সৃজন বসু এক পার্ক স্ট্রিটের রাত মানেই আলো, কোলাহল, গাড়ির হর্ন আর মানুষের হাসি-আড্ডায় ভরা এক জীবন্ত ছবি। সেদিনও ব্যতিক্রম ছিল না। শীতের শুরুতে রাস্তায় রঙিন লাইটের মালা, বিদেশি আর দেশি সুরের মিশ্রণ, আর খাবারের গন্ধে ভরে উঠেছিল বাতাস। রাত সাড়ে নয়টার দিকে ‘দ্য ব্লু অর্কিড’ নামের এক বিলাসবহুল রেস্তোরাঁয় ডিনারের ভিড় ঠাসা। মোটা মোটা গ্লাসের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, শহরের ধনী-প্রভাবশালী মহল ব্যস্ত নিজেদের গল্পে, কেউ চুমুক দিচ্ছে রেড ওয়াইনে, কেউবা কাঁটাচামচে কেটে নিচ্ছে স্যামন স্টেকের টুকরো। হঠাৎ করেই দূরের আকাশে একটি মৃদু গুঞ্জন শোনা যায়—প্রথমে মনে হয় কোনো মোটরসাইকেল পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, কিন্তু শব্দের দিকনির্দেশ যেন উপরের…
-
-
অগ্নিভ চক্রবর্তী ১ কলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের পুরনো ভবনটার করিডোর সবসময়ই যেন একটু অন্ধকার আর আর্দ্র গন্ধে ভরা থাকে, বিশেষ করে বর্ষার রাতে। বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ, জানলার ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসছে ঠান্ডা বাতাস, আর কোথাও দূরে হাসপাতালের করিডোরে ভিজে স্লিপারের শব্দ ভেসে আসছে। অয়ন মুখার্জী, তৃতীয় বর্ষের মেডিকেল ছাত্র, নিজের ঘরে বসে নোটস লিখছিল, কিন্তু মনটা অস্থির। সেদিন বিকেল থেকে বন্ধুর ফোনে কোনো উত্তর নেই—ঋত্বিক সেন, যে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, সবসময় সময়মতো খবর দেয়, তার এই নীরবতা অয়নকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ হঠাৎ পাশের ঘর থেকে আসা একটা ধাক্কার শব্দ অয়নকে চমকে দিল। শব্দটা…
-
অভ্রজ্যোতি সেন ১ সকালবেলা কলকাতার হাওড়া ঘাটে জমে উঠেছিল এক অদ্ভুত রকম উত্তেজনা। পা ছুঁয়ে চলা কুয়াশার ফাঁক দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল একটি বড় ট্রলার, যার মাথায় লটকে থাকা লাল কাপড় বাতাসে কেঁপে উঠছিল। রুদ্র সেনগুপ্ত, ক্যামেরা ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, চোখে ছিল অদ্ভুত এক আলোকছায়ার খেলা। তার চোখে যেন শুধুই দ্বীপ, শুধু রহস্য। এই ডকুমেন্টারি তার জন্য শুধু পেশাদার প্রজেক্ট নয়, বরং এক অদ্ভুত টান—অজানা কিছুর ভিতরে পা ফেলার খিদে। তার সঙ্গেই ছিল ক্যামেরাপার্সন মৃণালিনী পাল—সবাই মিরা বলে ডাকে। চোয়াল শক্ত, চোখে নির্ভীকতা, যেন জঙ্গলও তাকে ভয় পায়। অর্কদীপ সাহা, যাকে সবাই অর্ক নামে জানে, সদা চঞ্চল, সাউন্ড রেকর্ডারের…
-
অভিজিৎ জোয়ারদার ১ আকাশ যেন দিনের আলো গিলতে শুরু করেছে। এক অদ্ভুত চাপা অন্ধকার পুরো উপকূলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। আবহাওয়াবিদ নিহারিকা চৌধুরী, খুলনার উপকূল গবেষণা কেন্দ্রের কন্ট্রোল রুমে বসে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছেন রাডার স্ক্রিনের দিকে। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস তার কাছে নতুন কিছু নয়, কিন্তু এবার কিছু অস্বাভাবিক। ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র বারবার তার গতিপথ পরিবর্তন করছে— যেন কারও নির্দেশে চলছে। সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বা বায়ুচাপ এসব নিয়ন্ত্রণ করে সাইক্লোনের দিক, কিন্তু এবার সে নিয়ম মানছে না। উপগ্রহচিত্রে দেখা যাচ্ছে, ঝড়টি অদ্ভুতভাবে ঘনীভূত হচ্ছে, অথচ পূর্বাভাস অনুযায়ী এটি মাত্র একটি লো প্রেসার থাকার কথা ছিল। নিহারিকা তাঁর সহকর্মী সাব্বিরকে বলেন, “এই কিছু একটা গড়বড়…
-
১ জুন মাসের ঘন ঘোর দুপুরে শহরের গলিপথে হেঁটে আসছিল সৌভিক নন্দী। দক্ষিণ কলকাতার গলিগুলো বর্ষার ভিজে গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে, আর তার চোখ আটকে ছিল ছোট্ট একটা ইলেকট্রনিক্স দোকানে। ‘গ্লোবাল টেক রিপেয়ারিং’—দোকানটা যতটা আধুনিক নামধারী, ভেতরটা ঠিক ততটাই বেসামাল। পুরনো হার্ডডিস্ক, চার্জার, ক্যাবল, হারিয়ে যাওয়া মেমোরি কার্ডের দল স্তূপ হয়ে পড়ে আছে। দোকানের মালিক সৌরভ, যাকে সকলে ‘সনি দা’ বলে চেনে, হাসিমুখে বলল—”দেখো তো ভাই, এই ৬৪ জিবির পুরনো মেমোরি কার্ডটা কাজে লাগে কিনা, দাম নেবে না বেশি।” কৌতূহলবশতই সৌভিক সেটা তুলে নেয়। ক্যামেরা বা ফোন নয়, ভিডিও ফুটেজ এডিট করা আর রিকভার করাই এখন তার কাজ, আর পুরনো…
-
তাপস মিত্র ১ কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির শেষ প্রান্তে একটি পুরোনো, প্রায় পরিত্যক্ত স্টুডিও—যার নাম ‘নৃত্যনিকেতন’—সেখানে প্রায় ছয় বছর পর ফিরে এল অর্ণবী সেন। একসময় এই স্টুডিও তার প্রথম নাচ শেখার জায়গা ছিল, যেখানে প্রতিটি কাঠের মেঝে, প্রতিটি আয়না তাকে শিখিয়েছিল শরীরের ভাষা। এখন সে দেশের খ্যাতনামা নৃত্যশিল্পী, দেশে-বিদেশে শো করে বেড়ায়, অথচ মনটা ফিরে আসে এই পুরোনো কাঠের দরজার নিচে জমে থাকা ধুলোর গন্ধে। গুরু মীরা বসুর ডাকে এসেছিল আজ, স্টুডিওর নীচের পুরোনো ঘরে কিছু পুরনো উপকরণ খুঁজে বের করতে হবে—পুরোনো পোশাক, বাদ্যযন্ত্র, কিছু অলঙ্কার—যেগুলো তাদের নতুন নাট্য প্রযোজনায় ব্যবহৃত হবে। অর্ণবী একাই ঢুকেছিল সেই ঘরে। জানালার ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে…
-
নীলাদ্রী সেনগুপ্ত ১ রুদ্র বসুর চোখে নদিয়ার এই ছোট্ট গ্রামটা ছিল শুধু আরেকটা বিনিয়োগের জায়গা, অথচ আজ যখন সে ভাঙা রাস্তা পেরিয়ে পুরনো তাঁতকলের সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন তার বুকের ভেতর যেন কিছু একটা গুমরে ওঠে। শহরের কোলাহল, ব্যস্ত কর্পোরেট দুনিয়া আর অবিরাম ডেডলাইনের জীবন থেকে বেরিয়ে রুদ্র এবার নিজের মতো করে কিছু শুরু করতে চায়—নিজের তৈরি কিছু, নিজের সিদ্ধান্তে। তাই তো সে কিনে নিয়েছে এই বহু বছর ধরে বন্ধ পড়ে থাকা, ধুলো-জমা এক তাঁতকল, যেটার ইটের গায়ে এখনও পুরোনো মসৃণতা আর গুমোট ঘামের গন্ধ লেগে আছে। কলের কেয়ারটেকার, বৃদ্ধ মদন, তাকে চাবি তুলে দেয় এক কথাও না বলে—শুধু একবার…
-
প্রিয়ম সরকার কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তের নামকরা এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুল—সাউথ সিটি মডার্ন হাই—সেই শুক্রবার দুপুরে যেন কিছুক্ষণ নিঃশব্দ হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় পিরিয়ডের গণিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর হঠাৎই হইচই শুরু হয়, যখন ছাত্রী রুদ্রানী ঘোষের দেহ পাওয়া যায় পুরনো লাইব্রেরির সিঁড়ির পাশে পড়ে থাকতে। তার চোখদুটি খোলা, ঠোঁট রক্তাক্ত, আর পাশে ছড়িয়ে আছে তার জ্যামিতি বক্স—যেন কোনও শেষ মুহূর্তের আঁচড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সব। হেডমাস্টার বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন—“আত্মহত্যা, ক্লাসের চাপ নিতে পারেনি,” এবং পুলিশকে ফোন করলেও মৃদু স্বরে অনুরোধ করেন বিষয়টি মিডিয়াতে না পৌঁছাতে। ছাত্রছাত্রীরা কাঁদছে, শিক্ষিকারা অস্বস্তিতে—কিন্তু একজন শিক্ষক, অভিজিৎ সেন, ওই সময় কিছু না বলেই ধীরে ধীরে…
-
ঋজু ভট্টাচার্য ১ কলকাতার আকাশটা সকাল থেকেই মেঘলা ছিল। শহরের কনস্ট্যান্ট কোলাহলের মাঝেও যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল কোর্ট স্ট্রিটের চত্বর জুড়ে। আইনজীবীদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা, কিছুটা উদ্বেগও, কারণ শহরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিমিনাল ল’ এক্সপার্ট বরণ ঘোষাল আজও কোর্টে আসেননি। এই নিয়ে সাত দিন হয়ে গেল তিনি নিখোঁজ। প্রথম দু’দিন ভেবেছিল সবাই হয়তো কোনো প্রফেশনাল ট্রিপে গেছেন, তৃতীয় দিনে একাধিক কেসের শুনানি বাতিল হওয়ায় শুরু হয়েছিল গুঞ্জন, এবং সপ্তম দিনে এসে পুরো শহরটা যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। মিডিয়া জ্বলজ্বল করছে ‘সেলিব্রিটি লইয়ার নিখোঁজ’ শিরোনামে। পুলিশ অফিশিয়ালি এখনও “মিসিং পারসন” কেস ফাইল করলেও, তদন্তে নামানো হয়েছে দুই কনস্টেবল, একটি গোয়েন্দা…
-
১ বৃষ্টির রাত। এমন এক বৃষ্টি, যা যেন শুধু রাতের নীরবতা চুরমার করে দিতে আসে। সরলা দেবী জানালার পাশে বসে পুরনো কাঠের দোলনায় আস্তে আস্তে দুলছেন। তাঁর সামনে ছোট টেবিলে রাখা একটি মাটির প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছে, এবং তার পাশে রাখা একটি ফ্রেম করা ছবি—অমিতের, তাঁর একমাত্র ছেলে, যিনি গত তিন বছর আগের এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এখনো সেই দিনটার কথা ভাবলে সরলার বুকের মধ্যে একধরনের ঠান্ডা ঢেউ খেলে যায়। ছেলের শেষ জন্মদিনের সময় তোলা ছবি—চোখে হাসি, মুখে আত্মবিশ্বাস, যেন বলছে, “মা, আমি আছি তো!” অথচ সেই হাসির পেছনে কি লুকিয়ে ছিল কোনো গোপন কথা? কিছুদিন ধরে সরলার মনে…