অদিতি পাল এক রাতের গঙ্গা সবসময়ই অন্যরকম। দিনে যে ঘাটে ভিড় জমে, স্নান, পূজা, আরতির ভিড়ে যেখানকার সিঁড়িগুলো পর্যন্ত হারিয়ে যায় মানুষের ভিড়ে, রাত নামলেই সেই জায়গাটা যেন অন্য কোনো জগতে ঢুকে যায়। বাতাসে তখন থাকে কেবল জলের সোঁদা গন্ধ আর অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে কেবল রাতজাগা পাখির ডাক কিংবা দূরে ভেসে আসা কুকুরের হাহাকার ভাঙে সেই নীরবতা। এই গঙ্গার এক পুরোনো ঘাট নিয়ে ছোটো ছোটো কিশোর থেকে শুরু করে বুড়ো পাণ্ডারা পর্যন্ত বলাবলি করে—ওখানে নাকি মাঝরাতে কান্নার শব্দ শোনা যায়। লোকেরা বলে, সেই কান্না কোনো মানুষের নয়, কোনো বউয়ের আত্মা ওখানে কাঁদে। যার করুণ সুরেলা সিসকি শোনা যায়, কিন্তু…
-
-
সোহম কর্মকার ১ কলকাতার রাত যেন এক বিশেষ ছন্দে দুলে চলেছিল। দিনের সমস্ত কোলাহল স্তব্ধ হয়ে গেছে, ভিড়ভাট্টা, যানজট, হর্নের শব্দ আর লোকজনের ব্যস্ততা যেন শহরের কোথাও নেই। শুধু নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসছে পথের কুকুরের ঘেউ ঘেউ অথবা রাত জাগা ট্যাক্সির হর্ন। হাওয়ায় কুয়াশার মতো একটা ঠাণ্ডা স্যাঁতসেঁতে ভাব, যেন হাওড়া ব্রিজের নীচে গঙ্গার বুক থেকে উঠে আসছে ধোঁয়া। রাত তখন বারোটা। এই সময় খুব কম সংখ্যক ট্রাম চলে, তবু পুরনো নিয়মে হরিদাস মল্লিক তার পুরনো সবুজ রঙের ট্রাম নিয়ে বেরিয়েছে। বয়স পঞ্চান্ন ছুঁইছুঁই হলেও হাতে এখনও শক্তি আছে, চোখে আলোও আছে, তবে মনটা মাঝে মাঝে কেমন…
-
রাজীব আচার্য ১ শহরের হৃদয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভাঙা টেলিফোন এক্সচেঞ্জটি যেন এক মৃত স্মৃতিস্তম্ভ। আশপাশে আধুনিক উঁচু কাঁচের দালান উঠে গেছে, তবুও এই এক্সচেঞ্জ তার ভগ্নদশা নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে—চুপচাপ, অন্ধকার, আর ভৌতিক নীরবতা জড়িয়ে। লোহার গেটের মরচেধরা খাঁচা, দেওয়ালে উঠে আসা লতাগুল্ম, জানালার কাঁচ ভেঙে তৈরি হওয়া খালি ফাঁক—সব মিলিয়ে ভবনটি যেন সময়ের কাছে পরাজিত এক সৈনিক। দিনের বেলায় মানুষজন কদাচিৎ এর সামনে দিয়ে যায়, আর রাত নামলেই এই জায়গাটা একেবারেই শুনশান হয়ে পড়ে। একসময় এটাই ছিল শহরের প্রাণকেন্দ্র, হাজারো কল এখান দিয়ে যেত, অফিসঘরে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ব্যস্ত কর্মীরা কাজ করত, যেন এক সুরেলা সিম্ফনি। কিন্তু সেইসব স্মৃতি…
-
১ কলকাতার এক শীতল সন্ধ্যা। হাওয়ার ঝাপটায় জানালার কাঁচ খানিকটা কেঁপে ওঠে, বাইরের রাস্তার আলো ঘরের অন্ধকারকে ভেদ করতে পারে না। ছোট্ট টেবিলের ওপর খোলা ল্যাপটপে ইশিতা সেনের চোখ আটকে আছে। প্রথম বর্ষের কলেজছাত্রী সে, ক্লাস শেষ করে সাধারণত রাতেই পড়াশোনা আর সোশ্যাল মিডিয়ার খোলা জানালায় হারিয়ে যায়। তার একঘেয়ে দিনযাপনকে একটু প্রাণবন্ত করে রাখত প্রিয় বান্ধবী সুহানি দত্ত, কিন্তু সেই মেয়েটিই এখন আর নেই। ঠিক এক বছর আগে, কলেজের হোস্টেল থেকে হঠাৎ উধাও হয়েছিল সুহানি, পরে খবর এলো রহস্যজনকভাবে মারা গেছে সে। পুলিশ বলেছিল আত্মহত্যা, কিন্তু সেই কথায় কখনোই বিশ্বাস করতে পারেনি ঈশিতা। বন্ধু হারানোর যন্ত্রণা আর অসমাপ্ত প্রশ্নের…
-
পুরোনো বনেদি বাড়ি শহরের একটি পুরোনি অঞ্চলেই অবস্থিত, যেখানে সময় যেন থেমে গেছে। বাড়ির প্রবেশদ্বারে পৌঁছালেই চোখে পড়ে সেই বিশাল, ত্রিমাত্রিক কাঠের দরজা, যা কালের সঙ্গে বিবর্ণ হয়ে ধূসর হয়ে উঠেছে। দরজার নক বেজে উঠলেই মনে হয় যেন অতীতের কোনো আভাস শোনাচ্ছে। বাইরে থেকে বাড়ি যতটা বড় মনে হয়, ভেতরে প্রবেশ করলে তার বিশালতা আরও প্রমাণিত হয়—দীর্ঘ, অন্ধকার করিডর, যার একপাশে ধুলো জমে থাকা অগণিত প্রতিমা স্থাপন করা। প্রতিমাগুলোর চোখ যেন জীবন্ত, মনে হচ্ছে কেউ নীরবে কাত হয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ির ভেতরের অব্যক্ত রহস্যগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। করিডরের মাঝখানে একটি পুরোনো ঝুলন্ত বাতি, যার কাঁচে ধুলো জমে রয়েছে, আর কখনো কখনো বাতির…
-
অমিয় মল্লিক ১ ভোরের ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন আকাশের গাঢ় নীল ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে রঙ নেয় কমলা-সোনালি আভা, গ্রামের মানুষদের ঘুম যেন এক অদৃশ্য শক্তি ভেঙে দেয়। একে একে কুঁড়েঘরের দরজা খুলে যায়, উঠোনে আলো ফোটার আগেই গৃহস্থরা চমকে ওঠে—দূর থেকে ভেসে আসছে এক অদ্ভুত সুর, এক চণ্ডীপাঠের গম্ভীর ধ্বনি। মাটির ভেতর থেকে যেন শিকড় টেনে আনে সেই শব্দ, আর সকালের শিউলি গাছের ফুলের মতো বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামবাসী জানে, সেই বাড়িটা বহু বছর ধরে ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে, তাতে আর কেউ থাকে না। তবু প্রতি মহালয়ার ভোরেই শোনা যায় এই পাঠ। বৃদ্ধারা চোখে আতঙ্ক মাখে, কিশোররা সাহস দেখাতে…
-
অধ্যায় ১ — উত্তর কলকাতার পুরনো পাড়াগুলোর এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে—গলির ভেতর ঢুকলেই সময় যেন কয়েক দশক পিছিয়ে যায়। আধুনিক শহরের ব্যস্ততার বাইরে, এখানে এখনো ছিমছাম পুরনো দোতলা-তিনতলা বাড়ি, কার্নিশে শ্যাওলা জমে থাকা দেওয়াল, এবং ধুলো জমা বারান্দার খিলান। সেই রকমই এক সরু, বাঁকানো গলি—যেখানে দিনের বেলাতেও আলো ঠিকমতো ঢোকে না। গলির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন দোতলা বাড়ি, যার লোহার গেট মরচে পড়ে বাদামি হয়ে গেছে, আর তার ওপরে গাছের লতা-পাতা জট বেঁধে পড়ে আছে। লোকজন দিনের বেলায়ও বাড়িটির দিকে তাকাতে সাহস পায় না, রাতের কথা তো বাদই দিলাম। কারণ গুজব বলে, রাত নামলেই দ্বিতীয় তলার এক জানালায় জ্বলে…
-
১ প্রাচীন কাল থেকে গ্রামটির নাম শিউলিবাড়ি, তবে এই নামের আড়ালে লুকিয়ে আছে বহু গোপন কাহিনি। গ্রামের উত্তর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষ প্রাচীন তন্ত্রপীঠ মন্দির, যার কাহিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কানে কানে পৌঁছেছে। লাল ইটের গায়ে শ্যাওলা জমে গেছে, ফাটল ধরা প্রাচীর থেকে গাছের শিকড় নেমে এসেছে যেন সময়ের আঁচড়। জনশ্রুতি আছে, এই মন্দির একসময় এক তান্ত্রিক রাজা নির্মাণ করেছিলেন, যিনি দেবীর কৃপা পাওয়ার জন্য নরবলি পর্যন্ত দিতেন। গ্রামের বয়স্করা বলেন, মন্দিরের অন্তঃকক্ষে এক গোপন দরজা আছে, যার ওপারে বন্দি রয়েছে এক অদ্ভুত অলৌকিক শক্তি—শক্তি, যা একবার মুক্তি পেলে সমগ্র অঞ্চলকে ধ্বংস করে দিতে পারে। দিনের বেলাতেও মন্দিরের ভেতরে…
-
সঞ্জয় দে এক ঝর্ণাটির সামনে দাঁড়িয়ে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে যুবকটি, যেন এই নির্জন জলপ্রপাত এক গভীর নিঃশব্দ ডাক ছুঁড়ে দিচ্ছে তার বুকের ভেতর। গ্রামের একপ্রান্তে ঘন জঙ্গলের পেছনে লুকিয়ে থাকা সেই বিশাল ঝর্ণা, দিনের আলোয় যেন স্বচ্ছ অথচ রহস্যে মোড়া। জনশ্রুতি বলে, এই ঝর্ণায় কেউ একবার ঢুকলে আর ফিরে আসে না—আর এমন নিখোঁজের ঘটনা কেবল একজন নয়, বহুজনের। মানুষজন বলত, তারা নিজের চোখে দেখেছে—কে যেন একদিন হেঁটে হেঁটে ঝর্ণার ধার ঘেঁষে জলের ভেতরে ঢুকে গেল, কিন্তু জল কোনো গতি ছাড়াই স্থির থেকে গেল, আর সেই মানুষ আর ফিরে এল না। পঁচিশ বছর আগে এমনই একদিন যুবকের বাবা, একজন…
-
প্রিয়ম সাহা ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টায় বিছানায় গড়াগড়ি করছিল, যখন ঘড়ির কাঁটা ঠিক ১২টা ছুঁলো। জানলার ওপারে কুকুরের ঘেউ ঘেউ, আশেপাশে নিস্তব্ধতা, আর ফোনের নোটিফিকেশন টুং টুং শব্দে হঠাৎ রাতটা কেমন অদ্ভুত ঠেকতে লাগল। গড়িয়াহাটের পুরনো বাড়ির দোতলার ঘরটায় আজ একা সে, ঠাকুরদা গত বছর মারা যাওয়ার পর তার পরিবার এখন উপরের ফ্ল্যাটে থাকে, সে নিচে নিজের মতো করে কাজ আর একলা সময় কাটায়। তখনই ফোনে ভেসে উঠল এক অচেনা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের নোটিফিকেশন — “You’ve been added to the group: Dead But Chatty”। মনে হলো কেউ নিশ্চয়ই প্র্যাঙ্ক করছে, এমন নাম কে রাখে! কিন্তু যখন সে গ্রুপ খুলে দেখল, সেখানে লেখা…