সুশান্ত দাস ১ গ্রামের পুকুরটি সবসময়ই একটি রহস্যময় উপস্থিতি বয়ে আনে। দিনের আলোয় যখন গ্রামের মানুষ সাধারণ কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে, তখনও পুকুরটি যেন নীরবভাবে তাদের নজর কাড়ে। পুকুরটির পানি গভীর এবং অন্ধকারের মিশ্রণে যেন অদ্ভুত এক আভা ছড়িয়ে দেয়। পুকুরের চারপাশে হালকা ঘাস আর কিছু ছোট গাছ থাকলেও, রাতে সেই ঘাস আর গাছের ছায়া যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। গ্রামের মানুষ নানা গল্প শোনায়—কিছু গল্প কেবল ভয়ের, আবার কিছু গল্পে বলা হয় বহু বছর আগে এখানে একটি মেয়ের রহস্যময় মৃত্যু ঘটেছিল। সেই মেয়েটিকে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। লোকেদের কথা অনুযায়ী, মেয়েটির আত্মা এখনও পুকুরের পানির মধ্যে ভেসে বেড়ায়।…
- 
				
 - 
				
সায়ন্তন বসু অধ্যায় ১ : জমিদারবাড়ির নিস্তব্ধতা প্রাচীন গ্রাম বাংলার বুক জুড়ে যে অট্টালিকা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়। সময়ের আঁচড়ে তার দেয়াল জীর্ণ হয়ে গেছে, ছাদের টালির ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ে বৃষ্টির জল, দেউড়ির মোটা কাঠের দরজায় ঝুলছে মরচেধরা তালা, অথচ এখনো মনে হয়—এ যেন এক ইতিহাস সাক্ষী হয়ে আছে। এ বাড়িটি এককালে ছিল রাজবাড়ির মতোই জাঁকজমকপূর্ণ জমিদারবাড়ি, যেখানে গরিব কৃষকদের ঘামে গড়া সম্পদ মজুত হতো, আর রাতে চলত রেশমি শাড়ি, নকশি পাঞ্জাবি, সোনার গয়নার রোশনাই। কিন্তু কালের নিয়মে জমিদারি প্রথা ভেঙে যাওয়ার পর বাড়িটি ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে শুরু করে। বংশধরেরা কেউ কলকাতায়, কেউ লন্ডনে…
 - 
				
সুমন্ত বসাক অধ্যায় ১: নতুন চাকরি অনির্বাণের বয়স মাত্র চব্বিশ। স্নাতক পাশ করার পর থেকেই কাজের খোঁজে এখানে-ওখানে ছুটছে, কিন্তু ভাগ্য যেন তাকে বারবার ঠকাচ্ছে। শহরে একসময় অনেক চেষ্টা করেছিল, কল সেন্টারের চাকরি থেকে শুরু করে প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতার জন্য সাক্ষাৎকার দিয়েছে, কিন্তু কোথাও ঠিকমতো জায়গা হয়নি। গ্রামে ফিরে আসতে হয়েছে খালি হাতে। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়েছে, আর মায়ের অসুখে ওষুধের খরচ মেটানোই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ অবস্থায় গ্রামের মুন্সি হঠাৎ একদিন খবর দিল—পঞ্চায়েতের তরফ থেকে প্রহরীর একটা পদ খালি আছে। তবে জায়গাটা হলো গ্রামসংলগ্ন পুরনো শ্মশান। শুনে অনির্বাণের শরীর শিউরে উঠেছিল। শ্মশান পাহারা দেওয়া…
 - 
				
অনিৰ্বাণ দাস ১ গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ভিলাটির জন্ম একেবারে ইতিহাসের গর্ভে লুকিয়ে আছে। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন চন্দননগর ছিল ফরাসি উপনিবেশের এক প্রধান কেন্দ্র, তখন ফরাসি কনসাল জ্যঁ-ব্যাপটিস্ট দ্য ল্যাঁক তাঁর পরিবারের জন্য এই ভিলাটি নির্মাণ করেছিলেন। গঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চল তখন ছিল বাণিজ্যের জন্য অমূল্য সম্পদ—রেশম, নীল, আফিম, মসলিনের ব্যবসায় মত্ত হয়ে উঠেছিল ফরাসি বণিকেরা। ইউরোপীয় জাহাজ এসে ভিড়ত বন্দরঘাটে, আর গঙ্গার জলে প্রতিদিন প্রতিফলিত হতো সাদা পালের ছায়া। ভিলাটি ছিল তাঁদের ঐশ্বর্যের প্রতীক—সাদা চুনে মোড়া দেওয়াল, নীল রঙে রাঙানো কাঠের জানালা, আর রোমান খিলানের মতো খোলা বারান্দা। চারদিকে ছায়াঘেরা বাগান, যেখানে ইউরোপ থেকে আনা গাছপালা যেমন ছিল,…
 - 
				
প্রমিত চৌধুরী ১ শান্তিনগর গ্রামের প্রাচীন জমিদারবাড়িটি যেন এক ইতিহাসের দলিল, কিন্তু সেই ইতিহাস আজ ধ্বংসস্তূপের স্তূপে চাপা পড়ে আছে। লাল ইটের গা বেয়ে নেমে এসেছে লতাপাতা, জানালার কাঠের খাঁচাগুলো ভেঙে পড়েছে, আর দালানের ছাদের টালিগুলো অর্ধেক জায়গায় খসে গিয়ে আকাশের আলো ঢুকে পড়েছে ভেতরে। গ্রামবাসী দিনের আলোয় জমিদারবাড়ির পাশ দিয়ে গেলেও ভেতরে প্রবেশ করতে ভয় পায়, কারণ তারা বিশ্বাস করে এখানে কেবল ভগ্নদালান নয়, লুকিয়ে আছে অভিশপ্ত অতীত। তবে এই জমিদারবাড়ির ধ্বংসস্তূপের মাঝেও যেটি অদ্ভুতভাবে টিকে আছে তা হলো আটচালা। প্রাচীন কালের মতোই তার খিলানদ্বারগুলো দাঁড়িয়ে আছে, অর্ধেক জায়গায় ধসে গেলেও এক ধরনের অদ্ভুত দৃঢ়তায় সে দাঁড়িয়ে থেকে যেন…
 - 
				
সুপ্ৰকাশ মুখার্জী ১ অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামের অলিগলিতে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। সন্ধের প্রার্থনা শেষ হলে কাকাদের আড্ডা থেমে যায়, খুদেরা দৌড়ঝাঁপ বন্ধ করে মায়েদের আঁচলের আড়ালে ঢুকে পড়ে। একমাত্র যিনি তখনও সক্রিয়, তিনি রাধিকা কাকিমা। বয়স আশির কাছাকাছি, মুখভর্তি কুঁচকানো ভাঁজ, মাথার চুল প্রায় সাদা, তবুও তার চোখদুটি এখনো অদ্ভুত উজ্জ্বল। গ্রামের বাচ্চারা যখন চারদিকে ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন সন্ধেবেলায় তার উঠোনে জড়ো হয়। উঠোনের মাঝখানে রাখা মাটির প্রদীপটিতে হলদেটে আলো জ্বলে ওঠে, আর কাকিমার গলায় ভেসে আসে সেই পুরোনো দিনের গল্প। আজও তিনি বসে আছেন শালপাতার পাখা হাতে, যেন সেই আলো আর বাতাসকে গল্পের তালে তালে…
 - 
				
জয়ন্ত চক্রবর্তী অধ্যায় ১ – নতুন বাড়ি অর্পিতা নতুন ভাড়া বাড়িতে ওঠার দিনটি ছিল এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতির। শহরের রাস্তায় গাড়ি, মানুষ আর চেনা ভিড়ের মধ্যে থেকে বের হয়ে নতুন ঠিকানায় পৌঁছানো, মনে একধরনের অচেনা উত্তেজনা এবং অজ্ঞাত ভয়ের সংমিশ্রণ তৈরি করেছিল। বাড়ির বাইরে থেকে দেখলে মনে হতো, এটি যেন এক সাধারণ, পুরনো শহরের বাড়ি—সাদা দাগ, ছেঁড়া রঙের দেয়াল, এবং অল্প গাছপালার ছায়া—কিন্তু ভেতরে ঢুকেই সবকিছু বদলে যায়। লম্বা করিডর, ফাঁকা ঘরের নিস্তব্ধতা এবং ধুলোমাখা জানালার কাচের মাঝে ধীরে ধীরে রোদ পড়া, তার মনকে এক ধরনের অদ্ভুত শান্তি দিয়ে ভরিয়ে দেয়। অর্পিতা ভাড়া বাড়িতে ওঠার আগে যেমন অনেক সময় চিন্তিত…
 - 
				
অধ্যায় ১ : পুরনো ডাকঘর অরিন্দম চক্রবর্তী শহুরে মানুষ। কলকাতার ভিড় আর ব্যস্ততার ভেতর বহু বছর চাকরি করে হঠাৎই একদিন ট্রান্সফারের চিঠি এসে যায় তার হাতে—পশ্চিমবঙ্গের এক অখ্যাত গ্রামে তাকে বদলি করা হয়েছে নতুন পোস্টমাস্টার হিসেবে। প্রথমে একটু মন খারাপ হয়েছিল, কেননা শহরের আরাম, বন্ধুদের আড্ডা, সিনেমা হল বা বইয়ের দোকান সব কিছুই ছেড়ে আসতে হবে। তবু ভেতরে ভেতরে কৌতূহলও ছিল, গ্রামীণ জীবনের স্বাদ নেওয়া যাবে, আর নতুন জায়গার নতুন অভিজ্ঞতাও তো একরকম রোমাঞ্চ। ট্রেন থেকে নামতেই গ্রামের ছবিটা তার চোখে ধরা দেয়—চওড়া কাঁচা রাস্তা, দুই পাশে ধানক্ষেত, হাওয়ায় ভেসে আসা খড়ের গন্ধ, আর দূরে সাদা মন্দিরের শিখর। এমন সরল…
 - 
				
অধ্যায় ১ – রাতের যাত্রী শহীদুল আলি সেই রাতের ট্যাক্সি চালানোর অভিজ্ঞতা কখনো ভুলবেন না—যেমন কোনো অদ্ভুত স্বপ্ন বাস্তবের আড়ালে ঝুঁকে থাকে, ঠিক তেমনই। রাত গভীর, পার্ক স্ট্রিটের আলো ফিকে, দোকানগুলোর ঘুমে ঢেকে থাকা রঙিন নৈশপ্রদীপ যেন আংশিক জ্বলছে। শহীদুলের চোখ সারাদিনের ক্লান্তি সঞ্চয় করে ঠিক তেমনই ম্লান, কিন্তু তিনি সচেতন ছিলেন—রাতের শহর তাঁর জন্য এক বিশেষ অবসান নয়, বরং একটি নতুন দিনের শুরু। হঠাৎ, মোহনগলি পার্কের কাছে, ফুটপাথে দাঁড়ানো এক মহিলা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সাদা শাড়ি, যার ধূসর আলোয় প্রায়ই নরম ক্রীমের আভা ফুটে উঠছে, এবং নরম হাসি যা যেন অন্ধকারের মধ্যে আলো ছড়াচ্ছে। তিনি ট্যাক্সিতে উঠে বসলেন…
 - 
				
১ শান্তিপুর গ্রাম যেন একদিকে শান্ত, অন্যদিকে ভয়ঙ্কর রহস্যে মোড়া। গ্রামটি ছোট, কিন্তু চারদিকে বিস্তৃত ধানক্ষেত, ঘনবনের মাঝখানে পেঁচানো কাঁচা রাস্তা আর দিগন্তজোড়া নীরবতা যেন একে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। দিনের বেলায় এই গ্রাম প্রাণচঞ্চল—কৃষকের হালচাষ, বাচ্চাদের খেলা, মহিলাদের কুয়োয় ভিড় জমা, আর বিকেলের পর আড্ডায় মেতে ওঠা যুবকরা। কিন্তু রাত নামলেই অন্য ছবি। গ্রামের মানুষদের মুখে একটা অনবরত ফিসফিস—সোনালি পালকির গল্প। বহু প্রজন্ম ধরে চলা এই কাহিনি এতটাই শক্তভাবে গ্রামের মাটিতে গেঁথে গেছে যে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে সাহস পায় না কেউ। গল্পটা হলো, মধ্যরাতের অন্ধকারে কেবল একবার দেখা যায় অদ্ভুত এক সোনালি পালকি। মাটির রাস্তার ধুলোয় যেন আলো…