সৌম্যজিত দে শহরের এক প্রান্তে, যেখানে আধুনিকতার কোলাহল আর নতুন বিল্ডিংয়ের উজ্জ্বল আলো পৌঁছায় না, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি পুরনো ফটোগ্যালারি। দীর্ঘদিন অবহেলায় ঢাকা ছিল এই জায়গা—ভাঙা ছাদের কোণ থেকে চুইয়ে পড়া বৃষ্টির পানি, কাঠের দরজায় কড়া নেড়ে যাওয়া বাতাসের শব্দ, আর অযত্নে পড়ে থাকা ভাঙা-চোরা ফ্রেম যেন সময়ের সাক্ষী হয়ে অপেক্ষা করছিল। শহরের মানুষ ধীরে ধীরে ভুলেই গিয়েছিল এর অস্তিত্ব, যেমন ভুলে যাওয়া যায় এক পুরনো গান বা বহু বছর ধরে বন্ধ হয়ে থাকা থিয়েটার। কিন্তু সম্প্রতি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে আবার খুলে দেওয়া হলো গ্যালারিটি। একরাশ ধুলো সরিয়ে, মরিচা পড়া তালা ভেঙে, আলতো করে ফটোগ্যালারির দরজা খোলার মুহূর্তটা যেন…
- 
				
 - 
				
পৌলমী দে ১ শীতকাল তার নিঃশব্দ পায়ে গ্রামের উঠোনে নেমে এসেছে বেশ কিছুদিন হল। মাঠের ঘাসে জমে থাকা শিশিরের ওপর দিয়ে হাঁটলে পায়ের শব্দ হয় না, কিন্তু শীতে মোড়া সেই স্তব্ধতায় সায়ন্তী প্রতিদিন একটা পরিচিত শব্দের অপেক্ষা করে থাকে—স্কুলঘরের প্রথম ঘণ্টা বাজা। সে দিনের শুরুটা হয় ঘুম ভাঙা মায়ের কাশির আওয়াজে, চায়ের কাপ গুনে ফেরা সংসারে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মাথায় উলের চাদর জড়ানো, ব্যাগে খাতা বইয়ের ভার; বাকি সব দিনের মতোই যেন। কিন্তু আজকের সকালে কুয়াশাটা একটু বেশি জমাট, আর হাওয়াটা যেন অতীতের গন্ধ নিয়ে আসে। গলির ধারে সেই পুরনো দোতলা বাড়িটা, যেটায় একসময় খেলাধুলা চলত, কাঁঠাল গাছের ডালে…
 - 
				
সৃজা দত্ত ১ কলকাতার গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই গোলাপি দরজাটার পেছনে একটা দুনিয়া লুকিয়ে আছে, যেটা বাইরের চোখে শুধু একটা বিউটি পার্লার, কিন্তু ভেতরে জমে আছে আত্মত্যাগ, লড়াই আর পুনর্জন্মের ইতিহাস। ‘মোহর’ নামের সেই পার্লারটা খুব বড় নয়—দুটো চেয়ার, একটা আয়না আর একটা স্টিমার মেশিন—তবু এই ছোট্ট ঘরটাই মোহিনী সেনের জীবনের মূলমঞ্চ। সকালে কাঁচের জানালায় সূর্যের আলো পড়ে, আর সেটা যখন পার্লারের পুরনো দেয়ালে আঁকা রাধা-কৃষ্ণের ছবিতে পড়ে, তখন যেন গোটা ঘরটা একটা শান্তি আর সৌন্দর্যের আশ্রয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এই শান্ত দৃশ্যের আড়ালে ছিলো মোহিনীর শৈশবের তীব্র অন্ধকার, বর্ধমানে জন্ম, সমাজের সঙ্গে প্রথম বিরোধ, মায়ের চোখের জল আর…
 - 
				
অরুণিমা বসু শিলিগুড়ির শহুরে আলোর ঠিক সীমারেখা পেরিয়ে, যেখানে পিচঢালা রাস্তা কাঁকরবিছানো পথের সঙ্গে হাত বদল করে, সেখানেই শুরু হয় জলদাপাড়ার রেঞ্জ—প্রায় ছয় হাজার হেক্টর জুড়ে বিস্তৃত এক জীবন্ত নিঃশব্দতা। অরিন্দম সরকার এখানে নতুন পোস্টিং পেয়েছে তিন মাস হল। ছোটবেলা থেকেই তার প্রকৃতির প্রতি অনুরাগ, কিন্তু সেটা কখনো উচ্চস্বরে বলা হয়নি। শান্ত, অল্পভাষী, সাদামাটা এই মানুষটা সদ্য কলকাতা থেকে বদলি হয়ে এসে একেবারে জঙ্গলের মাঝখানে এসে বসবাস শুরু করেছে—যেখানে সন্ধে নেমে এলে মানুষের অস্তিত্ব হারিয়ে যায়, আর কেবল গাছেদের ফিসফাস শোনা যায় হাওয়ার সঙ্গে। অরিন্দমের দিন শুরু হয় সূর্য ওঠার আগে। নিজের কঞ্চির তৈরি চায়ের কাপ হাতে করে সে বনপথ…
 - 
				
অর্ক ভট্ট ১ পদ্মার কোলঘেঁষে ছায়াঘেরা এক গ্রাম, যেখানে সকাল শুরু হয় কাকডাকা ভোরে আর শেষ হয় নদীর ঢেউয়ের নিঃশব্দ হাহাকারে। ঠিক সেই জায়গাটায় পৌঁছাল মেঘা সেন, শহরের এক ডকুমেন্টারি নির্মাতা, যাকে নিয়ে এসেছে তার নিজস্ব কৌতূহল—নদী, তার মানুষ আর তাদের জীবনগাথা। লাল মাটি, ভাঙাচোরা কাঁচা রাস্তা, কাদা-মাখা পায়ের ছাপ পেরিয়ে মেঘ দাঁড়ায় নদীর ঘাটে। কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরা, পরনে হালকা তুলো কাপড়ের সালোয়ার, চোখে একরাশ আগ্রহ আর মুখে একরাশ ক্লান্তি। তার চোখ প্রথমেই আটকে যায় এক মাঝির ওপর, যার গায়ের রং ঠিক নদীর পলির মতো ধূসর, যার নৌকা যেন নদীর বুকে গড়িয়ে চলা এক অভ্যস্ত ছায়া। সে জলে দাঁড়িয়ে জাল…
 - 
				
তন্বী মিত্র ১ কলকাতার এক পুরনো দোতলা বাড়ির ছাদে বসে ঈশিতা প্রতিদিন রাত নামার অপেক্ষায় থাকে। ঘড়ির কাঁটা নয়, তার সময়টা চলে আকাশের আলো বদলের সঙ্গে। সন্ধ্যা নামার একটু পরেই যখন শহরের কোলাহল মিইয়ে আসে, আর হালকা ঠান্ডা হাওয়া এসে কানে ফিসফিসিয়ে বলে—”এবার ওঠো,” তখন সে তার কাঠের চেয়ারে বসে ছাদে এসে হাজির হয়। তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি থাকে না, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত ঝিলিক খেলে যায়, যেটা শুধুই তারার আলোয় খুঁজে পাওয়া যায়। ঈশিতা জানে, সে একটা বিশেষ তারার জন্যই প্রতিদিন অপেক্ষা করে—একটা তারার যেটা প্রতিরাতে ঠিক একই জায়গায় জ্বলে, একই রকমভাবে, একইভাবে একা। তার ছাদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে…