১ পুরনো শহরের খাম্বা-খাম্বা সড়ক পেরিয়ে ছাত্রটি অবশেষে সেই হোটেলের সামনে থামে, যেটি অনেক দিনের পুরনো কাহিনী আর শহরের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হোটেলটি বাইরে থেকে দেখতে চেহারা হিসাবে সময়ের সাক্ষী—পুরনো দেয়ালগুলোতে ফাটল, ধুলো জমে থাকা জানালা, এবং কখনো ভাঙা কখনো রঙ ছুঁয়ে থাকা দরজা, যেন প্রতিটি কোণই নিজের ভাষায় শহরের অতীত গল্পগুলো বলে। প্রবেশদ্বারে ধাতব ঘণ্টার গর্জন ভাঙতে ভাঙতে বাজে, আর সেই শব্দের প্রতিধ্বনি ভেতরের খালি প্রাঙ্গণে একটা অদ্ভুত নীরবতার সৃষ্টি করে। হোটেলের লবি কোনো সাধারণ হোটেলের মতো উজ্জ্বল বা আতিথ্যপূর্ণ নয়; বরং এতে আছে ধূসর রঙের ছায়া, পুরনো কাঠের মেঝেতে পা ফেলার সাথে সাথে কেবল ধীর ধীর শব্দ,…
-
-
অর্ণব মুখার্জি পর্ব ১ — নতুন স্কুলশিক্ষক বর্ষার শেষে যে ভেজা গন্ধ মাটির ভেতর পর্যন্ত ঢুকে থাকে, সেই গন্ধ নিয়েই অরিন্দম প্রথম দিন গ্রামে পা রাখল। ছোট্ট স্টেশন, নামটি শিলালিপির মতো খসে পড়া বোর্ডে, প্ল্যাটফর্মে দু-একটা কেরোসিনের ল্যাম্প টিমটিম করছে, আর দূরে শালগাছের রেখা এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন কারও পুরোনো হাতের লেখা— থরথর করে, তবু পড়া যায়। কলকাতা থেকে ট্রেনে নামার পর একটা ভাঙা টেম্পো তাকে স্কুল পর্যন্ত পৌঁছে দিল। স্কুল বলতে ইট-সিমেন্টের দুটো দোচালা ঘর, সামনের মাঠে ঘাস বুনোভাবে উঠে এসেছে, তালগাছের ছায়া পড়ে লম্বা কালচে দাগ। প্রধান শিক্ষক ছুটিতে; সাময়িক দায়িত্বে থাকা ক্লার্কটি, নাম হারাধন, পাতলা গলার লোক,…
-
সায়ন দত্ত অয়ন ছোটবেলা থেকেই ভূতের গল্পের প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভব করত। অন্ধকার ঘর, কাঁপতে থাকা মোমবাতি আর দাদুর মুখে শোনা অলীক কাহিনিই যেন তার ভিতরে কৌতূহলের বীজ বুনে দিয়েছিল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই কৌতূহল রূপ নিল এক নতুন রূপে—একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটরের উচ্চাকাঙ্ক্ষায়। তার ইউটিউব চ্যানেল “ভুতের সত্যি কাহিনি” খুব দ্রুত জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে, কিন্তু অয়ন জানে শুধু সাধারণ গল্প দিয়ে আর কাজ হবে না। দর্শকরা চাইছে কিছু ব্যতিক্রম, কিছু ভয়ঙ্কর অথচ বাস্তব মনে হয় এমন অভিজ্ঞতা। দিনরাত সে ল্যাপটপের পর্দায় বসে খুঁজতে থাকে কোথায় কী রহস্যময় জায়গা আছে, কারা সত্যিই ভুত দেখেছে, অথবা কোন অন্ধকার ইতিহাস…
-
অজয় মাহাতো ১ পুরুলিয়ার জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করতেই পর্যটক দলের মধ্যে এক অদ্ভুত উদ্দীপনা তৈরি হয়। পাকা রাস্তার সীমারেখা শেষ হতেই পথটি ঢেউ খেলানো মাটির ও শিকড়ে ভরা হয়ে ওঠে, চারপাশে গাছেদের সোনালি রোদ আর গাঢ় ছায়ার খেলা যেন এক আলাদা জগৎ খুলে দিচ্ছিল। দলের সকলের চোখে এক সঙ্গে আগ্রহ এবং অজানা ভয়ের মিশ্রণ—কারণ তারা জানত, এই জঙ্গলের মাঝখানে ব্রিটিশ আমলের এক ডাকবাংলো তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ করেই দেখতে পাওয়া যায় এক ধুলোমাখা, দু’তলার ভবন, যার খণ্ডিত জানালা আর দারুণভাবে কেটে ফেলা দরজা অতীতের কাহিনী কল্পনার আঙিনায় উদ্ভাসিত করছিল। ছায়াময় বাতাসে দূর থেকে ঘোড়ার টগবগ আওয়াজ…
-
অর্জুন দে ১ গ্রামের প্রান্তে অবস্থিত খোশরুরাজ সরকারের পুরনো বাড়িটি বছরের পর বছর আগের সেই ভাঙাচোরা মেঝে আর ছাদের গাছের ফাঁকফোকর দিয়েই তার কাহিনী বলে চলে। আজও বাড়ির দেয়ালে সোনালী দিনের স্মৃতিগুলো উজ্জ্বল—তবে এখন যেন ম্লান হয়ে এসেছে সময়ের ধুলোয়। খোশরুরাজ, যে এককালে গ্রামের মঞ্চের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী ছিলেন, এখন নির্জনতার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন। সাদা ধোঁড়া চুল আর গভীর রেখাচিত্র তার মুখে সময়ের সাক্ষী, কিন্তু চোখে এখন শুধুই নিস্তব্ধতা। পুরোনো দিনের গান আর সুরের স্মৃতি তার হৃদয়ে বাজে বারবার, যেন এক পুরানো রেকর্ড প্লেয়ারের সিডির মতো। তার একাকীত্ব ঘিরে রেখেছে একটি গভীর শূন্যতা—তাঁর একমাত্র সন্তান অনেক বছর আগেই শহরে…
-
দেবাংশু গুপ্ত ১ রবীন্দ্রনাথ গ্রামের এক অতি সাধারণ মাছ শিকারী। ছোটবেলা থেকেই তিনি মাছ ধরতেন, এবং সারা জীবনে এর চেয়ে বড় কোনো কাজ তার ছিল না। গ্রামটির পাশ দিয়ে চলে যাওয়া নদী, জলে ভাসমান ডাঙার পাশে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিন সকালে মাছ শিকার করতেন। তার হাতে ছিল এক বিশেষ নেট, একটি পুরনো কাঠের ডিঙি, আর তার চোখে সবসময় এক ধরনের আশ্চর্য শান্তি ছিল। গ্রামবাসীরা তাকে ‘রবি’ বলে ডাকতো, আর তার কাজের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ছিল অদ্ভুত। কোনো মাছ শিকারী যখন খালি হাতে ফিরত, রবীন্দ্রনাথ তখন তার কাঁধে ভালো মাছের নেট ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরত। তবে একদিন, এক পূর্ণিমা রাতে এমন একটি মাছ…
-
দেবায়ুধ পাল গাড়ি থামল কুঁয়োডাঙায় কুঁয়োডাঙা গ্রামের নামটা প্রথম শুনে মনে হয়েছিল কোথাও একটা গভীর কুয়ো আছে—শুধু গভীর না, এমন কিছু একটা যার দিকে তাকালেই গা ছমছম করে ওঠে। সুজয় যখন গাড়ি থামাল, তখন সন্ধে নামছে। পুরো গ্রাম যেন অন্ধকারের গায়ে চাদর মুড়িয়ে বসে আছে। অল্প আলোয় দেখে বোঝা গেল চারপাশে মাটির ঘর, তাল-খেজুর গাছ, আর একটাই পাকাবাড়ি—লাল ইটের একতলা, বন্ধ জানালায় কালো কাঁচ। ওটাই নাকি ‘ওদের’ বাড়ি। সুজয় কলকাতার একজন ছোটখাটো ইউটিউবার। নিজের চ্যানেল ‘ভূতুড়ে বাংলায়’ মাঝেমাঝেই চেনা-অচেনা ভৌতিক জায়গায় গিয়ে ভিডিও তোলে। আজ তার সঙ্গে এসেছে ক্যামেরাম্যান অলোক আর নতুন যুক্ত হওয়া সাউন্ড টেকনিশিয়ান রোহিনী। রোহিনী কিছুটা চুপচাপ…