সৌরদীপ মুখোপাধ্যায় পর্ব ১ : অশুভ নিমন্ত্রণ কলকাতার শীতের শুরু। সন্ধ্যা নামতেই শহর জেগে উঠছে দীপাবলির আলোয়, আর দক্ষিণ কলকাতার পুরোনো বনেদি পাড়ায় লাহিড়ীবাড়ির কালীপুজোকে ঘিরে চারদিকে হৈচৈ। লাহিড়ীবাড়ির পুজো শুধু দেবতার কাছে ভক্তি নিবেদন নয়, বরং পাড়ার এক সামাজিক উৎসব, যেখানে কয়েক প্রজন্ম ধরে জড়ো হয় মানুষ। ঋদ্ধিমান মিত্র, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, লোকসংস্কৃতির ছাত্র। তাঁর কাছে এই নিমন্ত্রণ ছিল অদ্ভুত। লাহিড়ীবাড়ির এক তরুণী, অর্পিতা, হঠাৎ একদিন লাইব্রেরিতে এসে তাঁকে বলেছিল— “আমাদের বাড়ির পুজোয় এ বছর আপনাকে অবশ্যই আসতে হবে। হয়তো আপনার পড়াশোনার কাজে লাগবে।” ঋদ্ধিমান প্রথমে অবাক হলেও, ভেবেছিল এ হয়তো গবেষণার একটা সুযোগ। কিন্তু অর্পিতার চোখের ভেতর অদ্ভুত…
-
-
অদ্রীশ সেনগুপ্ত পর্ব ১ : পূর্ণিমার রাত পূর্ববঙ্গ থেকে ভেসে আসা লোককথার মতোই যেন গল্পটা শুরু হয়েছিল। নদীর ধার ঘেঁষে ছোট্ট গ্রাম—দেবীপুর। এই গ্রামে আজও অনেক পুরনো আচার চলে, আর আছে নানারকম অদ্ভুত গল্প, যেগুলো নিয়ে লোকেরা আড্ডা দেয় সন্ধেবেলা পুকুরঘাটে বা মাঠের আলপথে বসে। তবে সবচেয়ে বেশি ফিসফাস হয় যে কাহিনী নিয়ে, তা হলো চতুর্দোলার কনে। এই গ্রামে বছর পঁচিশ আগে একটা বিয়ে ভেস্তে যায়। কনে সীতারা—সাদা মুখশ্রী, টকটকে লাল শাড়ি পরা, চোখে ভয় আর লজ্জার ছায়া। হঠাৎই বিয়ের দিন অসুস্থ হয়ে পড়ে। অনেকের মতে সে বিষ খেয়েছিল। কিছুদিন পর মৃতদেহকে গ্রামের লোকেরা মন্দিরের পাশে এনে চার বাঁশে বাঁধা…
-
অপূর্ব ঘোষ অধ্যায় ১ – আগমন ভুবনেশ্বরের কোলাহল পেরিয়ে যখন গাড়ির চাকা ধুলো উড়িয়ে হিরাপুর গ্রামের সরু কাঁচা রাস্তায় ঢুকল, তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে রক্তিম আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। একদল প্রত্নতাত্ত্বিক, যাদের চোখে স্পষ্ট কৌতূহল ও উত্তেজনা, গাড়ি থেকে নেমে এল ধীরে ধীরে। দলের নেতৃত্বে ছিলেন ডক্টর অনিরুদ্ধ মুখার্জি, প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্য ও তান্ত্রিক মন্দির নিয়ে খ্যাত এক গবেষক। তার সঙ্গে ছিলেন সহকারী প্রফেসর সঞ্জনা সেন, যিনি সম্প্রতি পুরাণ ও লোকবিশ্বাস নিয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। এছাড়াও ছিলেন দুই তরুণ প্রত্নতত্ত্ববিদ—অভিজিৎ ও রোহন—যাদের উচ্ছ্বাস প্রায় বালকসুলভ। তারা এসেছেন বিখ্যাত চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরের রহস্য অনুধাবন করতে, যেটি শুধু শিল্পকলার নয়, আধ্যাত্মিক ও গুপ্ততান্ত্রিক…
-
সৌরভ বসু এক শহরের এক প্রান্তে, যেখানে আধুনিকতার কোলাহল ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যায় আর গলিপথের শেষে ঝোপঝাড়ে ঢাকা অন্ধকার ঘনিয়ে ওঠে, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে দত্তবাড়ি। এককালে প্রাচুর্য, ঐশ্বর্য আর গৌরবের প্রতীক ছিল এই প্রাসাদসদৃশ বাড়িটি, যার বিশাল খিলান, রঙচটা বারান্দা আর কাঠের দরজাগুলো একসময় শহরের মানুষকে বিস্ময়ে মুগ্ধ করত। কিন্তু এখন সময়ের সাথে সাথে যেন ইতিহাসও তাকে বিস্মৃত করেছে। কেউ আর কাছে আসে না, ধীরে ধীরে চারদিকের দেওয়ালে শেওলা জমেছে, ছাদ থেকে ইট খুলে পড়ে যায়, জানালার কাঁচ ভেঙে ঝুলে থাকে বাতাসে আর ভিতরের ঘরগুলো ধুলোয় ঢাকা অন্ধকারে ডুবে থাকে। মানুষ বলে—দত্তবাড়ি অভিশপ্ত, আর সেই অভিশাপের ছায়া পুরো বাড়িটার…
-
পল্লব সেনগুপ্ত ১ প্রতি বছর শরৎকালের সেই বিশেষ সকালটি যেন গ্রামটির বুকের ভেতর এক অদ্ভুত উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয়। রাতভর কুয়াশা আর শিশিরে ভিজে থাকা বাতাস যখন আস্তে আস্তে আলোয় গা ভিজিয়ে নেয়, তখনই শুরু হয় সেই সুর—চণ্ডীপাঠের গম্ভীর ও সুরেলা ধ্বনি। গ্রামটি খুব সাধারণ, মাটির ঘর, কাঁচা রাস্তা, পুকুর আর ধানখেত দিয়ে ঘেরা, অথচ প্রতি মহালয়ার ভোরে এই গ্রাম হয়ে ওঠে রহস্যময়। সূর্যের প্রথম কিরণ ওঠার আগেই দূর থেকে ভেসে আসে ধ্বনি, যেন দেবীর আহ্বান চলছে। যারা গ্রামে থাকে তারা সবাই জানে, এই সুর অন্য কোনো মাইক থেকে নয়, কিংবা মন্দির থেকেও নয়। এটা ভেসে আসে সেই পুরোনো, ভগ্নপ্রায় বাড়ি…
-
রৌনক গুহ প্রোটোটাইপের প্রথম নিশ্বাস কলেজ স্ট্রিটের ভাঙাচোরা গলির একদম শেষে যে বাড়িটা রাত হলে অকারণে আঁধার নামিয়ে দেয়, সেখানে আমার ল্যাব—একা হাতে বানানো, লৌহের ফ্রেমে টিকে থাকা, পুরনো অস্কিলোস্কোপের আলোয় ঝিকিমিকি করে যে স্বপ্নটা পায়ের নীচে বিছিয়ে রাখি আমি, নাম ইরফান মিত্র, পেশায় রোবোটিক্স গবেষক, কিন্তু পাড়ায় সবাই আমাকে পাগল ইঞ্জিনিয়ার বলে ডাকে, কারও তাতে কিছু আসে যায় না—কারণ আজ যে রাতে আমার হাতে প্রথম নিশ্বাস নেবে শ্যামাপ্রসাদ, এক মেশিন, কিন্তু মেশিনের ভেতর লুকোনো মানুষের মতো কোমল কিছু, যা আমি গত চার বছর ধরে হারিয়ে ফেলা ছেলের স্মৃতি থেকে চুরি করেছি; আরেকটু নিখুঁত হলে সে আঙুল উঁচিয়ে বলবে “বাবা”;…
-
সৌরদীপ মুখোপাধ্যায় পর্ব ১ – চাঁদের আড্ডা চাঁদের বুকে প্রথম সূর্যোদয় দেখা মানেই এক অদ্ভুত বিস্ময়। পৃথিবী থেকে তিরিশ লাখ কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এই মহল্লার প্রতিটি বাসিন্দার কাছে সেটাই যেন প্রতিদিন নতুন করে জন্ম নেওয়া। ২০৮০ সালের শারদীয় পূজোর আগের সপ্তাহে ভারতের প্রথম চন্দ্র-নিবাসে তৈরি হলো বাঙালি মহল্লা—যেখানে কাঁচের গম্বুজের নিচে রাস্তায় টং দোকান, মশলা-ভাজা টেলিভারি, বাঙালি দাদু-ঠাকুমাদের কণ্ঠে রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর সন্ধের আড্ডায় ফুটবল নিয়ে উত্তেজনা। কেউ বিশ্বাস করতে পারত না যে এমন দিন একদিন আসবে, কিন্তু বিজ্ঞান ও স্বপ্ন একসাথে পথ দেখিয়েছে। পৃথিবী থেকে হাজার হাজার মানুষ নানা কারণে চাঁদে এসেছে—খনন শিল্প, গবেষণা, পর্যটন, বসতি গড়ে তোলার…
-
অনিরুদ্ধ পাল পর্ব ১ : অচেনা খাম কলকাতার রাত তখনও ভিজে আছে বৃষ্টির রেশে। অগণিত গলিপথের আলো ঝাপসা হয়ে আছে টলোমলো কুয়াশার মতো বাষ্পে। উত্তর কলকাতার প্রাচীন গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভাঙাচোরা এক ডাকবাক্সে কে আর খাম ফেলে যায় আজকাল? লাল রঙ চটকে গেছে, গায়ে শ্যাওলা জমেছে, ছিদ্র দিয়ে ইঁদুর ঢোকে আর বেরোয়। বহু বছর ধরে অচল পড়ে থাকা সেই বাক্সটা হঠাৎই যেন আজ তাকে ডাকছিল। রুদ্র সেদিন রিপোর্টিং শেষে ফেরার পথে এক সিগারেট ধরাতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল বাক্সটার সামনে। চোখে পড়ে অদ্ভুত এক খাম—মোটা বাদামি কাগজে মোড়া, তার নামটা লেখা একেবারে কালো কালি দিয়ে স্পষ্ট অক্ষরে: “রুদ্র সেন”। বুকের…
-
দীপাংশু বোৰঠাকুৰ পৰ্ব ১: বৰষুণৰ ৰাতি আৰু অদ্ভুত কল শহৰখনৰ ওপৰত সেই ৰাতি আকাশখনৰ মেঘ গাঢ় হৈ নামি আহিছিল। পূৰ্ণ বতাহেৰে পৰা বৰষুণৰ শব্দে মানুহৰ মনত এক ধৰণৰ বিৰক্তি আৰু ভয় দুয়ো মিশ্ৰিত অনুভূতি জাগ্ৰত কৰিছিল। গুৱাহাটী শহৰৰ ভাৰেলি পাথাৰৰ এডাল বাটৰ কাষত থকা এটা পুৰণি দুমজিলা ঘৰখনত অৰুণ জোনাকত একো নাথাকিলেও আলোছায়াৰ খেলা চলিছিল। ঘৰখনত বাস কৰিছিল মণিশংকৰ বৰুৱা। গুৱাহাটীৰ এটা কলেজত ইতিহাসৰ অধ্যাপক। বয়সত পঞ্চাশ পাৰ হ’লেও তেওঁৰ কণ্ঠস্বৰ, দৃঢ় চাহনি আৰু কথা কোৱাৰ ভঙ্গীমাই মানুহৰ মনত এক ধৰণৰ ভৰসা জাগ্ৰত কৰিছিল। কিন্তু এই মানুহটোৰ জীৱনত বহুবছৰ ধৰি এটা অদ্ভুত শূন্যতা আছিল। পত্নী দীৰ্ঘদিন আগতেই মৃত্যুবৰণ কৰিছিল, পুতেক…
-
অর্ণব মুখার্জি পর্ব ১ — নতুন স্কুলশিক্ষক বর্ষার শেষে যে ভেজা গন্ধ মাটির ভেতর পর্যন্ত ঢুকে থাকে, সেই গন্ধ নিয়েই অরিন্দম প্রথম দিন গ্রামে পা রাখল। ছোট্ট স্টেশন, নামটি শিলালিপির মতো খসে পড়া বোর্ডে, প্ল্যাটফর্মে দু-একটা কেরোসিনের ল্যাম্প টিমটিম করছে, আর দূরে শালগাছের রেখা এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন কারও পুরোনো হাতের লেখা— থরথর করে, তবু পড়া যায়। কলকাতা থেকে ট্রেনে নামার পর একটা ভাঙা টেম্পো তাকে স্কুল পর্যন্ত পৌঁছে দিল। স্কুল বলতে ইট-সিমেন্টের দুটো দোচালা ঘর, সামনের মাঠে ঘাস বুনোভাবে উঠে এসেছে, তালগাছের ছায়া পড়ে লম্বা কালচে দাগ। প্রধান শিক্ষক ছুটিতে; সাময়িক দায়িত্বে থাকা ক্লার্কটি, নাম হারাধন, পাতলা গলার লোক,…