নীলাক্ষি বসু বর্ষার রাত। আকাশ যেন কারও অন্তহীন শোক মেখে ভিজে উঠেছে। জানালার কাচের ওপরে টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে, ছোট ছোট দাগ টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিচের দিকে, আর তার সাথে মিশে যাচ্ছে দূরের বজ্রপাতের সাদা ঝলকানি। হোস্টেলের পুরনো দালানটা বৃষ্টির ঝাপটায় কাঁপছে, বাতাসের ঠান্ডা স্রোত বারবার জানালা ভেদ করে ঢুকে পড়ছে ছোট ঘরটায়। কক্ষের ভেতরে ম্লান আলোয় এক কোণে বসে আছে অর্পণ, সামনের টেবিলে খোলা সরকারি চাকরির প্রস্তুতির মোটা বই। পৃষ্ঠাগুলো ভিজে যাচ্ছে আর্দ্রতায়, মাঝে মাঝে পাতার কিনারা উল্টে উঠছে বাতাসে। অর্পণ খেয়াল করে, প্রতিবার জানালার কাচে বৃষ্টির আঘাত হলে তার বুকের ভেতরটাও অদ্ভুতভাবে ধকধক করে ওঠে। এ যেন…
-
-
ইরা মুখার্জি পর্ব – ১ উত্তর কলকাতার পুরোনো একতলা-বাড়িগুলোর গায়ে সময়ের দাগ খুব স্পষ্ট। ঝাপসা রঙের দেওয়ালে শ্যাওলার ছোপ, টিনের ছাদের নীচে শালিকদের বাসা, আর লোহার গেটের খোঁচা খাওয়া রঙ ম্লান হয়ে আছে বহুদিন। সেই রকমই এক বাড়ি, রায়বাড়ি—যার বারান্দায় বিকেলবেলা বাতাস অন্যরকম লাগে। এখানে প্রতিদিন বসে পড়েন অমলবাবু, সদ্য অবসর নেওয়া এক স্কুলশিক্ষক। হাতে এক কাপ চা আর সামনে পত্রিকা, যদিও অক্ষরের ভেতর ডুবে থাকার বয়স তার অনেক আগেই ফুরিয়েছে। চায়ের ধোঁয়া আর নিস্তব্ধতার ভেতর তিনি শুনতে পান আশেপাশের বাচ্চাদের চিৎকার, রাস্তায় সব্জিওয়ালার হাঁকডাক, আর মাঝে মাঝে হাওয়ার ঝাপটায় শিউলির গন্ধ। অমলবাবুর বারান্দার একপাশ থেকে হঠাৎ চোখে পড়তে শুরু…
-
অংশুমান সেনগুপ্ত কোলাহলমুখর শহরের ভেতরেও কিছু জায়গা থাকে যেখানে সময় যেন থেমে যায়, আর মানুষ খুঁজে পায় একটুখানি নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা। শহরের পুরোনো এক গলির ভেতর লুকিয়ে আছে ছোট্ট একটি ক্যাফে—“স্মৃতির ক্যাফে।” বাইরে থেকে খুব বেশি চমকপ্রদ নয়, কাঠের দরজার উপরে ঝুলছে ম্লান হয়ে যাওয়া নামফলক, জানালার কাচে প্রতিদিনের ধুলো জমে থাকে। কিন্তু দরজার ভেতরে ঢুকলেই অন্য এক জগৎ—হালকা বাদামি আলোয় সাজানো কাঠের টেবিল, দেয়ালে কিছু সাদা-কালো পুরোনো ছবি, আর কোণের শেলফে ছড়িয়ে থাকা বইপত্র। এখানে প্রবেশ করা মানেই শহরের কোলাহল ফেলে আসা, যেন অন্য এক জগতে ঢুকে পড়া। সেই সন্ধ্যাতেই অর্ণব প্রথমবার এই ক্যাফের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। বাইরে…
-
অভিজিৎ মল্লিক পর্ব ১: লাল মাটির পথে লাল মাটির রাস্তা ধরে যখন ইরা প্রথমবারের মতো পুরুলিয়ার দিকে এগোচ্ছিল, তখন আগস্টের ভিজে বাতাসে গায়ে লাগছিল শালপাতার গন্ধ। কলকাতার ভিড় ঠেলে, চাকরির ক্লান্তি থেকে মুক্তির খোঁজে এই জায়গায় আসা যেন তার বহুদিনের স্বপ্ন। ছুটি পেয়েছে মাত্র দু’সপ্তাহ, কিন্তু সেই সামান্য সময়ের ভেতরেই সে খুঁজে পেতে চায় এক অন্য জগৎ—যেখানে মোবাইল টাওয়ারের থেকে উঁচু হয় না কোনো গাছ, যেখানে শহরের ধোঁয়া ঢেকে রাখে না আকাশের রঙ। বাসটার জানালা দিয়ে তাকিয়ে সে দেখে ধানক্ষেতের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে লালচে-খয়েরি মাটির ঢিবি, দূরে ঝাপসা পাহাড়। মাঝেমাঝে গরুর গাড়ি রাস্তা পার হচ্ছে, আবার কোনো কোনো মোড়ে ঢোলের…
-
পিউ রায় এক অভীক যখন শহরের ব্যস্ত রাস্তা, ক্লান্ত করা যানজট এবং কংক্রিটের পাহাড় ছেড়ে গ্রামে প্রবেশ করে, তখন তার মন যেন এক নতুন পৃথিবীর দিকে উন্মুক্ত হয়ে যায়। গাড়ির জানালা দিয়ে যে সব সবুজ মাঠ, বিস্তীর্ণ খামার, এবং ধীরে ধীরে পাহাড়ের পটভূমিতে ছড়িয়ে থাকা পুরনো খামারবাড়ি দেখা যাচ্ছিল, তা যেন শহরের ব্যস্ততা এবং ধোঁয়াশাকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলিয়ে দেয়। গাড়ি যখন ধীরে ধীরে কাঁচা পথের দিকে প্রবেশ করে, অভীক দেখতে পায় কাদা জমির উপর বৃষ্টির জল ঢেউ খেলাচ্ছে, আর পাখির ডাক পরিবেশকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলছে। শহরের কাচ-লোহা আর কংক্রিটের গন্ধ যেন একেবারে বাতাসে মিলিয়ে গেছে, কিন্তু গ্রামে প্রবেশের…
-
পৌলমী বসু এক সকালের প্রথম আলোয় যখন ঘুম ভাঙে, তখন থেকেই সোমার দিন শুরু হয় দায়িত্বের দীর্ঘ তালিকা নিয়ে। রান্নাঘরে চায়ের কেটলি চড়ানো, টিফিনের বাক্স সাজানো, মৌয়ের স্কুলব্যাগ গুছিয়ে দেওয়া, কাপড় কাচা—সবই যেন একটা অভ্যাসের অংশ। কিন্তু এই অভ্যাসের ভেতরে কোথাও এক অদৃশ্য শূন্যতা দিন দিন গভীর হচ্ছে। জানলার ফাঁক দিয়ে আসা আলো তার চোখে পড়ে, কিন্তু সেই আলো তাকে আনন্দ দেয় না। বরং মনে হয়—এই আলোও যেন কেবল আরেকটা রুটিনকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। রান্নাঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে সোমা যখন নুন-মশলার অনুপাতে তরকারি কষে, তখন তার ভেতরে ভেসে ওঠে প্রশ্ন—এটাই কি তবে তার জীবন? রান্নাঘরের কড়া গন্ধ, চায়ের ফুটন্ত বুদবুদ, কিংবা…
-
ঋদ্ধিমান গুহ ১ বেঙ্গালুরুর ব্যস্ততার ভিড়ে অদ্বৈতের দিন শুরু হয় একঘেয়ে অফিসের কাজ দিয়ে, শেষ হয় আবার সেই অফিসেই জমে থাকা ফাইলের পাহাড়ে ডুবে থেকে। কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ রেখে রাত কেটে যায়, কফির কাপে ভর করে শরীর চালায়, কিন্তু ভেতরের শূন্যতাকে কিছুতেই পূর্ণ করতে পারে না। উত্তর কলকাতার ছেলেটি ছোটবেলা থেকে কখনো ভাবেনি—শহরের এত দূরে একা পড়ে থাকবে। কাজের চাপ, নতুন জায়গার অনিশ্চয়তা, আর নিঃসঙ্গতা মিলে তাকে ধীরে ধীরে ক্লান্ত করে তোলে। তবু প্রতিদিন রাত নামলেই একটুখানি আলো জ্বলে ওঠে—সোহিনীর কল। ফোনের পর্দায় ভেসে ওঠা তার মুখই যেন অদ্বৈতের দিনের সমস্ত ক্লান্তি মুছে দেয়। কিন্তু এই দেখা শুধুই কাঁচের দেয়ালে…
-
পৌলমী বসাক অধ্যায় ১ : ট্রেনের জানালা দিয়ে ধেয়ে যাওয়া দৃশ্য যেন অর্ণব আর ঈশিতার চোখে এক নতুন পৃথিবীর চিত্র আঁকছিল। কলকাতার কোলাহল পেরিয়ে ট্রেন যত ভেতরের দিকে এগোচ্ছিল, ততই বাড়ছিল সবুজের প্রলেপ, ঝকঝকে মাঠ আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছের সারি। সাদা মেঘে ছাওয়া আকাশের নিচে এই ভ্রমণ যেন তাদের জন্য এক মুক্তির নিশ্বাস। কলেজে গত কয়েক মাস ধরে পরীক্ষা, প্রোজেক্ট আর শহরের চাপে তারা দু’জনেই যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই গ্রামে ছুটি কাটাতে যাওয়ার এই পরিকল্পনা, যেটা প্রথমে হালকা মজার প্রস্তাব ছিল, এখন এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাসে ভরে উঠেছে। ট্রেনের সীট ভাগাভাগি করে বসে অর্ণব আর ঈশিতা একে অপরের দিকে…
-
অনিন্দিতা রায় পর্ব ১ — ট্রেনের জানালা শিয়ালদহ স্টেশন গমগম করছে মানুষের চিৎকারে, বোঝাই ট্রেনের হুইসেলে আর উদ্বাস্তুদের কান্নায়। আগস্টের আর্দ্র গরমে ছাপোষা মানুষের ভিড় যেন এক বিশাল ঢেউ হয়ে উঠেছে, যাদের কোনো ঠিকানা নেই, আছে শুধু ছিন্ন দেহের মতো ভেঙে যাওয়া স্মৃতি। অঞ্জলি দাঁড়িয়ে আছে ভাই হরিদাসকে পাশে নিয়ে, হাতের মুঠোয় একটা ভাঁজ করা চিঠি। সেই চিঠি খুলনা থেকে সঙ্গে এনেছে, অন্য কিছু আনতে পারেনি। ট্রাঙ্কে আছে সামান্য কাপড় আর কয়েকটা হাঁড়ি-পাতিল, কিন্তু বুকের ভেতর যেটা নিয়ে এসেছে সেটা অদৃশ্য—শিকড় ছেঁড়া এক গ্রামের ঘ্রাণ, উঠোনে ঝরা শিমুলফুল, আর রহিমার মুখ। চারপাশে রেললাইনের শব্দে ভরে উঠলেও অঞ্জলি শুনতে পাচ্ছে কেবল…
-
মৌমিতা রায় এক ড. অরিন্দম মুখার্জি ছিলেন কলকাতার এক প্রখ্যাত রোবোটিক্স বিজ্ঞানী। বয়স তাঁর মাঝ চল্লিশে হলেও, জীবনের সবটুকু সময় তিনি ল্যাবরেটরির দেয়াল আর অসংখ্য তার, সার্কিট, স্ক্রিনের মধ্যে ডুবে কাটিয়েছেন। বন্ধু-বান্ধব, সাহিত্য, সঙ্গীত—এসব থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন তিনি। যুক্তির খোলস আর যান্ত্রিক অনুশাসনের ভেতরেই তাঁর জীবন বন্দি হয়ে গিয়েছিল। ছোটবেলায় কবিতা লেখার একটা শখ ছিল ঠিকই, কিন্তু বিজ্ঞানের টানে তিনি চলে আসেন যন্ত্রের দুনিয়ায়। বছরের পর বছর ধরে তিনি এক অদ্ভুত স্বপ্ন লালন করেছেন—একটা এমন রোবট তৈরি করবেন, যে মানুষের মতো লিখতে পারবে, শুধু সাধারণ ভাষা নয়, শিল্পের ভাষা। কবিতা। তিনি ভেবেছিলেন, যদি যন্ত্রও মানুষের মতো সাহিত্য রচনা…