রুদ্র মুখার্জী কলেজের প্রথম দিন থেকেই অয়ন আর স্রবন্তীর পথ যেন কেমন করে একে অপরের বিপরীতে গিয়েই দাঁড়িয়েছে। অয়ন ক্লাসের সবথেকে দুষ্টু, প্রাণোচ্ছল আর একরকম উড়নচণ্ডী ছেলে; তার হাসি, তার মজা করা আর বন্ধুদের নিয়ে হইচই করা যেন পুরো ব্যাচের অংশ হয়ে গেছে। স্রবন্তী ঠিক তার উল্টো—গম্ভীর, শান্ত, নিজের পড়াশোনায় মন দেওয়া মেয়ে। একদিকে অয়নের স্বভাবসিদ্ধ ঠাট্টা, অন্যদিকে স্রবন্তীর শীতল জবাব—এই দুটোই কলেজের আড্ডাঘরে একধরনের নিয়মিত দৃশ্য হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম দিনেই ঘটনা ঘটে—অয়ন স্রবন্তীর খাতা উল্টে বলেছিল, “এত সুন্দর হাতের লেখা দেখে মনে হচ্ছে ফন্ট বানিয়ে দেওয়া উচিত।” ক্লাস হেসে গড়াগড়ি, আর স্রবন্তীর গম্ভীর মুখ আরও কঠিন হয়ে যায়। সে…
- 
				
 - 
				
স্নেহা চৌধুরী সকালবেলা গ্রামের শান্তিপূর্ণ আবহে অনিকেত সাইকেলের চাকা ঘুরাতে থাকে, যেন প্রতিটি ঘূর্ণনই গ্রামের মানুষের জীবনের ছোট্ট গল্পকে স্পর্শ করছে। সূর্য কুয়াশার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠছে, এবং পাতার কোণে কণা কণায় জলরাশি ঝলমল করছে। গ্রামের সরু মাটির পথ ধরে সে এগিয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি ছোট্ট গলি তার কাছে পরিচিত—যেমন সে সেই গ্রামের প্রত্যেকটি মুখের সঙ্গে পরিচিত। ডাকপিয়ন হিসেবে তার দৈনন্দিন কাজ হলো চিঠি পৌঁছে দেওয়া, কিন্তু অনিকেতের কাছে প্রতিটি চিঠি কেবল কাগজ নয়; তা মানুষের আবেগ, স্মৃতি এবং হাহাকার-এর সংমিশ্রণ। বাড়ি বাড়ি যায়, দরজার ঘুষি বাজায়, কখনও কেউ হাসি দিয়ে স্বাগত জানায়, কখনও কেউ নীরবতা বজায় রাখে।…
 - 
				
রূপক হালদার কোলাহল ভরা শহরের এক কোণে, কলেজস্ট্রিটের কাছের ছোট্ট একটি ক্যাফে রাতের অন্ধকারে আলোয় ঝলমল করে উঠেছিল। ক্যাফেটির দেয়ালজুড়ে ঝুলছিল পুরোনো ভিনাইল রেকর্ড, অচেনা বিদেশি ব্যান্ডের পোস্টার, আর এক কোণে রাখা ছিল ধুলো জমা পিয়ানো। আজকের রাতটা ছিল বিশেষ—ওপেন-মাইক নাইট। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তরুণ-তরুণীরা তাদের গান, কবিতা বা গল্প নিয়ে আসে এখানে। দর্শকের ভিড় খুব বড় নয়, তবে উপস্থিত প্রত্যেকেই শিল্পের প্রতি টান অনুভব করে। ইশানি সেন, কালো শাড়ি পরা, মোটা ফ্রেমের চশমা চোখে, চুল খোলা, সেদিন ক্যাফেতে প্রথমবার অংশ নিতে এসেছে। কলেজ থেকে বেরোনোর পর থেকে নিয়মিত গান গেয়ে আসছে সে, কিন্তু এই ক্যাফের মঞ্চে ওঠা তার…
 - 
				
নন্দিতা রায় কলকাতার রাত নেমে এসেছে। অফিস পাড়া ফাঁকা হতে শুরু করেছে, কিন্তু হাওড়া বা শিয়ালদহমুখী লোকালের প্ল্যাটফর্ম তখনও গমগম করছে। ব্যস্ত দিন শেষে ট্রেন ধরে ফেরা এই শহরের মানুষের কাছে শেষ লোকাল মানে যেন জীবনের অবশিষ্ট কয়েক ফোঁটা শক্তি খরচের জায়গা। প্রতিদিনের মতোই অয়ন মুখার্জী হাঁটছে ক্লান্ত পায়ে। তার চোখে লাল আভা, কাঁধে ব্যাগের ভার, মুখে একরকম নিরাসক্তি। যেন পুরো দিনটা তাকে চেপে রেখেছে, আর ট্রেন ছাড়া তার কোনো আশ্রয় নেই। অয়ন এই সময়ের লোকাল ধরতে অভ্যস্ত—শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে বাড়ি ফেরার একমাত্র উপায় এই শেষ যাত্রা। ট্রেনে ওঠার সময় সে জানে—এখানে গাদাগাদি, ঘাম, ঠেলাঠেলি থাকবে, কেউ হয়তো ঝগড়া…
 - 
				
সুতপা দাস ১ রাতের ট্রেনটা যেন এক অদ্ভুত ছায়াচ্ছন্ন সুরের মতো ছুটে চলছিল অন্ধকার গাছপালা আর ফাঁকা স্টেশনের পাশ দিয়ে। জানালার কাচে প্রতিফলিত হচ্ছিল ভেতরের ম্লান আলো, আর তার ভেতরেই বসে ছিল অদ্রিজ—এক হাতে বই, আরেক হাতে অচেতনভাবে কলম ঘোরাচ্ছিল। ভিড়ের বগি হলেও চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল, যাত্রীদের অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে, কেউ কেউ চুপচাপ ফোনের আলোয় স্ক্রল করছে। অদ্রিজ বই পড়ার ভেতর ডুবে থাকার চেষ্টা করছিল, কিন্তু তার চোখ বারবার সরে যাচ্ছিল জানালার বাইরে, অন্ধকারে দৌড়তে থাকা আলো-ছায়ার খেলায়। তার ভিতরটা যেন অস্থির, একাকিত্বের ভার মিশে আছে দেহভঙ্গিতে। ঠিক তখনই দরজার দিক থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো এক মেয়ের পায়ের…
 - 
				
সুস্মিতা দে অধ্যায় ১: উত্তরবঙ্গের ছোট শহরটি যেন এক অদ্ভুত মায়ার পর্দায় মোড়া। পাহাড় থেকে নেমে আসা ধোঁয়াটে মেঘ, ঘন সবুজের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা ছোট ছোট টিনের চালের ঘর, কোলাহলহীন রাস্তায় মাঝে মাঝে শোনা যায় সাইকেলের ঘণ্টা কিংবা দূরের ট্রেনের হুইসেল—সব মিলিয়ে শহরটিতে যেন একধরনের ধীরলয়ের সুর বেজে চলে। এই শহরেই সদ্য যোগ দিয়েছেন ডাঃ অনির্বাণ সেন। বয়স মাত্র উনত্রিশ, কিন্তু শহরের হাসপাতালের দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়েছে। কলকাতার ভিড়, হাসপাতালের প্রতিযোগিতা আর ব্যস্ততার মাঝে এতদিন কাটিয়ে হঠাৎ একেবারে উত্তরবঙ্গের এই ছোট্ট শহরে চলে আসা—প্রথম প্রথম তাকে খানিকটা অস্বস্তিতে ফেলেছিল। সরকারি হাসপাতালের পুরোনো ভবন, দরজার পেছনে জমে থাকা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ,…
 - 
				
সুপ্রিয় নাথ এক ট্রেনটা যেন ধীরে ধীরে ছুটে আসছিল অন্য এক জগতে, যেখানে শহরের ধোঁয়া, কোলাহল, অফিসপাড়ার তাড়াহুড়ো মিলিয়ে যাচ্ছিল সবুজে মোড়া বিস্তৃত মাঠের আড়ালে। জানালার বাইরে অরিত্রর চোখ থেমে থাকছিল বারবার গরুর গাড়ি, ধানক্ষেত আর পাকা রাস্তার ধুলোয়। বহু বছর পর সে আবার গ্রামে এসেছে, অথচ তার নিজের গ্রামের সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই। মামাতো বোনের বিয়ের জন্যই এই সফর। শহরের অ্যাপার্টমেন্ট, গাড়ির হর্ন আর কংক্রিটের জগতের বাইরে এসে যেন এক নতুন নিঃশ্বাস নিতে পারছিল সে। তার মনে হচ্ছিল, এখানে বাতাসও অন্য রকম—আরও নরম, আরও পরিষ্কার। ট্রেনের জানালা দিয়ে দিগন্ত পর্যন্ত ছুটে চলা সবুজকে দেখে তার মনে হচ্ছিল, এ…
 - 
				
স্বপ্ননীল রায় (১) প্রথম দিনের সকালের সেই মুহূর্তটা অদ্রিজার কাছে অনেকটা অচেনা রাস্তা ধরে হাঁটার মতো ছিল। নতুন কাজ, নতুন প্রোজেক্ট, নতুন অফিস—সবকিছুই যেন একসাথে এসে তার কাঁধে বসে পড়েছিল। কো-ওয়ার্কিং স্পেসের কাচ-ঘেরা ফ্লোরে পা রাখা মাত্রই সে এক অদ্ভুত গন্ধ টের পেল—কফির তাজা গন্ধ, প্রিন্টারের কালি, আর ল্যাপটপের তাপে তৈরি হওয়া ধাতব উষ্ণতার মিশ্রণ। চারপাশটা আধুনিক সাজে সাজানো—ছোট ছোট ডেস্ক, হালকা রঙের দেয়াল, গাছপালা দিয়ে সাজানো কোণ, আর টেবিলের ওপরে খোলা ডায়েরি ও টেক-গ্যাজেটের মেলা। অদ্রিজার হাতে তখন একটা ফাইল আর একটা ল্যাপটপ ব্যাগ, মুখে স্বাভাবিক ভদ্র হাসি। সে একে একে ডেস্কগুলো দেখছিল, যেখানে বিভিন্ন বয়সের মানুষ তাদের কাজে…
 - 
				
অর্পিতা সেনগুপ্ত ১ ২০২৫ সালের বসন্তকাল। শান্তিনিকেতনের কাঁচা রাস্তার ধুলো তখনো শীতের শেষ হাওয়ায় হালকা হয়ে উড়ছে, আর কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোতে ফুটতে শুরু করেছে লালচে ফুল। ভোরবেলা গ্রামের পূর্বদিকে হঠাৎ যেন এক অচেনা কোলাহল নেমে আসে। কাঁচা রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে ঢুকে পড়ে কয়েকটি বড় ট্রাক—কেউ বহন করছে বিশাল আলো ঝোলানোর স্ট্যান্ড, কেউ বা কাঠের বাক্সে ভরা অদ্ভুত যন্ত্রপাতি। সঙ্গে রঙিন কভার দিয়ে ঢাকা পোশাকের গাড়ি, আরেকটিতে খাবারের সরঞ্জাম। কয়েকজন লম্বা বিদেশি, গলায় ক্যামেরা ঝুলানো, আর চওড়া টুপিওলা কর্মীরা নামতেই গ্রামের শিশুরা কৌতূহলী চোখে ভিড় জমায়। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা খেজুর গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে, “ওরা নাকি সিনেমা তুলবে।” শ্যামলী দত্তের হোমস্টের উঠোন তখন…
 - 
				
অদিতি চক্রবর্তী (১) ঋতমের কাছে গোধূলি বেলা সবসময়ই এক অদ্ভুত আকর্ষণের সময়। সূর্যের শেষ সোনালি আলো যখন নদীর জলে গিয়ে মিশে যায়, তখন আকাশ, জল আর বাতাস মিলেমিশে তৈরি করে এক রঙিন ক্যানভাস, যা তার আঁকার খাতায় ধরা পড়ে না, কিন্তু তার মনে গভীর ছাপ ফেলে। সেদিনও সে স্কুলের ব্যাগ ঘরে ফেলে দিয়ে হাতে স্কেচবুক আর পেন্সিল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল সেই পরিচিত বাঁকের দিকে। রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে শুনতে পায় পাখিদের বাসায় ফেরার ডাক, দূরে কারো গরু ফেরানোর বাঁশি, আর গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে হালকা আলো এসে তার গায়ে পড়ছে। নদীর ধারের কাশফুলগুলো তখন গোধূলির আলোয় যেন রুপালি আভা…