আকাশ ধর ১ গ্রীষ্মের বিকেল তখন ধীরে ধীরে সন্ধ্যার দিকে গড়াচ্ছে। গ্রামের প্রান্তের ফাঁকা মাঠ আর অর্ধেক শুকিয়ে যাওয়া পুকুরের ধারে ছড়িয়ে থাকা বাতাসে ধুলো উড়ছে। অরিন, ষোল বছরের কিশোর, একা একাই হাঁটছিল। পড়াশোনায় মাঝারি মানের হলেও তার মন ছিল অন্য জগতে—আকাশে। প্রায়ই সে চুপচাপ মাঠে বসে তারাগুলো গুনত, কল্পনা করত ওপারে কী আছে। সেইদিনও সে একই অভ্যাসে মাঠের কিনারায় চলে গিয়েছিল, কিন্তু হঠাৎই তার চোখে পড়ে গেল একটি অদ্ভুত দৃশ্য। ঝড়ে ভেঙে পড়া একটি পুরোনো বটগাছের শেকড়ের নিচে কিছু যেন জ্বলজ্বল করছে। দূর থেকে প্রথমে মনে হলো হয়তো কাচের টুকরো, সূর্যের আলোয় ঝিলমিল করছে। কিন্তু কাছে যেতেই অরিন দেখল,…
-
-
দেবজিত ঘোষ এক অর্ণবের ঘুম ভাঙল ভোরবেলার প্রথম আলোয় নয়, বরং এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে। সাধারণত জানলার বাইরের ট্রামের টুংটাং শব্দ, কিংবা রাস্তার ভাঁপাও বিক্রেতার হাঁক তাকে জাগিয়ে তোলে। কিন্তু আজ যেন চারদিকে সম্পূর্ণ নীরবতা। এত নীরবতা কলকাতায় কোনোদিন শোনা যায়নি। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতেই মনে হলো যেন বাতাস ভারী হয়ে আছে, যেন প্রতিটি শ্বাস নিতে তাকে দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হচ্ছে। ঘরটাও কেমন অচেনা মনে হলো—একই বইয়ের তাক, একই ডেস্ক, তবুও যেন সবকিছু নতুনভাবে সাজানো। জানলার বাইরে তাকিয়ে অর্ণব স্তব্ধ হয়ে গেল। যেখানে প্রতিদিন অগোছালো গলি, চায়ের দোকান, ভিখারির ভিড়, সেখানে আজ দেখা যাচ্ছে অদ্ভুত খালি রাস্তা। কোনো মানুষ নেই, কোনো…
-
প্ৰদীপ্ত মজুমদার অর্ণব সেনের জীবনে সেই মুহূর্তটা ছিল এমন এক অভিজ্ঞতা, যা তাঁর সমস্ত শৈশবের স্বপ্ন, যুবক বয়সের ত্যাগ আর মহাকাশযাত্রার অগণিত প্রশিক্ষণকে এক অবর্ণনীয় বাস্তবতায় রূপ দিল। পৃথিবী থেকে কোটি কোটি কিলোমিটার দূরে, অগণিত মানুষের চোখের বাইরে তিনি প্রথমবারের মতো মঙ্গলের মাটিতে পা রাখলেন। চারপাশে বিস্তীর্ণ লাল মরুভূমি, যার সীমা যেন দিগন্তকে ছুঁয়ে গিয়ে মিলিয়ে গেছে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতায়। মহাশূন্য থেকে মঙ্গলকে যতটা নিঃসাড়, নির্জীব মনে হয়েছিল, মাটিতে নেমে সেই অনুভূতি আরও গভীরভাবে আছড়ে পড়ল তাঁর ভেতরে। পাথুরে গিরিখাতের অন্ধকার গলিপথ, সূর্যের ক্ষীণ আলোয় ঝলমল করা ধূলিকণা আর নিঃশ্বাসরুদ্ধ করা স্তব্ধতা তাঁকে মুহূর্তেই বোঝাল—এ পৃথিবীর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক…
-
অতনু রক্ষিত এক ভোরবেলা পৃথিবীকে ঘিরে যে আলো জন্ম নিত প্রতিদিন, সেই আলো যেন আচমকা হারিয়ে গেল। সময়টা ছিলো একেবারেই স্বাভাবিক—পাখিদের ডাক, মানুষের জেগে ওঠা, শিশুরা স্কুলের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, আর কর্মজীবীরা যেমনভাবে প্রতিদিন ব্যস্ততার জন্য প্রস্তুত হয়, সেই ছন্দেই চলছিল সবকিছু। কিন্তু ঠিক সূর্য ওঠার মুহূর্তে আকাশ যেন গভীর অন্ধকারে ডুবে গেল। প্রথমে মানুষ ভেবেছিল এটি হয়তো মেঘ বা ঝড়ের প্রভাব, কিন্তু যত মিনিট গড়াল ততই বোঝা গেল, এটা কোনো প্রাকৃতিক আবহাওয়ার পরিবর্তন নয়। আকাশে সূর্যের অস্তিত্ব নেই—আলোহীন পৃথিবী হঠাৎ যেন অজানা মহাশূন্যে ভেসে গেছে। শহরের ভিড়, গ্রামের খোলা মাঠ, সমুদ্রতট—সব জায়গায় একইসঙ্গে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ চোখ মেলে তাকাল…
-
মৌমিতা রায় এক ড. অরিন্দম মুখার্জি ছিলেন কলকাতার এক প্রখ্যাত রোবোটিক্স বিজ্ঞানী। বয়স তাঁর মাঝ চল্লিশে হলেও, জীবনের সবটুকু সময় তিনি ল্যাবরেটরির দেয়াল আর অসংখ্য তার, সার্কিট, স্ক্রিনের মধ্যে ডুবে কাটিয়েছেন। বন্ধু-বান্ধব, সাহিত্য, সঙ্গীত—এসব থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন তিনি। যুক্তির খোলস আর যান্ত্রিক অনুশাসনের ভেতরেই তাঁর জীবন বন্দি হয়ে গিয়েছিল। ছোটবেলায় কবিতা লেখার একটা শখ ছিল ঠিকই, কিন্তু বিজ্ঞানের টানে তিনি চলে আসেন যন্ত্রের দুনিয়ায়। বছরের পর বছর ধরে তিনি এক অদ্ভুত স্বপ্ন লালন করেছেন—একটা এমন রোবট তৈরি করবেন, যে মানুষের মতো লিখতে পারবে, শুধু সাধারণ ভাষা নয়, শিল্পের ভাষা। কবিতা। তিনি ভেবেছিলেন, যদি যন্ত্রও মানুষের মতো সাহিত্য রচনা…
-
দেবপ্রতিম সাহা কুহেলি দত্তের প্রতিদিনের কাজ ছিল একঘেয়ে অথচ ভীষণ মনোযোগের—স্যাটেলাইট ডেটার অগণিত ছবি বিশ্লেষণ করা। দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গল অঞ্চলের মানচিত্র সে তৈরি করছিল তার গবেষণার জন্য, বিষয় ছিল ভূ-পরিবেশ পরিবর্তনের প্রভাব। দিনের পর দিন চোখের সামনে আসছিল নদীর প্রবাহ বদলানো, বনাঞ্চলের সবুজ কমে যাওয়া কিংবা গ্রামের বিস্তার। কিন্তু সেদিন রাতের স্যাটেলাইট ছবিতে তার চোখ হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। ঝাপসা একখণ্ড ফ্রেমে সে দেখতে পেল অদ্ভুত জ্যামিতিক রেখা—আয়তক্ষেত্র, অর্ধবৃত্ত আর সোজা প্রাচীরের মতো দাগ একসঙ্গে মিলেমিশে আছে। এগুলো প্রকৃতির তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু মানচিত্রে সে জায়গায় কোনো গ্রাম নেই, কোনো জনবসতি নেই, এমনকি সরকারি রেকর্ডেও নেই কোনো নির্মাণ। সে প্রথমে…
-
ঋষভ সরকার এক ২০৭৫ সালের কলকাতা তখন একেবারে নতুন রূপে দাঁড়িয়ে আছে। গঙ্গার তীর ঘেঁষে উঁচু উঁচু টাওয়ার, আকাশপথে নীরব ভেসে চলা ম্যাগনেটিক ট্রেন, আর রাস্তায় স্বয়ংচালিত যানবাহনের মৃদু গুঞ্জন মিলে শহরকে দিয়েছে ভবিষ্যতের স্বাদ। রাস্তার দুই পাশে আলোকিত বিলবোর্ডে ভেসে আসে হোলোগ্রাফিক বিজ্ঞাপন—কখনও তাজা ফল বিক্রি করছে, কখনও পুরনো বাংলা সিনেমার ডিজিটাল রিমাস্টার রিলিজের ঘোষণা দিচ্ছে। শহরের উপর আকাশে ভেসে থাকে আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের কৃত্রিম মেঘ, যা নির্দিষ্ট এলাকায় বৃষ্টি নামিয়ে দেয়, আবার কোথাও রোদ ঝলমল রাখে। এই ব্যস্ত শহরের এক কোণে, গঙ্গার ধারের পুরনো পোস্ট অফিসের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ঝকঝকে, সাদা-নীল কাঁচের “টাইম-পোস্ট সেন্ট্রাল হাব”—যেখানে কাজ করে অরুণেশ সেন,…
-
শুভ্রজিত ঘোষাল অধ্যায় ১ – সূর্যের ডাক ২১শ শতকের শেষ দিকে, পৃথিবীর মহাকাশ পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে, যেখানে সূর্যের ক্ষুদ্রতম পরিবর্তনও শনাক্ত করা সম্ভব। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের (ISRC) কলকাতা শাখায় সেই রাতে সবকিছুই ছিল স্বাভাবিক। রাত দুইটা পেরিয়ে গেছে, পর্যবেক্ষণ ঘরে শুধুই যন্ত্রের মৃদু শব্দ, আর কম্পিউটার স্ক্রিনে অনবরত ভেসে আসা ডেটা। হঠাৎ, স্যাটেলাইট “সৌরবিকাশ–৭” থেকে আসা লাইভ ফিডে দেখা গেল এক অদ্ভুত সিগন্যাল—তীব্র তাপের সমুদ্রের মাঝে যেন একটি স্থির, ঠান্ডা বিন্দু। ডিউটি অফিসার প্রথমে ভাবলেন, হয়তো সেন্সর ত্রুটি। কিন্তু চেক করার পর দেখা গেল, সব সিস্টেম ঠিকঠাক কাজ করছে। সঙ্গে সঙ্গেই খবর পাঠানো হল ড. সৌম্যদীপ…