গ্রামের কালীমন্দিরে দুর্গাপূজার অষ্টমীর রাত মানেই এক অন্যরকম আবহ। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসত এই মন্দিরের পুজো দেখতে। সন্ধ্যা থেকেই মন্দিরের চত্বর আলোয় ভরে উঠেছিল, শঙ্খধ্বনি, ঢাকের শব্দ, কাশীর বাঁশির সুর আর ধূপকাঠির ধোঁয়া মিলেমিশে এক অনন্য পরিবেশ তৈরি করেছিল। গ্রামের ছোটো থেকে বড়ো সবাই নতুন কাপড় পরে এসেছিল, কেউ প্রণাম দিতে, কেউ আবার প্রতিমা দর্শন করে আনন্দ পেতে। মন্দিরের সামনের উঠোনে তখন নাচগানের আসর বসেছিল, কচিকাঁচারা ধুনুচি হাতে ঘুরছিল আর মায়ের আরাধনায় মেতে উঠেছিল। একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন কুমুদিনী দেবী, গ্রামের জমিদারবাড়ির বিধবা, তাঁর চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা, যেন উৎসবের আনন্দের ভেতরও কোথাও এক অজানা ভয় তাঁর বুক চেপে ধরেছিল। পুরোহিত…
-
-
প্রকাশ মাহাতো ১ পুরুলিয়ার ঘন জঙ্গলের ভেতরে সকালের কুয়াশা তখনও পুরোপুরি কাটেনি, সূর্যের আলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে নেমে এসে ঝিলমিল ছায়া তৈরি করছিল মাটির ওপর। চারপাশে শুধু শাল, সেগুন আর মহুয়ার বন, যেখানে পাখির ডাক মিলেমিশে এক অদ্ভুত সুর তৈরি করছিল। গ্রামের শ্রমিকরা দল বেঁধে এসেছিল কাঠ কাটতে, হাতে কুড়াল, কাঁধে দড়ির বোঝা, কারও কোমরে বাঁধা পুরনো কাপড়, যাতে পরে কাঠ বেঁধে নিয়ে যাওয়া যায়। এই দলটার মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ছিল শিবলাল মাহাতো, বয়সে পঁয়তাল্লিশ ছুঁইছুঁই, রোদে পোড়া চেহারা আর চোখে গাঢ় দুশ্চিন্তার ছায়া। সে বহুবার এ জঙ্গলে ঢুকেছে, কিন্তু প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে এই জঙ্গলের বুকের ভেতর যেন কোনও…
-
সন্দীপ সেনগুপ্ত হুগলির বিস্তীর্ণ গ্রামীণ প্রান্তরে, নদীর ধারে শ্যাওলায় ঢাকা ইটের প্রাচীর আর ধ্বংসস্তূপের মতো দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরনো গড়। সময়ের ক্ষয়ে ক্ষয়ে এর অনেকটা ভেঙে পড়েছে, অনেকটা মাটির নিচে চাপা পড়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় নিস্তব্ধ প্রকৃতির কোলে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো অদ্ভুত নিদর্শন, অথচ স্থানীয়রা একে ভয়ে এড়িয়ে চলে। দীর্ঘদিন ধরে শোনা যায়, গড়ের ভেতরে রাত নামলে অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়—কখনো তলোয়ারের ঝনঝনানি, কখনো পদশব্দ, আবার কখনো গভীর নিশ্বাসের আওয়াজ। ফলে গ্রামবাসীর চোখে এ জায়গা “অভিশপ্ত” বলেই পরিচিত হয়ে উঠেছে। এই ভয়ের মধ্যেও সরকার ঠিক করে, প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে জায়গাটি খনন করা দরকার। হয়তো গড়ের ভেতর থেকে মিলবে বাংলার ইতিহাসের…
-
১ কলকাতার উত্তর শহরের ভেতর একসময়ের জমজমাট থিয়েটার আজ ধ্বংসস্তূপের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকের দেওয়ালে স্যাঁতস্যাঁতে দাগ, ছাদের প্লাস্টার খসে পড়েছে, অডিটোরিয়ামের আসনগুলোতে ধুলো জমে পাহাড়ের মতো স্তূপ তৈরি হয়েছে, অথচ সব্যসাচী সেনের চোখে যেন অন্য এক স্বপ্ন ভেসে উঠেছিল। সে অনেকদিন ধরে ভেবেছিল তার নতুন নাটক কোথায় মঞ্চস্থ করবে—এমন জায়গা চাই যেখানে কেবল আলো-শব্দের খেলা নয়, জায়গাটাই যেন নাটককে জীবন্ত করে তুলতে পারে। যখন প্রথম এই ভাঙাচোরা থিয়েটারের ভেতর পা রাখল, তখনই অনুভব করল এক অদ্ভুত শীতল স্রোত তার শরীর বেয়ে নেমে যাচ্ছে, অথচ সেই শীতলতার ভেতরেই যেন জন্ম নিচ্ছে এক ধরনের কৌতূহল। কুহু মুখার্জী, নাটকের নায়িকা, প্রথম দিনেই…
-
ইন্দ্রনীল নস্কর ১ প্রায় সন্ধ্যার আগমুহূর্তে অর্ণব সেন পৌঁছালো সেই অজপাড়া গাঁয়ে। শহরের চওড়া রাস্তা, আলো ঝলমলে বিলবোর্ড আর ব্যস্ত ট্রাফিকের ভিড় পেরিয়ে, ধীরে ধীরে যখন গ্রামের সরু কাঁচা পথে প্রবেশ করল, তখন মনে হলো যেন অন্য এক জগতে এসে পড়েছে। চারপাশে নিস্তব্ধতা, কেবল মাঝে মাঝে দূরে শোনা যাচ্ছে শিস দিয়ে হাওয়া বয়ে চলার শব্দ। কোথাও কোথাও কয়েকটি ঝুপড়ি ঘর, ছোট ছোট বাঁশবনের আড়াল, আর সেগুলোর ফাঁক দিয়ে ভেসে আসা গরু-মোষের ঘণ্টাধ্বনি মিলিয়ে যাচ্ছে গোধূলির আলোয়। এই গ্রামটির কথা অর্ণব আগেই শুনেছিল—একটি প্রাচীন লোককথার জন্য বিখ্যাত। নদীর ধারে নাকি এমন সব ঘটনা ঘটে, যা মানুষের কল্পনারও অতীত। অর্ণব ইতিহাস গবেষক,…
-
অনিন্দ্য দে ১ গ্রামের রাত সবসময়ই শান্ত, বিশেষ করে শীতের শেষে ফাগুনের সন্ধ্যায় যখন চারপাশে পেঁচা ডাকে আর দূরে কোথাও শেয়ালের ডাক ভেসে আসে। সেদিনও তেমনই এক রাত। আকাশে চাঁদ নেই, শুধু অন্ধকারের চাদর মাটিকে ঢেকে রেখেছে। দূরে দূরে ক্ষেতজমির মাঝে জোনাকিরা আলো জ্বালাচ্ছিল ক্ষুদ্র প্রদীপের মতো। গ্রামের লোকেরা তখন গভীর নিদ্রায়, কেবল কয়েকজন কৃষক কাজের ফাঁকে রাত জেগে বসেছিল মচানঘরে। হঠাৎই নিস্তব্ধতার বুক চিরে ভেসে এল এক অদ্ভুত শব্দ—শাঁখের আওয়াজ। শাঁখ বাজানোর সেই সুর গ্রাম্য পূজার সময় সবাই শুনেছে, কিন্তু আজকের সেই সুর ভিন্ন ছিল—অত্যন্ত দীর্ঘ, করুণ আর বেদনায় ভরা। কৃষকরা প্রথমে ভেবেছিল হয়তো কোনো বাড়িতে পূজা চলছে, কিন্তু…
-
অনিৰ্বাণ সেনগুপ্ত ১ কলকাতার গঙ্গার ধারে সন্ধ্যার পরই এক অদ্ভুত আবহ ছড়িয়ে পড়ে। দিনের ব্যস্ততা, মালবোঝাই বার্জের হর্ন, নৌকার ভিড় আর ঘাটের চেঁচামেচি—সব মিলিয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত জায়গাটা থাকে কর্মচঞ্চল। কিন্তু সূর্য নামলেই চেনা ছবিটা ধীরে ধীরে বদলে যায়। ঘাটের ধারে বসে থাকা চায়ের দোকানদার আলো নিভিয়ে বাড়ি ফেরে, কাঁকড়া বা ছোট মাছ বিক্রির টাটকা হট্টগোল স্তব্ধ হয়ে যায়, আর গঙ্গার কালো জল যেন আরও ঘন হয়ে ওঠে। সেই অন্ধকারেই দাঁড়িয়ে থাকে পুরনো ব্রিটিশ কবরস্থান—ধূসর পাথরের ক্রস, শেওলা ধরা সমাধিফলক আর আধভাঙা গম্বুজওয়ালা সমাধি। কবরগুলোর চারপাশে রাত নামলেই এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি পাহারা দিচ্ছে। যারা প্রতিদিন…
-
পাৰ্থ প্ৰতিম রায় ১ অরিন্দম চক্রবর্তী কলকাতার ভিড়ভাট্টা, কোলাহল আর অনিশ্চয়তায় ভরা জীবন ছেড়ে এসেছিল এই প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে তাকে নতুন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কলেজের দিনগুলোতে তার স্বপ্ন ছিল একদিন শান্ত, নিরিবিলি কোনো জায়গায় পড়াশোনার মাধ্যমে মানুষ গড়ে তোলা। তবে শহরের ব্যস্ত রাস্তাঘাট, হট্টগোল আর অন্তহীন প্রতিযোগিতার ভেতর সে যেন নিজের ভেতরকার স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেছিল। গ্রামে এসে প্রথম দিনেই যখন সে হেঁটে যাচ্ছিল ধুলোমাখা কাঁচা রাস্তা ধরে, তখন চারপাশের নিস্তব্ধতা তার মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দিয়েছিল। দূরে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, তালগাছের মাথায় ডুবে যাওয়া সূর্যের আলো, আর একেবারে নিঃসঙ্গ সোনালি সন্ধ্যা—সবকিছু মিলিয়ে তাকে মনে হয়েছিল, সে যেন…
-
সুমনা মাইতি অধ্যায় ১ – গ্রামের চৌহদ্দি পেরিয়ে কিছুদূর এগোলেই যে জঙ্গলঘেরা পথটা মাঠের দিকে চলে গেছে, তার মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে এক বিরাট পুরোনো বটগাছ। চারদিকে ঝুলে থাকা অজস্র দড়ির মতো শেকড় আর অন্ধকারে ঢেকে রাখা পাতার ছাউনি যেন দূর থেকে দেখলে আকাশের সঙ্গে মিশে থাকা কোনো দানবের রূপ মনে হয়। দিনের বেলা মানুষ সেখানে গরু চরাতে যায়, শুকনো কাঠ কুড়িয়ে আনে, কিংবা ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেয়। কিন্তু সন্ধ্যা নামলেই অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নেমে আসে, পাখিরা ডাকতে ডাকতে থেমে যায়, আর বটগাছের শেকড়ের ফাঁক দিয়ে ওঠে অচেনা ফিসফিস শব্দ। গ্রামের ছেলেমেয়েরা একে অপরকে ভয় দেখাতে প্রায়ই বলে—“ওই গাছটার নিচে ভূত…
-
১ শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা সেই নাট্যমঞ্চের নাম একসময় উচ্চারণ করলেই লোকেদের চোখে ভাসত জৌলুশ, আলো, করতালির ঝড় আর অভিনয়ের এক অদ্ভুত মায়াবী মঞ্চ। থিয়েটারের আসল গর্ব ছিল এর দল, যেখানে দেশের প্রথম সারির অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সমাগম হতো। সেদিনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। মঞ্চে উঠেছিল বহুল প্রতীক্ষিত নতুন নাটক—“রক্তচক্ষু।” শহরের সাংস্কৃতিক মহলে বহুদিন ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই নাটক, কারণ এটি পরিচালনা করেছিলেন কিংবদন্তি নাট্যকার অমরেশ সেন নিজে। অডিটোরিয়াম ভর্তি দর্শকেরা অধীর আগ্রহে বসেছিলেন, তাদের চোখে মুখে আলো ঝলমল করছিল মঞ্চের প্রথম দৃশ্যের অপেক্ষায়। পর্দা উঠল, আলো জ্বলে উঠল, আর নাটকের সংলাপে ভেসে গেল চারপাশ। শুরুটা ছিল নিখুঁত, অভিনেতাদের অভিনয়,…