অরিত্র ভট্টাচার্য আমাদের গ্রামের নাম হিজলতলা, চারদিকে জলাভূমি, তালডোবা, মাঝেমধ্যে ধানক্ষেতে চিলের পাখা লেগে বাতাস কেটে যায়, আর মাঝখানে বটগাছের ছায়ায় পড়েই আছে যে জিনিসটা নিয়ে এত কথা—পুরনো প্রাইমারি স্কুলঘর। টালির ছাদে শ্যাওলা, দরজায় মরচে, জানালার কাঠ নড়ে উঠলেই যেন লম্বা ককিয়ে ওঠা কান্না, আর ভেতরে ধুলো জমা বেঞ্চ-ডেস্ক যাদের ওপর আমরা কোনোদিন বসিনি, কারণ স্কুলটা বন্ধ হয়ে গেছে অনেক বছর। কেন বন্ধ, সেটা নিয়ে গ্রামের লোকের হাজার গল্প। কেউ বলে, শিক্ষক আত্মহত্যা করেছিলেন, কেউ বলে একটা মেয়ের সঙ্গে তাঁর গোপন সম্পর্ক ছিল, কেউ বলে রাতে চক ঘষার শব্দ শুনে পাগল হয়ে যান। এসব কথার সঙ্গে সঙ্গে আমরা—আমি, বাপন, শুভ,…
-
-
তপন শিকদার উত্তর কলকাতার পুরনো মহল্লাগুলোর গলি যেন এক অদ্ভুত সময়যন্ত্র—যেখানে অতীতের প্রতিধ্বনি আজও দেয়ালের ভেতর আটকে আছে। দিনের বেলায় এই গলিগুলোয় ছেলেদের ক্রিকেট খেলা, ভ্যানরিকশার ঝমঝম শব্দ, আর পুরনো মিষ্টির দোকান থেকে ভেসে আসা রসগোল্লার গন্ধ মিশে থাকে; কিন্তু সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গেই যেন এই গলির প্রাণশক্তি শুষে নেয় অদৃশ্য কোনো শক্তি। হাতিরপোলের সেই নির্দিষ্ট ভাঙাচোরা গলিতে যখন সন্ধ্যার আলো ম্লান হয়ে আসে, তখন মনে হয় ছায়ারা যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে, পুরনো বাড়ির জানালা দিয়ে কেউ তাকিয়ে আছে। ম্লান আলোর নিচে কাদামাখা রাস্তা, ভাঙা ইটের স্তূপ, আর ধসে পড়া বারান্দার খচখচে কাঠ—সব মিলে তৈরি করে এক অদ্ভুত ভৌতিক আবহ।…
-
অভিজিৎ রায় পর্ব ১ কালো মেঘে ঢাকা সন্ধেটা যেন গ্রামের বুক থেকে আলোটুকু শুষে নিয়েছিল। নদীর ধারে পেঁচানো পথ দিয়ে হাঁটছিল অর্ণব। কলকাতা থেকে সে এসেছিল কিছু কাজের সূত্রে, কিন্তু এই গ্রামে এসে তার মনে হচ্ছিল, শহরের ব্যস্ততা থেকে মুক্তি পাওয়া মানে এই নয় যে মন শান্ত হয়ে যাবে। বরং প্রকৃতির অন্ধকারের ভেতরেই এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা ঘিরে ফেলছিল তাকে। গ্রামটার নাম কাশীপুর, লোকসংখ্যা অল্প, আর চারদিকে ঘন জঙ্গল। তার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল এক পুরোনো বাড়িতে—লোকেরা যাকে বলে মজুমদারদের পরিত্যক্ত ভিটে। লোকজন তাকে আগেই সাবধান করেছিল, রাত হলে যেন একা বাইরে না বেরোয়। অর্ণব ভেবেছিল, এগুলো নিছক গ্রামীণ গুজব, যেখানে ভূতের…
-
সোমনাথ দত্ত এক কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের অডিটোরিয়ামে সেদিন ছিল ‘ইস্টার্ন ফরেস্ট কনজারভেশন’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার। চারপাশে ব্যানার, স্টল, আর নানা দেশের বিজ্ঞানী, গবেষক ও শিক্ষার্থীরা ভিড় জমিয়েছিল। আলো-আঁধারির হলঘরে মাইক্রোফোনে চলছিল বক্তৃতা, আর পাশে বড় স্ক্রিনে ভেসে উঠছিল বনের প্রাণিকুল, বিরল উদ্ভিদ আর সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ছবি। প্রথম সেশনের শেষে, চায়ের বিরতিতে, ড. অনির্বাণ সেনগুপ্ত দাঁড়িয়ে ছিলেন কফির কাপ হাতে, একদম কর্নারের দিকে। গম্ভীর মুখ, পরিমিত কথা বলা মানুষ তিনি, কিন্তু প্রকৃতি নিয়ে কথা উঠলে চোখে একধরনের শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস জ্বলে ওঠে। ঠিক তখনই এক পরিচিত মুখ—গাঢ় বাদামি চামড়া, খসখসে হাত, মাথায় ধুলো-ধূসরিত টুপি—হেঁটে এলেন তাঁর দিকে। লোকটি নিজের নাম…
-
তনয়া সেন বিকেলের শেষ আলোয় যখন সূর্য পাহাড়ের গায়ে ধূসর হয়ে গলে আসছিল, তখনই অরণ্যের বাস এসে পৌঁছল ছোট্ট গ্রামটায়। বাস বলতে আসলে একটা পুরোনো মিনিবাস, জানালার কাচ ঝাপসা, সিটের চামড়ায় ফাটল। গাঁয়ের নাম রাধাপুর—এমন নাম মানচিত্রে খুঁজলেও পাওয়া মুশকিল। তবু অরণ্যের মতো ফটোগ্রাফারের কাছে এই জায়গার টান ছিল অন্যরকম। শহরের কোলাহল, নামজাদা প্রকল্প, নামী রিসর্ট নয়—বরং অচেনা, অনাবিষ্কৃত জায়গার মধ্যে লুকোনো প্রকৃতির ছবি তুলতে তার সবচেয়ে ভালো লাগে। অরণ্যের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা ভারী, ভিতরে ক্যামেরা, লেন্স, ত্রিপড আর কিছু নোটবুক। বাসস্ট্যান্ডে নেমে চারপাশে তাকাতেই সে বুঝল, এই গ্রাম যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচা রাস্তা, খড়ের চালের ঘর, বাচ্চাদের…
-
উপাসনা রায় উত্তর কলকাতার যে রাস্তার নাম বারবার বদলেছে, সেখানে একটা বাড়ি আছে যার নাম কখনও বদলায়নি—লোকমুখে “কালোজানালা বাড়ি”। অর্পণ যখন প্রথম দিন চাবিটা হাতে পেল, বিকেলের আলো তখন ছেঁকে পড়ছে ছাদের ধুলোতে; সিঁড়ির মুখে জোনাকি বাতির মতো ঝুলছে পুরনো বাল্ব, আর মেঝের কালো-সাদা মোজাইকের ফাঁক থেকে উঠছে এক ধরনের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ—আদ্রতা আর শেওলার মিশ্রণ। বাড়িওয়ালার সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই, দালাল বাবু বলেছিল, “এখানে যারা থাকে তারা নিজ দায়িত্বে থাকে। পানীয় জল নিজের মতো জোগাড় করবেন, আর… কালো জানালাগুলো বন্ধ রাখবেন।” কথাটা বলে একটু থেমে হেসেছিল, যেন মজা করছে। অর্পণ ভেবেছিল, পুরনো বাড়ির দোষ। কিন্তু যে জানালাগুলোর কাঠে সরু লোহার…
-
অর্ঘ্য দত্ত আগমন বিকেলের আলো তখনো জমে আছে গাছের পাতায়, যখন শুভম দাস ট্রেন থেকে নামল। ছোট্ট একটা স্টেশন—নাম ‘মাহেশচর’। আশেপাশে ঝিম ধরা সবুজ মাঠ, দূরে একটা নদীর রেখা দেখা যায়, আর ঝাঁক বেঁধে উড়ছে সাদা বক। শুভম শহরের ছেলে, কলকাতার এক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। পিএইচডির বিষয় “লোকজ কৃষিপদ্ধতি ও তার সামাজিক প্রভাব”, আর সেই সূত্রেই আজ এই প্রত্যন্ত জায়গায় তার পদার্পণ। এতটা ভিতরে ঢুকতে হবে, তা আগে আন্দাজ করেনি। স্থানীয় এক শিক্ষকের মাধ্যমে পরিচিত হয়েছে গ্রামের নাম—গোপীনাথপুর, আর সেই গ্রামের পাশেই একটি রহস্যময় ধানখেত, যেখানে প্রতি বছর নবান্নর আগের রাতে কেউ পা রাখে না। স্টেশন থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই…
-
তিথি বসু পর্ব ১: সেই ভগ্নপ্রায় দরজার শব্দ নদীয়ার কুয়াশা ঢাকা বিকেলে ট্রেন থেকে নামতেই শুভমর মনে হলো সময়টা যেন হঠাৎ করে থমকে গেছে। বাইরের হাওয়া ঠান্ডা, কিন্তু বাতাসের মধ্যে কিছু একটা গুমোট। সে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রিকশাওয়ালার দিকে এগোল। “চৌধুরীবাড়ি যাবেন?” জিজ্ঞেস করতেই রিকশাওয়ালার মুখটা কেমন থমথমে হয়ে গেল। “চৌধুরীবাড়ি? ওই যে শ্মশানের পাশে যেটা?” শুভম মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, ওটাই। আমি গবেষণার জন্য এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুমতি আছে।” রিকশাওয়ালা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, “আমি ওইদিক যাই না বাবু। ওখানে এখন কেউ থাকেও না।” শেষমেশ অনেক বোঝানোর পরে একজন রাজি হলো। অন্ধকার নেমে আসছিল, আর চৌধুরীবাড়ির পথটা খড়ি গাছ…
-
সমীরণ রায় পর্ব ১: বনগন্ধ ঝড়ের রাতে বনের গন্ধটা বড় অন্যরকম। সেই গন্ধে ভিজে থাকে মাটি ভিজিয়ে ফেলা অতীত, শালপাতার দোলা, হরিণের নিঃশ্বাস, আর কোথাও লুকিয়ে থাকা এক কালের শিকারের হাহাকার। দক্ষিণ বিহারের পাহাড়ি ঢালে ঢেকে থাকা অরণ্যটার নাম কেউ ঠিকমতো জানে না, শুধু বলে—‘বনদেউলের জঙ্গল’। দিনের আলোও এখানে ঠিকঠাক ঢোকে না। সে আলো যেন গাছের ডাল, পাতার খাঁজে হারিয়ে যেতে চায়, আর পাতাঝরা মাটিতে কুয়াশার মতো লেগে থাকে। আমি, শম্ভু রায়, পেশায় বন্যপ্রাণ গবেষক, জীবনের অনেক সময়ই কাটিয়েছি জঙ্গলে। তবে এই সফরটা ছিল আলাদা। কারণ এই যাত্রায় শুধু প্রাণীর সন্ধান ছিল না, ছিল এক অমীমাংসিত পুরনো ঘটনার উত্তর খোঁজার…
-
রক্তিম জানা বাড়িটা একটু বেশিই ঠান্ডা বিকেল পাঁচটা বাজতে না বাজতেই চারজন দাঁড়িয়ে ছিল পাণ্ডুগ্রামের পুরনো ‘সিংহবাড়ি’র সামনে। সাদা রঙের ছোপ ছোপ দেয়াল, বড় বড় কাঠের জানালা, আর ছাদের কিনারা দিয়ে বেয়ে নামা আগাছা দেখে মনে হচ্ছিল বাড়িটা কাঁদছে। “এই বাড়িতেই না তোর মামাবাড়ি ছিল, বুদু?”— প্রশ্ন করল চঞ্চল, যার চশমার কাঁচের পেছন থেকে সবসময় একটা অবিশ্বাস ফুটে বেরোয়। “হ্যাঁ রে… কিন্তু তোরা জানিস না, আমার মামারা কেন এই বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে গেল,”— গলায় অদ্ভুত এক থমথমে ভাব এনে বলল বুদু। “ভূতের গল্প করিস না,”— বলল তোতন, যার বুকের মধ্যে বাঘ থাকলেও পোকা দেখলে চেঁচিয়ে উঠে। “ভূত হলে তো…