জয় মুখার্জী এক কলেজ লাইব্রেরি সেই দিনের বিকেলে প্রায় ফাঁকাই ছিল। জানালার ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকে কাঠের টেবিলগুলোর উপর লম্বা ছায়া ফেলছিল, পুরনো বইয়ের গন্ধে ভরপুর ঘরে শুধু ঘড়ির টিকটিক শব্দ আর কয়েকজন ছাত্রের ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছিল। অরিন্দম সেন, ইতিহাসের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, খুঁজছিল উপনিবেশিক কলকাতার সমাজ নিয়ে কিছু গবেষণার বই। সে লাইব্রেরির প্রায় অচল একটি সেকশনে ঢুকে পড়েছিল, যেখানে ধুলো জমে থাকা পুরনো বইয়ের সারি বছরের পর বছর কেউ ছুঁয়েও দেখেনি। তার হাত হঠাৎ এক মোটা, ছেঁড়া মলাটের বইতে আটকে যায়। বইটি খুলতেই খসখস করে কয়েকটি আলগা কাগজ নিচে পড়ে গেল। অরিন্দম অবাক হয়ে দেখল, ওগুলো আসলে কোনো ডায়েরির…
-
-
সুবর্ণ সাহা অধ্যায় ১ সুন্দরবনের যাত্রা শুরু করার আগেই অনিরুদ্ধের মনে ছিল এক ধরনের রোমাঞ্চ মিশ্রিত ভয়। কলকাতার কোলাহল থেকে হঠাৎ করে এই জঙ্গলের বুক চিরে গড়ে ওঠা দ্বীপজীবনে পা রাখা, নিঃসন্দেহে তার কাছে ছিল এক বিরল অভিজ্ঞতা। অনিরুদ্ধ একজন সাংবাদিক; পরিবেশ ও সমাজ নিয়ে কাজ করতে করতে তিনি দেশের নানা প্রান্তে ঘুরেছেন, কিন্তু সুন্দরবনের মত প্রকৃতির রহস্যময়তা আর কোথাও তিনি পাননি। কলকাতা থেকে লঞ্চে নদীপথ পেরিয়ে এসে পৌঁছোনোর পর তার চোখে প্রথম যে দৃশ্য ধরা দিয়েছিল, তা একেবারেই অনন্য—ঘন জঙ্গল, বাঁকানো নদী, নোনা বাতাসে ভাসা লবণাক্ত গন্ধ আর গ্রামের সাধারণ মানুষের হাসিমাখা মুখ। দ্বীপের মানুষজন অনেকটা নিরুপদ্রব, কিন্তু তাদের…
-
রজত চক্রবর্তী ১ কলকাতার উত্তর প্রান্তের একটি পুরনো অলিগলি দিয়ে হেঁটে হেঁটে অধ্যাপক ঋণুতোষ সেন বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁর চশমার কাচে কুয়াশার মতো জমে ছিল ধুলো, আর জামার পকেটে গুঁজে রাখা ছিল কয়েকটি পুরনো বই—তার মধ্যে একটিতে পাতার মাঝখানে শুকিয়ে যাওয়া পাতাবাহার ফুল। বছর পঞ্চান্নর ঋণুতোষ এখন সিটি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, যিনি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন এবং এখনও প্রতিটি শব্দকে প্রাণের মতো ভালোবাসেন। স্ত্রী শ্রেয়শীর মৃত্যু তাকে আরও নিঃসঙ্গ করে তুলেছে। একটা সময় ছিল, যখন তারা মিলে কবিতার বই পড়তেন, সন্ধ্যাবেলায় কোলাহলময় শহরের মাঝখানে এক কাপ লেবু চা নিয়ে আলোচনায় মশগুল থাকতেন, আর এখন? এখন তার একমাত্র সঙ্গী—এক ভাঙা রেডিও আর ধুলো…
-
নিলয় মিত্র অধ্যায় ১ সাহিত্যিক সৌম্য মিত্রের নিথর দেহটি পড়েছিল তার উত্তর কলকাতার দোতলা বাড়ির লেখার ঘরে, জানালার পর্দা অর্ধেক সরানো, বাইরের ঝিরঝিরে বৃষ্টির আলো গালচে করে রেখেছে কাঁচের ওপর। ছোট একটি কাঠের টেবিলে ছড়িয়ে থাকা কাগজগুলো ছিল সযত্নে বাঁধা একটি পাণ্ডুলিপি, নামহীন, কেবল প্রতিটি পাতার নিচে লাল কালি দিয়ে স্পষ্টভাবে লেখা — “এটা আমার লেখা নয়।” তার ডান হাতে শক্ত করে ধরা একটি পার্কার কলম, পাশে পড়ে থাকা আধখোলা পেন্সিল বক্স, আর ঘরের কোণে নিঃশব্দে জ্বলছিল একটি কুয়াশামাখা টেবিল ল্যাম্প। পুলিশের প্রাথমিক রিপোর্ট বলেছে—আত্মহত্যা। ঘুমের বড়ি ও হুইস্কির সম্মিলিত প্রভাবে মৃত্যু হয়েছে সম্ভবত রাত আড়াইটার সময়। কিন্তু বাড়ির কাজের…
-
নীলাদ্রি দে এক হাসপাতালের বহির্বিভাগের করিডোরে হাঁটছিলেন ড. অর্ণব মুখার্জী, সবে মাত্র দুপুর গড়িয়েছে। এক হাতে কফির কাপ, অন্য হাতে মেডিকেল ফাইল। এই হাসপাতালেই তিনি রেডিওলজি বিভাগের প্রধান, গত আট বছর ধরে। সবকিছুই যেন রুটিনের মতো চলছিল, যতক্ষণ না রিসেপশন থেকে ফোন আসে—“ডাক্তারবাবু, একজন নতুন রোগী এসেছেন, বুকের ব্যথা নিয়ে, কিন্তু একটু অদ্ভুত আচরণ করছেন।” ড. অর্ণব চোখ কুঁচকে রুমে ঢুকলেন। রোগীর নাম রোহিত সেন, বয়স আনুমানিক সাতাশ-আটাশ, স্মার্ট পোশাক, চুপচাপ চোখ। প্রথমে দেখে মনে হয় না খুব গুরুতর কিছু, তবে রোহিতের চোখদুটো যেন ঘুমহীন আতঙ্কে ধকধক করছিল। প্রশ্নের জবাব দিল সংক্ষেপে—“বুকটা মাঝে মাঝে এমন টান মারে, যেন কেউ ভিতর…
-
অনিন্দ্য ঘোষ ১ শিউলি আর আতরের গন্ধে ভরে উঠেছিল পুরনো রায়চৌধুরি বাড়ির আঙিনা। দীপাবলির উৎসব, তাই শতবর্ষীয় অন্দরমহল আজ নতুন আলোয় আলোকিত। লালটেন থেকে ফেয়ারি লাইট, পায়রা কাঁপানো পটকা আর চিত্তাকর্ষক রকমারি মিষ্টির হাঁড়ি—সবই যেন একটা নিখুঁত নাট্য মঞ্চের পরিপাটি প্রপস। ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁতেই ছোটদের দল মেতে উঠল ফোয়ারা আর চাকরি নিয়ে, আর প্রবীণরা চায়ের কাপ হাতে স্মৃতির আলো-আঁধারিতে গল্পে মশগুল। বাড়ির কনিষ্ঠ পুত্রবধূ কবিতা তখন সবে সিঁড়ি দিয়ে নামছে—হলুদ তসর শাড়ি, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, হাতে একটা তাজা চন্দ্রমল্লিকা ফুল। চোখে চোখ রেখে কারও সঙ্গেও কথা বলছে না, কেবল নিঃশব্দে হাঁটছে—একটা নিস্তব্ধ অভিমান যেন তার চলনে ধরা দেয়। তাকে…
-
অধ্যায় ১ ড. শৌনক ভট্টাচার্য বসেছিলেন নিজের স্টাডি রুমে, জানলার বাইরে কুয়াশা নামছিল ধীরে ধীরে। কলকাতার ডিসেম্বরে এমন হিমেল সন্ধ্যা যেন তার প্রিয় — নিঃশব্দে পুরনো বইয়ের পাতা উল্টে দেওয়ার মতো। কাঁপা আলোয় টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিল কিছু নীলচে বিবর্ণ মানচিত্র, কয়েকটি পুরনো পাণ্ডুলিপি আর একটি হলুদ হয়ে যাওয়া খাম। সেই খামের ভেতর থেকে বেরিয়ে ছিল একটি চিঠি, যা সম্ভবত ১৯২০ সালের দিকে লেখা — পাঠক ছিল ‘নলিনীপ্রসাদ ভট্টাচার্য’, যিনি ছিলেন তাঁর প্রপিতামহ। চিঠিতে লেখা ছিল এক প্রাচীন শহরের নাম — ‘বোধানগর’। শহরটির নাম ইতিহাসে প্রায় উধাও, কিন্তু লোককথায় মাঝেমাঝে ওঠে আসে; বলা হয়, “বোধানগর আজও জেগে ওঠে কাঁদতে।” শৌনকের…
-
শুভ্রনীল দে ১ নতুন শহরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো দোতলা বাড়িটা প্রথম থেকেই ইরার ভালো লাগেনি। বাইরে থেকে একরকম, ভেতরে ঢুকলেই মনে হয়, সময় যেন এখানে আটকে গেছে— দেওয়ালের ছোপ ধরা রঙ, কাঠের সিঁড়ির আর্তনাদ, আর অলিন্দে সারাদিনই একটা চাপা ছায়া। ইরার মা স্মিতা এক বড়ো কোম্পানিতে কাজ করে, রাতে দেরি হয় প্রায়শই, ফলে স্কুল থেকে ফিরে ইরাকে বেশিরভাগ সময় একাই কাটাতে হয়। প্রথম কয়েকদিন তেমন কিছু মনে হয়নি— নতুন স্কুল, নতুন পাড়া, নিজের ছোট একটা ঘর— সবকিছু মিলিয়ে একরকম উত্তেজনা ছিল। কিন্তু ঠিক সপ্তম দিন রাতে শুরু হয় প্রথম অস্বস্তি। রাতে ঘুম ভেঙে যায়, পাশে টেবিল ঘড়ির কাঁটায়…
-
নির্মাল্য বসু এক হেমন্তের সকালে কলকাতার আকাশ ছিল ধোঁয়াটে, যেন স্মৃতি জমা ধুলোয় ধরা পড়ে আছে। ড. অনিরুদ্ধ বসু তার বাগুইআটির ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে সিগারেট ধরালেন, সামনে একটা পুরনো কাঠের টেবিলে ছড়ানো ইতিহাসের বইপত্র আর হিন্দু-মিথলজির লিপিবদ্ধ নথি। গত কয়েক বছর ধরে তিনি সক্রিয় গবেষণা থেকে দূরে ছিলেন, কিন্তু পুরনো অভ্যাসটা এখনও যায়নি—প্রতিদিন ভোরবেলা ধোঁয়ায় মিশে যাওয়া শহরটাকে দেখতে দেখতে কল্পনায় ফিরে যেতেন হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার দিকে। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। কেয়ারটেকার কমল একটা বাদামি খাম এগিয়ে দিল—অদ্ভুত ধরনের মোটা কাগজে মোড়া, প্রেরকের নাম নেই, শুধু লেখা: “ড. অনিরুদ্ধ বসু, পুরাতত্ত্ব গবেষক, কলকাতা।” খাম খুলে অনিরুদ্ধ প্রথমে দেখলেন একটা…
-
ঋত্বিক বসু ১ শীতকাল তখন ঠিক জমে ওঠেনি, তবে পাহাড়ি হাওয়ায় একটা ঝাঁঝালো ঠান্ডা সকাল নিয়ে হাজির হয়েছিল অভিষেক দাশগুপ্ত। দার্জিলিঙের চৌরস্তা থেকে আরও পঁচিশ কিলোমিটার উপরের দিকে, ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্রাম — ‘চাংথাং’। কেউ শোনেনি শহরে এই গ্রামের নাম, আর যারা শুনেছে, তারা এটাকে এড়িয়ে গেছে বছরের পর বছর। অভিষেক কিন্তু ইচ্ছা করেই এখানে এসেছে। কলকাতার এক নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞ লোকজ বিশ্বাস ও লোকশ্রুতি নিয়ে। উত্তরবঙ্গের গা ছমছমে প্রাচীন গল্প-গাথা নিয়ে একটা গবেষণাপত্রের কাজ চলছে তার। এই চাংথাং গ্রামের কথা সে প্রথম শুনেছিল একটি অজানা তিব্বতি চিঠিতে, যেটা পাওয়া গিয়েছিল সিকিম সীমান্তের এক পুরনো গুহায়, সঙ্গে একটা…