সুদীপ্তা কর ১ সরকার পরিবার বহু পুরোনো। শহরতলির শেষপ্রান্তে, ক্যানেলের ধারে মোটা পাঁচিলে ঘেরা প্রাসাদসদৃশ এক বাড়ি—যার কাঠের দরজার ওপর এখনও খোদাই করে লেখা আছে ‘সরকার ভিলা, ১৯২৩’। প্রবোধ সরকার এখানে জন্মেছিলেন, তাঁর বাবা-মারও জন্ম এই বাড়িতেই। সময় বদলেছে, কিন্তু বাড়ির চালচিত্র, লোহার রেলিং, কাঠের মেঝে—সবই থেকে গেছে ঠিক তেমনি। বিয়ের দিনটা ছিল মাঘের মাঝামাঝি—হালকা শীত, শিউলির শেষ গন্ধ, আর বাড়ি ভরা আলো। বিয়ের কোলাহলের মধ্যে শ্রেয়া এসে পা রাখল এই পুরনো সংসারে, লাল বেনারসীতে ঢাকা মুখে একরাশ লাজ লুকিয়ে। মীনাক্ষী দেবী, নতুন বৌমাকে দেখে অদ্ভুত একটা প্রশান্তি অনুভব করলেন—মেয়েটা যেন একদম শান্ত, পরিণত, গম্ভীর। সে কম কথা বলে, হাসে…
-
-
তনুশ্রী রায় এক রোজকার মতো সকালটা শুরু হয় একঘেয়ে নিয়মে—চা, শাড়ির আঁচল গুঁজে নেওয়া, আর বাড়ির সদর দরজাটা হালকা শব্দে টেনে বন্ধ করা। শহরের কিনারে পুরোনো একটি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষপ্রাচীন ডাকঘরটি যেন সময়কে আটকে রেখেছে নিজের দেওয়ালে। দুলালী ঘোষ, যাকে শহরের সকলে ‘দিদি’ বলে জানে, প্রতিদিন সকাল সাড়ে ন’টায় এসে সেই সাদা-লাল রঙের গেট ঠেলে ভেতরে ঢোকে। দেওয়ালে ঝোলানো পিতলের ঘড়িটা তার আগমনের সাক্ষী হয়ে থাকে, তার চলার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে চুপচাপ টিক টিক করে। খোলা জানালার ফাঁকে মৃদু আলো ঢোকে, আর তাতে ধুলোর কণাগুলি বাতাসে ভাসে যেন স্মৃতির মতো। দুলালী টেবিলে রাখা তার কাঠের বক্স খোলে, যেখানে…
-
হিমাদ্রি মুখার্জী ১ দক্ষিণ কলকাতার ‘উজ্জ্বল আলয়’ হাউজিং কমপ্লেক্সের সকালটা ছিল একেবারে সাধারণ। দুধওয়ালা এসে গেটের বাইরে হাঁক দিলো, মুন্না ওয়াচম্যান ঝিমোতে ঝিমোতে ঘাড় তুলে চাবি দিলো, আর বাচ্চারা স্কুলবাস ধরতে দৌড়োতে লাগল। নবদম্পতি তুহিন আর বুবলি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কফি খেতে খেতে নিজেদের ইউটিউব ভিডিওর থাম্বনেইল নিয়ে আলোচনা করছিল, ঠিক তখনই বুবলি ফিসফিস করে বলল, “তুমি লক্ষ করেছো, ৪০৩ ফ্ল্যাটের জানালাটা কাল রাত থেকে বন্ধই আছে। আজ সকালেও কেউ বেরোলো না!” তুহিন কপাল কুঁচকে বলল, “অ্যাই, ঠিক বলেছো তো! বিমলবাবু তো রোজ সকাল সাতটায় হাঁটতে বেরোন, আর অঙ্কুর গলা ফাটিয়ে গেম খেলে—আজ একটাও শব্দ নেই!” সন্দেহজনকভাবে তারা দুজনে দোতলায় উঠে…
-
নির্মাল্য সেনগুপ্ত এক পাথুরে পাহাড়, দূরের শাল-পলাশের বন আর উষার কুয়াশায় মোড়ানো পথ ধরে যখন অভিজিৎ আর রোহনের জিপটা ঢুকছিল পুরুলিয়ার নিসর্গপুরে, তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর প্রায়। ঝিরঝিরে হাওয়ায় পাতা কাঁপছিল, গাছের ছায়া রাস্তার উপর ভেসে বেড়াচ্ছিল নিরবে। অভিজিৎ জানালা দিয়ে মাথা বের করে ভিডিও করছিল, ক্যামেরার সামনে হাসি ঝলমল করে বলছিল, “ওয়েলকাম টু দ্য আনচার্টেড, বন্ধুরা! আজ আমরা এসেছি পশ্চিমবঙ্গের এক রহস্যময় গ্রামে, যার নাম নিসর্গপুর। এখানে প্রতি পূর্ণিমায় পাহাড় থেকে শোনা যায় রুদ্রতাণ্ডবের ধ্বনি, আর বলে হয়, শত বছর আগে এখানে এক নীলকণ্ঠ সন্ন্যাসী ধ্যানমগ্ন হয়েছিলেন… কেউ তাঁর ধ্যানভঙ্গ করলে আর ফিরতে পারে না। সত্যি? না গুজব? চলুন,…
-
তথাগত সান্যাল অধ্যায় ১: ডামরুর প্রথম ধ্বনি শিবরাত্রির রাত। হিমছোঁয়া বাতাসে ভেসে আসছে ধূপধুনোর গন্ধ, শালবনের ফাঁকে পূর্ণিমার চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে মাটি ছুঁয়ে। উত্তর ত্রিপুরার অরণ্যঘেরা গুহামন্দিরে দাঁড়িয়ে ঋভু রায়চৌধুরী অনুভব করলেন—এ কেবল একটি সাধারন রাত্রি নয়। দিনদুয়েক আগেই কলকাতা থেকে আসার সময় লোকাল ড্রাইভার বলে দিয়েছিল, “এই মন্দিরে আজও কিছু ঘটে… বিশেষ করে শিবরাত্রির রাতে।” ঋভু প্রথমে হেসেছিলেন। তবে সেই হাসি চাপা পড়ে গেল, যখন তিনি ওই গুহার সামনে পৌঁছে এক ছায়াময় বৃদ্ধকে বসে থাকতে দেখলেন—দাঁতহীন মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি, গায়ে জটাধারী চেহারা, আর হাতে ছিল একটি পুরনো কাঠের বাক্স। বৃদ্ধ কোনও কথা না বলে কেবল ইশারায় বাক্সটি ঋভুর…
-
অর্কপ্রভ পাল ঘন দুপুরের কলকাতা—হাওড়া ব্রিজের নিচ দিয়ে গঙ্গার জল পাগলের মতো ধাক্কা খাচ্ছে পিলারের গায়ে, আর শহরের বাতাসে যেন কোনো অদৃশ্য অস্থিরতা জমাট বেঁধে আছে। সরকারি দপ্তরে কেউ মুখ ফুটে বলছে না, কিন্তু মন্ত্রকের চত্বরে চায়ের দোকানগুলোর গুঞ্জন বলে দিচ্ছে—কিছু একটা হতে চলেছে। সায়নী বসু প্রেসক্লাবে বসে ল্যাপটপে শেষ লাইনটা টাইপ করছিল: “এই শহরে আমরা শুধু নজরে নই, আমরা এখন কানের ভিতরেও।” সে জানে, আজ রাতটা গুরুত্বপূর্ণ। সে জানে, তার রিপোর্ট প্রকাশ পেলে বড় ঝড় উঠবে। একই সময়, শহরের উত্তর দিকে নিজের ঘরের জানালা দিয়ে অর্ক মুখার্জী দেখছিল তার ডিজাইন করা ইন্টেলিজেন্ট সিটির মানচিত্র—আলোকিত রাস্তার প্রান্তে লুকিয়ে থাকা নিঃশব্দ…
-
অসিত চক্রবর্তী ১ সকালের আলো জানালার পর্দা ছুঁয়ে যখন ঘরে ঢুকল, তখন ঘুম ভাঙল রিমা দাশের। মাথাটা ভার লাগছিল, ঠিক যেন সারারাত ঘুম হয়নি। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা বলছে সে ন’ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আচমকা সে বুঝতে পারল—কিছু একটা নেই। কিছু একটা অদৃশ্য, অথচ খুব জরুরি। সেই অনুভূতিটা একেবারে হাড়ে হাড়ে টের পেল। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখের দিকে তাকাল—চোখের নিচে হালকা কালো ছাপ, ঠোঁট শুকনো, কিন্তু তার চেয়ে বেশি যেটা ভাবাচ্ছিল তা হলো এক রকম ভেতরের খালি জায়গা। তার মাথার ভিতর একটা চিত্রকল্প বারবার ঘুরে ফিরে আসছিল—কোনো পুরনো কথা, কারও মুখ, অথবা একটা হাসি—যা এখন আর সে…
-
অর্ক ভট্ট ১ পদ্মার কোলঘেঁষে ছায়াঘেরা এক গ্রাম, যেখানে সকাল শুরু হয় কাকডাকা ভোরে আর শেষ হয় নদীর ঢেউয়ের নিঃশব্দ হাহাকারে। ঠিক সেই জায়গাটায় পৌঁছাল মেঘা সেন, শহরের এক ডকুমেন্টারি নির্মাতা, যাকে নিয়ে এসেছে তার নিজস্ব কৌতূহল—নদী, তার মানুষ আর তাদের জীবনগাথা। লাল মাটি, ভাঙাচোরা কাঁচা রাস্তা, কাদা-মাখা পায়ের ছাপ পেরিয়ে মেঘ দাঁড়ায় নদীর ঘাটে। কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরা, পরনে হালকা তুলো কাপড়ের সালোয়ার, চোখে একরাশ আগ্রহ আর মুখে একরাশ ক্লান্তি। তার চোখ প্রথমেই আটকে যায় এক মাঝির ওপর, যার গায়ের রং ঠিক নদীর পলির মতো ধূসর, যার নৌকা যেন নদীর বুকে গড়িয়ে চলা এক অভ্যস্ত ছায়া। সে জলে দাঁড়িয়ে জাল…
-
নিলয় মিত্র অধ্যায় ১ সাহিত্যিক সৌম্য মিত্রের নিথর দেহটি পড়েছিল তার উত্তর কলকাতার দোতলা বাড়ির লেখার ঘরে, জানালার পর্দা অর্ধেক সরানো, বাইরের ঝিরঝিরে বৃষ্টির আলো গালচে করে রেখেছে কাঁচের ওপর। ছোট একটি কাঠের টেবিলে ছড়িয়ে থাকা কাগজগুলো ছিল সযত্নে বাঁধা একটি পাণ্ডুলিপি, নামহীন, কেবল প্রতিটি পাতার নিচে লাল কালি দিয়ে স্পষ্টভাবে লেখা — “এটা আমার লেখা নয়।” তার ডান হাতে শক্ত করে ধরা একটি পার্কার কলম, পাশে পড়ে থাকা আধখোলা পেন্সিল বক্স, আর ঘরের কোণে নিঃশব্দে জ্বলছিল একটি কুয়াশামাখা টেবিল ল্যাম্প। পুলিশের প্রাথমিক রিপোর্ট বলেছে—আত্মহত্যা। ঘুমের বড়ি ও হুইস্কির সম্মিলিত প্রভাবে মৃত্যু হয়েছে সম্ভবত রাত আড়াইটার সময়। কিন্তু বাড়ির কাজের…
-
জয়দীপ বিশ্বাস এক হ্যারিসন রোডের পশ্চিম প্রান্তে, রাস্তাঘেঁষে ছায়ায় ঢাকা এক পুরনো, প্রায় ভাঙা-ভাঙা বাড়ি—যার কাঁচ ভাঙা জানালার ওপারে আজও পড়ে আছে কিছু পুরনো পর্দা, ছেঁড়া পোস্টার, আর থিয়েটারের ধুলো ধরা আসবাব। শহরের ব্যস্ততা আর উজ্জ্বল আলো থেকে দূরে এই অব্যবহৃত অপেরা হলটা গত কুড়ি বছর ধরে সময়ের স্তব্ধতায় নিজেকে মুড়ে রেখেছে। নাম—“অ্যালিগ্রো থিয়েটার”। একসময় কলকাতার থিয়েটারপাড়ার গর্ব ছিল এই অপেরা হল, যেখানে যুগের পর যুগ বাঙালি অপেরার জন্ম হয়েছে—পিয়ানো, কর্ড, ভায়োলিন আর দোতারা মিলেমিশে সুরের এক আদি-আধুনিক কাব্য রচনা করেছিল এখানে। কিন্তু সেই অপেরা একদিন হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়—কারণ, যা কারও কাছে স্পষ্ট নয়। কেউ বলে আগুন লেগেছিল…