প্রদীপ মালাকার এক ঈহিত কর্ণিক নদীর দিকে তাকিয়ে বসেছিল লোকাল বাসের জানালায়, কাঁচের ওপারে ভেসে যাচ্ছিল আধা ঝাপসা একচিলতে সবুজ, দূরের সোনালি সর্ষে আর মাঝেমাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছের সারি। কলকাতার শীতের দুপুর ফিকে হয়ে আসছিল, আর তারই ফাঁকে ফাঁকে গ্রামের শান্ত ধুলোপথ যেন পুরনো কাহিনির বইয়ের মতো পাতা উল্টাচ্ছিল। ঈহিত, পেশায় অনলাইন নিউজ পোর্টালের রিপোর্টার, কিন্তু আসলে একজন কৌতূহলী অনুসন্ধানকারী—যে ভয় আর যুক্তির মাঝখানে দাঁড়িয়ে খুঁজে বেড়ায় সত্য। গত দুই মাস ধরে সে অনুসরণ করছিল এই নদীপারের পুরনো প্রাসাদের গল্প, যেখানে নাকি রাতের গভীরে বাঁশির সুর ভেসে আসে, আর যাদের সে সুর ছুঁয়ে যায় তারা কখনো ফিরে আসে…
-
-
তথাগত সান্যাল অধ্যায় ১: ডামরুর প্রথম ধ্বনি শিবরাত্রির রাত। হিমছোঁয়া বাতাসে ভেসে আসছে ধূপধুনোর গন্ধ, শালবনের ফাঁকে পূর্ণিমার চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে মাটি ছুঁয়ে। উত্তর ত্রিপুরার অরণ্যঘেরা গুহামন্দিরে দাঁড়িয়ে ঋভু রায়চৌধুরী অনুভব করলেন—এ কেবল একটি সাধারন রাত্রি নয়। দিনদুয়েক আগেই কলকাতা থেকে আসার সময় লোকাল ড্রাইভার বলে দিয়েছিল, “এই মন্দিরে আজও কিছু ঘটে… বিশেষ করে শিবরাত্রির রাতে।” ঋভু প্রথমে হেসেছিলেন। তবে সেই হাসি চাপা পড়ে গেল, যখন তিনি ওই গুহার সামনে পৌঁছে এক ছায়াময় বৃদ্ধকে বসে থাকতে দেখলেন—দাঁতহীন মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি, গায়ে জটাধারী চেহারা, আর হাতে ছিল একটি পুরনো কাঠের বাক্স। বৃদ্ধ কোনও কথা না বলে কেবল ইশারায় বাক্সটি ঋভুর…
-
অর্কপ্রভ পাল ঘন দুপুরের কলকাতা—হাওড়া ব্রিজের নিচ দিয়ে গঙ্গার জল পাগলের মতো ধাক্কা খাচ্ছে পিলারের গায়ে, আর শহরের বাতাসে যেন কোনো অদৃশ্য অস্থিরতা জমাট বেঁধে আছে। সরকারি দপ্তরে কেউ মুখ ফুটে বলছে না, কিন্তু মন্ত্রকের চত্বরে চায়ের দোকানগুলোর গুঞ্জন বলে দিচ্ছে—কিছু একটা হতে চলেছে। সায়নী বসু প্রেসক্লাবে বসে ল্যাপটপে শেষ লাইনটা টাইপ করছিল: “এই শহরে আমরা শুধু নজরে নই, আমরা এখন কানের ভিতরেও।” সে জানে, আজ রাতটা গুরুত্বপূর্ণ। সে জানে, তার রিপোর্ট প্রকাশ পেলে বড় ঝড় উঠবে। একই সময়, শহরের উত্তর দিকে নিজের ঘরের জানালা দিয়ে অর্ক মুখার্জী দেখছিল তার ডিজাইন করা ইন্টেলিজেন্ট সিটির মানচিত্র—আলোকিত রাস্তার প্রান্তে লুকিয়ে থাকা নিঃশব্দ…
-
দিব্যজ্যোতি নন্দী এক বর্ধমান শহরের শেষপ্রান্তে যে পুরনো রেলগেটটা পড়ে আছে, তার ঠিক পরেই একটা আঁকাবাঁকা রাস্তা সোজা চলে গেছে চৌরাস্তার দিকে। দিনের বেলায় জায়গাটা নেহাতই সাধারণ—দুটো চায়ের দোকান, একটা পানের খুচরো স্টল, আর রাস্তার ধারে পুরনো বিদ্যুতের খুঁটি। কিন্তু রাত নামলেই জায়গাটার চেহারা পাল্টে যায়। এই শহরের বাসিন্দারা জানে, চৌরাস্তার সেই ধূসর শ্মশানঘরটার পাশ দিয়ে কেউ বারোটার পরে হেঁটে যায় না। নতুন থানায় বদলি হয়ে আসা ঋষভ চট্টোপাধ্যায় এসব কাহিনি প্রথম শুনেছিল থানার কনস্টেবল অসীমের মুখে। “স্যার, ওদিকে একবার গেলে পেছনে তাকাবেন না। লোকজন বলে, পেছনে তাকালে নিজের ছায়াও হারিয়ে যায়।” ঋষভ এসব কথা শুনে হেসেছিল। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা…
-
সৌম্যজ্যোতি ভট্টাচার্য ভোর চারটের দিকে কলকাতার আকাশে বৃষ্টির গন্ধ মিলিয়ে ছিল ধোঁয়ার মত আবছা আলো। কৌশিক মৈত্র জানালার ধারে বসে ছিল চুপ করে, ছয়তলার ফ্ল্যাটের নিচে তখনও শহর জেগে ওঠেনি। তার গলায় ঝুলে থাকা কাঁপতে থাকা একচিলতে নিঃশ্বাস, বিছানার ধারে পড়ে থাকা খোলা ঘুমের ওষুধের শিশি, ও পাশের টেবিলে ছেঁড়া কাগজে কুংথিত দুটো শব্দ— “মাফ করো”। গত রাতটা সে ঠিক কীভাবে পার করল, মনে পড়ে না। অথবা, মনে পড়াতে চায় না। এ জীবনের সব ছায়া, সব আগুন, সব ব্যর্থতা ঘিরে রেখেছিল তাকে এক অদ্ভুত অস্পষ্ট ধোঁয়াশায়, যেন কিছুই আর বাস্তব নয়—সবই বাষ্প। সেই বাষ্পেই ঘোর লাগা চোখে হঠাৎ পড়ে যায়…
-
নিলয় মিত্র অধ্যায় ১ সাহিত্যিক সৌম্য মিত্রের নিথর দেহটি পড়েছিল তার উত্তর কলকাতার দোতলা বাড়ির লেখার ঘরে, জানালার পর্দা অর্ধেক সরানো, বাইরের ঝিরঝিরে বৃষ্টির আলো গালচে করে রেখেছে কাঁচের ওপর। ছোট একটি কাঠের টেবিলে ছড়িয়ে থাকা কাগজগুলো ছিল সযত্নে বাঁধা একটি পাণ্ডুলিপি, নামহীন, কেবল প্রতিটি পাতার নিচে লাল কালি দিয়ে স্পষ্টভাবে লেখা — “এটা আমার লেখা নয়।” তার ডান হাতে শক্ত করে ধরা একটি পার্কার কলম, পাশে পড়ে থাকা আধখোলা পেন্সিল বক্স, আর ঘরের কোণে নিঃশব্দে জ্বলছিল একটি কুয়াশামাখা টেবিল ল্যাম্প। পুলিশের প্রাথমিক রিপোর্ট বলেছে—আত্মহত্যা। ঘুমের বড়ি ও হুইস্কির সম্মিলিত প্রভাবে মৃত্যু হয়েছে সম্ভবত রাত আড়াইটার সময়। কিন্তু বাড়ির কাজের…
-
দিব্যজ্যোতি হালদার অধ্যায় ১: বছর সাতেক পর দীপঙ্কর চৌধুরী পা রাখল মুর্শিদাবাদের পুরনো রাজবাড়ির উঠোনে। হাওয়ায় একরকম বাষ্পঘন গন্ধ—পুরনো কাঠ, চুনকাম ধরা দেয়াল, আর দাদুর ব্যবহৃত তেল-সুগন্ধির মিশেল। ইংল্যান্ডে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করার পর এমন প্রাসাদোপম, অলস অথচ রহস্যময় পরিবেশে ফিরে আসাটা একধরনের সাংস্কৃতিক ধাক্কা। অথচ মনে এক অদ্ভুত শূন্যতা—এই বাড়িতেই তার শৈশব কেটেছে, তার ঠাকুমার সঙ্গে কান্না-মাখা গল্পের সন্ধ্যা, পেছনের বাগানে আমগাছের ডালে দোল খাওয়া, আর গজদরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ের মুখোশ পরা কল্পনা। সেই গজদরজা—মুখ্য আকর্ষণ, আর একসাথে সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিস এই বাড়ির—আজও একইরকম দাঁড়িয়ে, জং ধরা লোহার দাঁতের মতো নখর ছড়ানো দরজা, যার পেছন থেকে মাঝরাতে কান্নার…
-
সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এক শহর কখনও কাউকে নিজের করে নেয় না, আবার কখনও কাউকে ছেড়ে দেয় না—এই দুইয়ের মাঝখানে অনন্তভাবে আটকে ছিল সায়ন্তন চৌধুরীর জীবন। কলকাতার এই কর্পোরেট কাঁচের খাঁচায় তার দশ ঘন্টার অফিস, তিন ঘন্টার ট্রাফিক, আর বাকি সময় শুধু দমচাপা ক্লান্তি। ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে শহরের আলোগুলো যেন মৃত্যুর স্বপ্ন দেখায়, বেঁচে থাকার নয়। গত এক বছরে সায়ন্তনের মধ্যে অনেক কিছু ভেঙেছে—প্রেম, আশা, বিশ্বাস, নিজেকে ভালোবাসার ক্ষমতা। নয়নিকার চলে যাওয়া যেন তার আত্মাকে একবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। সেই অভিশপ্ত দিনগুলোর পরেই শুরু হয় প্যানিক অ্যাটাক, ঘুম না হওয়া, নিজেকেই অচেনা মনে হওয়া। অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়েছে, মেডিটেশন অ্যাপ…
-
বোধিসত্ত্ব চক্রবর্তী (১) কলকাতার নারকেলডাঙার থানায় সদ্য বদলি হয়ে আসা অফিসার অরিত্র বসু জানতেন না, এই বদলি তার জীবনের সব যুক্তি-পরম্পরাকে ভেঙে দেবে। সেই সময় বর্ষা শেষের দিন, আকাশে ছাইরঙা মেঘের স্তর ঝুলছে। সকালবেলা থানায় বসেই অরিত্রর হাতে এসে পড়ে এক বিশেষ চিঠি—দক্ষিণ ২৪ পরগণার এক প্রত্যন্ত গ্রাম ‘ছায়ামাটি’তে পরপর তিন বছর একদিনে আগুন লেগে গেছে, গ্রামের একাংশ ছাই হয়ে গেছে, এবং আজও কেউ জানে না কেন বা কীভাবে। চিঠির নিচে স্বাক্ষর করেছেন ডি.এস.পি. গগন সরকার—অরিত্রকে বলা হয়েছে, ঘটনাটি তদন্ত করে বিস্তারিত রিপোর্ট জমা দিতে হবে। অরিত্র প্রথমে ভাবলেন, এ তো ফায়ার ব্রিগেডের ব্যাপার, পুলিশের কী? কিন্তু পড়তে পড়তে চোখ…
-
স্বপ্না বসাক অধ্যায় ১: রুদ্রনাথের ছায়া কলকাতার প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস বিভাগে এক টানা ক্লাস নিয়ে ক্লান্ত অধ্যাপক অরিন্দম মুখার্জি সেদিন সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে পেলেন এক অদ্ভুত মোড়া খাম—কোনো প্রেরকের নাম নেই, শুধু ছাপা হরফে লেখা “রুদ্রনাথ জীবিত!” খামের ভেতরে ছিল একটি ভাঁজ করা কাগজ, তাতে একটি সুস্পষ্ট নকশা—উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জের এক রাজবাড়ির তলায় সুড়ঙ্গের মানচিত্র। কৌতূহলে আঁচ করলেন, এটি সেই কিংবদন্তির সঙ্গে সম্পর্কিত, যা তিনি ছাত্রজীবন থেকে শুনে এসেছেন—একটি দেবমূর্তি, যার নাম “রুদ্রনাথ”, যা সেন রাজবংশের আমলে তৈরি এবং বলা হয়, এটি যার হাতে থাকবে, তার জীবন থেকে চিরতরে দারিদ্র্য সরে যাবে। যদিও তিনি একে লোককথা বলে এড়িয়ে গিয়েছেন, কিন্তু এই…