প্রমিত চৌধুরী ১ শান্তিনগর গ্রামের প্রাচীন জমিদারবাড়িটি যেন এক ইতিহাসের দলিল, কিন্তু সেই ইতিহাস আজ ধ্বংসস্তূপের স্তূপে চাপা পড়ে আছে। লাল ইটের গা বেয়ে নেমে এসেছে লতাপাতা, জানালার কাঠের খাঁচাগুলো ভেঙে পড়েছে, আর দালানের ছাদের টালিগুলো অর্ধেক জায়গায় খসে গিয়ে আকাশের আলো ঢুকে পড়েছে ভেতরে। গ্রামবাসী দিনের আলোয় জমিদারবাড়ির পাশ দিয়ে গেলেও ভেতরে প্রবেশ করতে ভয় পায়, কারণ তারা বিশ্বাস করে এখানে কেবল ভগ্নদালান নয়, লুকিয়ে আছে অভিশপ্ত অতীত। তবে এই জমিদারবাড়ির ধ্বংসস্তূপের মাঝেও যেটি অদ্ভুতভাবে টিকে আছে তা হলো আটচালা। প্রাচীন কালের মতোই তার খিলানদ্বারগুলো দাঁড়িয়ে আছে, অর্ধেক জায়গায় ধসে গেলেও এক ধরনের অদ্ভুত দৃঢ়তায় সে দাঁড়িয়ে থেকে যেন…
-
-
সুপ্ৰকাশ মুখার্জী ১ অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামের অলিগলিতে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। সন্ধের প্রার্থনা শেষ হলে কাকাদের আড্ডা থেমে যায়, খুদেরা দৌড়ঝাঁপ বন্ধ করে মায়েদের আঁচলের আড়ালে ঢুকে পড়ে। একমাত্র যিনি তখনও সক্রিয়, তিনি রাধিকা কাকিমা। বয়স আশির কাছাকাছি, মুখভর্তি কুঁচকানো ভাঁজ, মাথার চুল প্রায় সাদা, তবুও তার চোখদুটি এখনো অদ্ভুত উজ্জ্বল। গ্রামের বাচ্চারা যখন চারদিকে ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন সন্ধেবেলায় তার উঠোনে জড়ো হয়। উঠোনের মাঝখানে রাখা মাটির প্রদীপটিতে হলদেটে আলো জ্বলে ওঠে, আর কাকিমার গলায় ভেসে আসে সেই পুরোনো দিনের গল্প। আজও তিনি বসে আছেন শালপাতার পাখা হাতে, যেন সেই আলো আর বাতাসকে গল্পের তালে তালে…
-
জয়ন্ত চক্রবর্তী অধ্যায় ১ – নতুন বাড়ি অর্পিতা নতুন ভাড়া বাড়িতে ওঠার দিনটি ছিল এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতির। শহরের রাস্তায় গাড়ি, মানুষ আর চেনা ভিড়ের মধ্যে থেকে বের হয়ে নতুন ঠিকানায় পৌঁছানো, মনে একধরনের অচেনা উত্তেজনা এবং অজ্ঞাত ভয়ের সংমিশ্রণ তৈরি করেছিল। বাড়ির বাইরে থেকে দেখলে মনে হতো, এটি যেন এক সাধারণ, পুরনো শহরের বাড়ি—সাদা দাগ, ছেঁড়া রঙের দেয়াল, এবং অল্প গাছপালার ছায়া—কিন্তু ভেতরে ঢুকেই সবকিছু বদলে যায়। লম্বা করিডর, ফাঁকা ঘরের নিস্তব্ধতা এবং ধুলোমাখা জানালার কাচের মাঝে ধীরে ধীরে রোদ পড়া, তার মনকে এক ধরনের অদ্ভুত শান্তি দিয়ে ভরিয়ে দেয়। অর্পিতা ভাড়া বাড়িতে ওঠার আগে যেমন অনেক সময় চিন্তিত…
-
অধ্যায় ১ : পুরনো ডাকঘর অরিন্দম চক্রবর্তী শহুরে মানুষ। কলকাতার ভিড় আর ব্যস্ততার ভেতর বহু বছর চাকরি করে হঠাৎই একদিন ট্রান্সফারের চিঠি এসে যায় তার হাতে—পশ্চিমবঙ্গের এক অখ্যাত গ্রামে তাকে বদলি করা হয়েছে নতুন পোস্টমাস্টার হিসেবে। প্রথমে একটু মন খারাপ হয়েছিল, কেননা শহরের আরাম, বন্ধুদের আড্ডা, সিনেমা হল বা বইয়ের দোকান সব কিছুই ছেড়ে আসতে হবে। তবু ভেতরে ভেতরে কৌতূহলও ছিল, গ্রামীণ জীবনের স্বাদ নেওয়া যাবে, আর নতুন জায়গার নতুন অভিজ্ঞতাও তো একরকম রোমাঞ্চ। ট্রেন থেকে নামতেই গ্রামের ছবিটা তার চোখে ধরা দেয়—চওড়া কাঁচা রাস্তা, দুই পাশে ধানক্ষেত, হাওয়ায় ভেসে আসা খড়ের গন্ধ, আর দূরে সাদা মন্দিরের শিখর। এমন সরল…
-
অধ্যায় ১ – রাতের যাত্রী শহীদুল আলি সেই রাতের ট্যাক্সি চালানোর অভিজ্ঞতা কখনো ভুলবেন না—যেমন কোনো অদ্ভুত স্বপ্ন বাস্তবের আড়ালে ঝুঁকে থাকে, ঠিক তেমনই। রাত গভীর, পার্ক স্ট্রিটের আলো ফিকে, দোকানগুলোর ঘুমে ঢেকে থাকা রঙিন নৈশপ্রদীপ যেন আংশিক জ্বলছে। শহীদুলের চোখ সারাদিনের ক্লান্তি সঞ্চয় করে ঠিক তেমনই ম্লান, কিন্তু তিনি সচেতন ছিলেন—রাতের শহর তাঁর জন্য এক বিশেষ অবসান নয়, বরং একটি নতুন দিনের শুরু। হঠাৎ, মোহনগলি পার্কের কাছে, ফুটপাথে দাঁড়ানো এক মহিলা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সাদা শাড়ি, যার ধূসর আলোয় প্রায়ই নরম ক্রীমের আভা ফুটে উঠছে, এবং নরম হাসি যা যেন অন্ধকারের মধ্যে আলো ছড়াচ্ছে। তিনি ট্যাক্সিতে উঠে বসলেন…
-
১ শান্তিপুর গ্রাম যেন একদিকে শান্ত, অন্যদিকে ভয়ঙ্কর রহস্যে মোড়া। গ্রামটি ছোট, কিন্তু চারদিকে বিস্তৃত ধানক্ষেত, ঘনবনের মাঝখানে পেঁচানো কাঁচা রাস্তা আর দিগন্তজোড়া নীরবতা যেন একে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। দিনের বেলায় এই গ্রাম প্রাণচঞ্চল—কৃষকের হালচাষ, বাচ্চাদের খেলা, মহিলাদের কুয়োয় ভিড় জমা, আর বিকেলের পর আড্ডায় মেতে ওঠা যুবকরা। কিন্তু রাত নামলেই অন্য ছবি। গ্রামের মানুষদের মুখে একটা অনবরত ফিসফিস—সোনালি পালকির গল্প। বহু প্রজন্ম ধরে চলা এই কাহিনি এতটাই শক্তভাবে গ্রামের মাটিতে গেঁথে গেছে যে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে সাহস পায় না কেউ। গল্পটা হলো, মধ্যরাতের অন্ধকারে কেবল একবার দেখা যায় অদ্ভুত এক সোনালি পালকি। মাটির রাস্তার ধুলোয় যেন আলো…
-
গ্রামের কালীমন্দিরে দুর্গাপূজার অষ্টমীর রাত মানেই এক অন্যরকম আবহ। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসত এই মন্দিরের পুজো দেখতে। সন্ধ্যা থেকেই মন্দিরের চত্বর আলোয় ভরে উঠেছিল, শঙ্খধ্বনি, ঢাকের শব্দ, কাশীর বাঁশির সুর আর ধূপকাঠির ধোঁয়া মিলেমিশে এক অনন্য পরিবেশ তৈরি করেছিল। গ্রামের ছোটো থেকে বড়ো সবাই নতুন কাপড় পরে এসেছিল, কেউ প্রণাম দিতে, কেউ আবার প্রতিমা দর্শন করে আনন্দ পেতে। মন্দিরের সামনের উঠোনে তখন নাচগানের আসর বসেছিল, কচিকাঁচারা ধুনুচি হাতে ঘুরছিল আর মায়ের আরাধনায় মেতে উঠেছিল। একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন কুমুদিনী দেবী, গ্রামের জমিদারবাড়ির বিধবা, তাঁর চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা, যেন উৎসবের আনন্দের ভেতরও কোথাও এক অজানা ভয় তাঁর বুক চেপে ধরেছিল। পুরোহিত…
-
প্রকাশ মাহাতো ১ পুরুলিয়ার ঘন জঙ্গলের ভেতরে সকালের কুয়াশা তখনও পুরোপুরি কাটেনি, সূর্যের আলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে নেমে এসে ঝিলমিল ছায়া তৈরি করছিল মাটির ওপর। চারপাশে শুধু শাল, সেগুন আর মহুয়ার বন, যেখানে পাখির ডাক মিলেমিশে এক অদ্ভুত সুর তৈরি করছিল। গ্রামের শ্রমিকরা দল বেঁধে এসেছিল কাঠ কাটতে, হাতে কুড়াল, কাঁধে দড়ির বোঝা, কারও কোমরে বাঁধা পুরনো কাপড়, যাতে পরে কাঠ বেঁধে নিয়ে যাওয়া যায়। এই দলটার মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ছিল শিবলাল মাহাতো, বয়সে পঁয়তাল্লিশ ছুঁইছুঁই, রোদে পোড়া চেহারা আর চোখে গাঢ় দুশ্চিন্তার ছায়া। সে বহুবার এ জঙ্গলে ঢুকেছে, কিন্তু প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে এই জঙ্গলের বুকের ভেতর যেন কোনও…
-
সন্দীপ সেনগুপ্ত হুগলির বিস্তীর্ণ গ্রামীণ প্রান্তরে, নদীর ধারে শ্যাওলায় ঢাকা ইটের প্রাচীর আর ধ্বংসস্তূপের মতো দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরনো গড়। সময়ের ক্ষয়ে ক্ষয়ে এর অনেকটা ভেঙে পড়েছে, অনেকটা মাটির নিচে চাপা পড়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় নিস্তব্ধ প্রকৃতির কোলে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো অদ্ভুত নিদর্শন, অথচ স্থানীয়রা একে ভয়ে এড়িয়ে চলে। দীর্ঘদিন ধরে শোনা যায়, গড়ের ভেতরে রাত নামলে অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়—কখনো তলোয়ারের ঝনঝনানি, কখনো পদশব্দ, আবার কখনো গভীর নিশ্বাসের আওয়াজ। ফলে গ্রামবাসীর চোখে এ জায়গা “অভিশপ্ত” বলেই পরিচিত হয়ে উঠেছে। এই ভয়ের মধ্যেও সরকার ঠিক করে, প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে জায়গাটি খনন করা দরকার। হয়তো গড়ের ভেতর থেকে মিলবে বাংলার ইতিহাসের…
-
১ কলকাতার উত্তর শহরের ভেতর একসময়ের জমজমাট থিয়েটার আজ ধ্বংসস্তূপের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকের দেওয়ালে স্যাঁতস্যাঁতে দাগ, ছাদের প্লাস্টার খসে পড়েছে, অডিটোরিয়ামের আসনগুলোতে ধুলো জমে পাহাড়ের মতো স্তূপ তৈরি হয়েছে, অথচ সব্যসাচী সেনের চোখে যেন অন্য এক স্বপ্ন ভেসে উঠেছিল। সে অনেকদিন ধরে ভেবেছিল তার নতুন নাটক কোথায় মঞ্চস্থ করবে—এমন জায়গা চাই যেখানে কেবল আলো-শব্দের খেলা নয়, জায়গাটাই যেন নাটককে জীবন্ত করে তুলতে পারে। যখন প্রথম এই ভাঙাচোরা থিয়েটারের ভেতর পা রাখল, তখনই অনুভব করল এক অদ্ভুত শীতল স্রোত তার শরীর বেয়ে নেমে যাচ্ছে, অথচ সেই শীতলতার ভেতরেই যেন জন্ম নিচ্ছে এক ধরনের কৌতূহল। কুহু মুখার্জী, নাটকের নায়িকা, প্রথম দিনেই…