অজস্র শাল-সেগুন। এখানে দিনের আলো পড়ে নরম, আর রাতের অন্ধকার গাঢ়, জ্যোৎস্নাতেও কালো। কেবলই যেন কেউ দেখে, তবু ধরা পড়ে না। বিপ্লব দাস ছিলেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একমাত্র শিক্ষক। গ্রামের মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করত, কিন্তু ভালোবাসার চোখে—যেন তিনি তাঁদের আশার বাতি। সকাল সাতটায় উঠোনে লাল চায়ের কাপ হাতে বসে থাকতেন, পোষা কুকুর ‘রাঙা’ পায়ের পাশে বসে। সেদিন সকালে রাঙা ছিল, কাপটাও ছিল, শুধু মানুষটা ছিল না। অরুন্ধতী, বিপ্লবের স্ত্রী, প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো বাজারে…
-
বিমলেশ বাগচী পর্ব ১: বটগাছের ব্রত ও ভবেশের বুদ্ধি ধলেশ্বরীপুর নামটা শুনলেই হাসি পায় অনেকের। কারণ এই গ্রামে আছে এমন এক বটগাছ, যেটা নাকি ব্রহ্মচারী। গ্রামের সব গুঞ্জন আর গপ্পে এই বটগাছ নিয়ে—কে নাকি এর ছায়ায় বসে প্রেম করল, আর কে নাকি ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে পালাল। এই বটগাছকে কেন্দ্র করেই গল্পের শুরু। এই গাছটা গ্রামের উত্তর প্রান্তে, কাঁঠালতলা মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে। বিশাল, পুরনো, আর তার গায়ে মাটির সিন্দুর আর মাটি-গোলাপ দিয়ে সাজানো একটা ছোট্ট বেদি। সবাই জানে, এখানে প্রেম করা মানে কেলেঙ্কারি নিশ্চিত! গাঁয়ের ছেলেরা বলে, “এই গাছের নিচে বসে প্রেম করতে গেলেই ল্যাংটো ছাগল পেছনে ধাওয়া করে!” কেউ…
-
ঋধিমান বসু মাঝরাতে সেই ডাকটা আবার এল। “সু-র-জ…” নরম, স্নিগ্ধ অথচ ভয়ানকভাবে গভীর সেই আওয়াজ যেন কানে নয়, সোজা মগজে ঢুকে পড়ে। গায়ের রোম খাড়া করে দেয় এমন এক সুরে, যেন হাজার বছর আগের কোনো প্রতিজ্ঞার স্মৃতিচিহ্ন বাজছে। তিন মাস হলো সূরজ সাঁতরাগাছির এই পুরোনো ভাড়াবাড়িতে উঠেছে। চাকরির কারণে কলকাতা থেকে দূরে, একটু নিরিবিলি জায়গা খুঁজছিল। বাড়িটা পছন্দ হয়েছিল শুধু একটাই কারণে—ভাড়া খুব কম। আর যেটা কম, সেটা সবসময় সন্দেহজনক হয়। সূরজ একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু তার মনে আজীবন একটা ফাঁকা জায়গা ছিল। সম্পর্কের ক্ষেত্রে বারবার ব্যর্থতা, মনের মতো কাউকে না পাওয়া, একাকীত্ব তাকে নীরব করে তুলেছিল। সে ভাবত, “যদি…
-
সিঞ্জিনী চক্রবর্তী আগমন নদিয়ার চন্দ্রপুর গ্রামটা সময়ের দিক থেকে যেন অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। শহরের তুলনায় এখানে সময় যেন একটু ধীরে চলে। দিনগুলো এখানে বড় শান্ত, নিঃসঙ্গ; সন্ধ্যা নামতেই ঘরবাড়ির দরজা জানলা বন্ধ হয়ে যায়, কুকুরের ডাকে চমকে ওঠে মানুষ। গ্রামটা যেন নিজেই একটা দীর্ঘশ্বাস। পাকা রাস্তা নেই, মোবাইল টাওয়ারের সংকেত আসে-যায়। চায়ের দোকানে বিকেলের আড্ডাও যেন কেমন নিরুত্তাপ। আর সন্ধ্যে নামলেই চারপাশে এমন এক নীরবতা নামে, যেন শব্দ করাটাই পাপ। এই চন্দ্রপুর গ্রামেই আসে রক্তিম সেন—কলকাতার যুবক, ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের ছাত্র। সে আসছে তার মামাবাড়িতে, গরমের ছুটির জন্য। পুরনো দিনের মতো চিঠি বা ফোন করে নয়, হঠাৎ করেই একদিন চেপে…