সোনালী গুপ্ত অধ্যায় ১ – নিখুঁত প্রারম্ভ রচনার জীবন শুরু হয়েছিল এক নিরবচ্ছিন্ন শান্তির আভায়, যা অনেক দিন ধরে সে অনুভব করছিল। সকালগুলো নরম আলোয় ভরে ওঠা রঙিন কফির গন্ধ এবং অরুণের সঙ্গে হালকা কথোপকথনের মধ্য দিয়ে শুরু হতো। শহরের মাঝারি আয়ের একটি বস্তিতে বসবাস করলেও তাঁদের জীবনযাত্রা সবসময়ই সরলতার মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজে পেত। রচনা এবং অরুণের সম্পর্ক দেখলে মনে হতো, তাঁদের সুখী দাম্পত্য জীবন যেন এক নিখুঁত ছায়া যা কখনও ফাটে না। রান্নাঘরে অরুণের হাসি, রচনার চোখে তার মৃদু দৃষ্টি, ছোট্ট বিকেলের খোলা জানালার বাইরে পাখির ডাক—সবকিছুই যেন এক নিরবসঙ্গীতের মতো। তবে, রচনার মন কিছুটা অশান্ত থাকত এমন সময়গুলোতে।…
- 
				
 - 
				
অরিত্র সেনগুপ্ত প্রথম পর্ব: ভাঙা মন্দিরের ছায়া কলকাতার গরম দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো গ্রন্থাগারে বসে ঋদ্ধি মুখোপাধ্যায় ধুলোমাখা এক দলিল উল্টেপাল্টে দেখছিল। দলিলটা এসেছে এক ব্রিটিশ কালেক্টরের আর্কাইভ থেকে—মলিন, ফ্যাকাশে কাগজে অদ্ভুত সব আঁকিবুঁকি। প্রথমে ওগুলো অর্থহীন দাগ মনে হলেও, চোখ অভ্যস্ত হতে না হতেই ঋদ্ধি দেখল ম্লান লাল কালি দিয়ে আঁকা একটা মানচিত্র। নদী, গাছপালা, আর মাঝখানে লেখা কয়েকটি সংস্কৃত শব্দ—“যত সূর্যের ছায়া, তত রাজাধন।” ঋদ্ধির বুকের ভেতর ঝড় উঠল। এ শুধু কোনো দলিল নয়—এ যেন ইতিহাসের অমূল্য দরজা খুলে দেওয়ার চাবি। কর্ণসুবর্ণ—গৌড়ের সেই প্রাচীন রাজধানী যেখানে শশাঙ্কদেব একসময় রাজত্ব করেছিলেন, সেখানকার ধনের ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে মানচিত্রে। ঠিক তখনই গ্রন্থাগারের…
 - 
				
সৌরদীপ ব্যানার্জী পর্ব ১ : থেমে যাওয়া সময় কলকাতার গ্রীষ্ম সন্ধ্যা। শহরের ব্যস্ততা তখনও ফুরোয়নি। কিন্তু শান্তিনিকেতন লেনের পুরনো তিনতলা বাড়িটা যেন অন্য জগতের মতো নিঃশব্দ। চারপাশে কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ, আর ভেতরে জমে উঠছে অস্বস্তিকর হাহাকার। সেই বাড়ির দোতলার পড়ার ঘরে নিথর হয়ে পড়ে আছেন অধ্যাপক অনিরুদ্ধ মুখার্জী—শহরের খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ। তাঁর শরীরটা একপাশে হেলে পড়ে আছে, টেবিলের ওপরে কাগজপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। মাথার কাছে পড়ে আছে একটি হাতঘড়ি—কাঁচ ভাঙা, কাঁটা থেমে আছে রাত ২টা ১৭ মিনিটে। পুলিশ আসে, চারদিক ঘিরে ফেলে। দারোয়ান অশোক ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জানায়— “সার, আমি তো বিকেল সাড়ে চারটের সময় ভেতরে ঢুকে লাশ দেখি। দরজা ভেতর থেকে…
 - 
				
সায়ন্তনী রায় কলকাতার গরম দুপুর। বহুতল অফিসের কাচঘেরা ঘরে এয়ারকন্ডিশনারের ঠান্ডা হাওয়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু ঋতিকা যেন ভেতরে ভেতরে গলতে থাকল। দিনভর প্রেজেন্টেশন আর রিপোর্টের ভিড়ে মাথা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল তার। ডেস্কে বসে থেকে জানালার বাইরে তাকিয়ে যতবার চোখ গেছে, ততবার মনে হয়েছে শহরটা যেন এক অবিরাম দৌড়ের ভিতর আটকে আছে। মানুষ ছুটছে, গাড়ি ছুটছে, আলো ছুটছে—শুধু তার ভেতরটায় থমকে আছে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। সেদিন অফিস থেকে বেরোতেই বৃষ্টি নামল হঠাৎ। একেবারে ঝমঝমে বর্ষণ। ছাতা ছিল না সঙ্গে, ফলে বারান্দার শেডের নিচে দাঁড়িয়ে সে ফোন বের করে ট্যাক্সি বুক করতে চাইলো। তখনই চোখে পড়ল এক চেনা মুখ—অভিষেক। বহুদিন আগের পরিচিত,…
 - 
				
অন্তরা মান্না অধ্যায় ১ – মায়ার জীবন, বাইরের চোখে, এক নিখুঁত শান্তির গল্পের মতো মনে হয়। সকালে উঠে রিয়াদের সঙ্গে চায়ের কাপ ভাগ করে নেওয়া, রাস্তার ধারের ছোট্ট ফুলের দোকান থেকে রঙিন ফুল আনা, এবং বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে হালকা আড্ডা—সবকিছু যেন একটি সুন্দর ছন্দে বাঁধা। মায়া মনে করত, এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই তার জীবনের আসল সম্পদ। রিয়াদের হাসি, তার কোমল স্পর্শ, এমনকি তার ক্ষুদ্র অভ্যাসগুলোও—যেমন বইয়ের পাতায় আঙুল রেখে পড়া, কফি খাওয়ার ধরণ—সবই মায়ার মনে একধরনের উষ্ণতা সৃষ্টি করত। তারা দুজনেই একে অপরের মেলবন্ধনে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিল, এমনকি দিনের শেষে নিঃশব্দে একে অপরের হাত ধরার অভ্যাসও মায়াকে অদ্ভুত সান্ত্বনা দিত।…
 - 
				
অভিজিৎ মল্লিক পর্ব ১: লাল মাটির পথে লাল মাটির রাস্তা ধরে যখন ইরা প্রথমবারের মতো পুরুলিয়ার দিকে এগোচ্ছিল, তখন আগস্টের ভিজে বাতাসে গায়ে লাগছিল শালপাতার গন্ধ। কলকাতার ভিড় ঠেলে, চাকরির ক্লান্তি থেকে মুক্তির খোঁজে এই জায়গায় আসা যেন তার বহুদিনের স্বপ্ন। ছুটি পেয়েছে মাত্র দু’সপ্তাহ, কিন্তু সেই সামান্য সময়ের ভেতরেই সে খুঁজে পেতে চায় এক অন্য জগৎ—যেখানে মোবাইল টাওয়ারের থেকে উঁচু হয় না কোনো গাছ, যেখানে শহরের ধোঁয়া ঢেকে রাখে না আকাশের রঙ। বাসটার জানালা দিয়ে তাকিয়ে সে দেখে ধানক্ষেতের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে লালচে-খয়েরি মাটির ঢিবি, দূরে ঝাপসা পাহাড়। মাঝেমাঝে গরুর গাড়ি রাস্তা পার হচ্ছে, আবার কোনো কোনো মোড়ে ঢোলের…
 - 
				
দেবমাল্য গুপ্ত ভোরবেলা গঙ্গার ঘাট সবসময়ই যেন অদ্ভুতভাবে রহস্যময় হয়ে ওঠে। শীতল হাওয়া জলের গায়ে তরঙ্গ তুলে দিচ্ছিল, দূরে পুরোনো মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছিল কুয়াশার আড়ালে, আর ঘাটে কিছু ভোরের সাধক গঙ্গাস্নানে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু সেই নিরিবিলি সকালে হঠাৎই এক চিৎকার ভেদ করে গেল চারপাশের নীরবতা। একজন মাঝি প্রথমে জলে ভাসতে থাকা অচেনা দেহটি দেখতে পায় এবং দৌড়ে লোক ডাকতে শুরু করে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই গঙ্গার ঘাটে ভিড় জমে যায়। সবাই শিউরে উঠল, কারণ দেহটি একেবারে অচেনা কারো নয়—চেনা শহরেরই একজন, ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ লাহিড়ী। মানুষটি গতকাল রাত পর্যন্ত শহরে দোকানে বসেছিলেন, এমনকি অনেকেই তাকে দেখেছে স্থানীয় ক্লাবে। অথচ আজ সকালে…
 - 
				
অর্ণব দাশগুপ্ত পর্ব ১: লাল সূচকের সকাল শেয়ার বাজারের দালালদের জীবনকে বাইরের লোকেরা চকচকে ভেবে নেয়। যেন প্রতিদিনই টাকার বৃষ্টি হয়, প্রতিটি ডাকে লেনদেনের ঝলমলে খেলা। কিন্তু ভেতরে যারা থাকে, তারা জানে আসলে কেমন চাপ, কেমন দমবন্ধ করা দৌড়, আর কেমন গোপন ভয়ের সঙ্গে প্রতিদিনের হিসাব মেলাতে হয়। সৌমিক চৌধুরী সেই ভেতরের মানুষ। সবার কাছে সে “সৌমিক দা”—কলকাতার ডালহৌসির এক পুরোনো শেয়ার ব্রোকারেজ অফিসের নির্ভরযোগ্য দালাল। তার হাতে ক্লায়েন্টরা তাদের সঞ্চয় তুলে দেয়, তাদের স্বপ্ন, তাদের ভরসা। আজকের সকালটা শুরু হয়েছিল আশ্চর্যভাবে ভারী এক নীরবতায়। টিভির স্ক্রিনে তখনও বাজার খোলেনি, কিন্তু সূচকের আগে-পরে ছুটে চলা লাল আর সবুজ রেখাগুলো যেন…
 - 
				
অর্জুন ধর দ্য কল ব্যাক দিল্লির পুরোনো চাঁদনি চকের গলির ভেতরে এক ছোট্ট বইয়ের দোকান। নাম স্মৃতির আড্ডা। কাঠের তাকজোড়া ভরে আছে পুরোনো গোয়েন্দা উপন্যাস, ইংরেজি ক্লাসিক, বাংলার কবিতার বই। দোকানের মালিক অর্ণব সেন—চল্লিশ ছুঁইছুঁই, চশমা পরা, গম্ভীর মুখের মানুষ। তার বুকশপে দুপুরগুলো শান্ত, শুধু পাখির ডাক আর বাইরের যানজটের আওয়াজ ভেসে আসে। কেউ তাকে চিনে না, কেউ জানে না, এই নিরীহ বই বিক্রেতা একসময় ভারতের সবচেয়ে তীক্ষ্ণ গুপ্তচর ছিল। অর্ণবের দিনগুলো কাটছিল সহজেই—সকালে দোকান খোলা, দুপুরে ক’জন ছাত্রছাত্রী আসে নোটস খুঁজতে, সন্ধ্যায় তিনি একা বসে থাকেন। কিন্তু এই শান্তজীবন হঠাৎই ভেঙে দিল এক পুরনো ফোনকল। রাত তখন সাড়ে দশটা।…
 - 
				
সায়ন্তনী ধর পর্ব ১: অচেনা স্পর্শ কলকাতার ভিজে সন্ধ্যে। বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে ফ্ল্যাটের বারান্দা যেন একা বসে আছে। রিমঝিম ভেজা আলোয় স্নিগ্ধা দাঁড়িয়ে, হাতে এক কাপ কফি। তিরিশ পেরোনো এই নারী, সংসার আর অফিসের একঘেয়েমি পেরিয়ে আজ হঠাৎ যেন নিজের ভেতরেই অস্থিরতা টের পাচ্ছে। বিয়ের আট বছরের সম্পর্ক—অর্ণব, তার স্বামী, এখন প্রায় যন্ত্রের মতো। অফিস থেকে ফিরে শুধু ক্লান্ত শরীর আর একবিন্দু নিরুত্তাপ আলাপ। শারীরিক সম্পর্কও বহুদিন হয়ে উঠেছে দায়িত্বের মতো—যেন টিক চিহ্ন দিয়ে শেষ হওয়া কর্তব্য। স্নিগ্ধা আয়নায় তাকায়। চোখের নিচে হালকা কালি, ঠোঁটে এক চাপা অভিমান। অথচ শরীর তার এখনো মায়াবী, নরম চামড়ার নিচে লুকোনো এক অদম্য কামনা…