অদ্রিজ লাহিড়ী ১ নতুন বছরের প্রথম সকালটা যেন অলিখিত এক দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে এল জলপাইগুড়ির ছোট্ট শহরতলি এলাকায়। চারদিকে কুয়াশার ঘন চাদরে ঢাকা, গাছের পাতা থেকে জলের ফোঁটা টুপটাপ পড়ছে, আর দূরে কোথাও একটি কাঠঠোকরার ডাক শোনা যাচ্ছে। সকাল ছ’টার সময় বাজারে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়েছিলেন তুষার দে’র কাকা, সুশোভন দে। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। প্রথমে তুষার ভেবেছিল, হয়তো কাকা পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে চলে গেছেন, কিংবা ফোনের ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেগ ঘনিয়ে আসে। কাকার মোবাইল বন্ধ, বাজারের দোকানিরা বলে, তাঁরা তাঁকে দেখেইনি। আশেপাশে খোঁজ করতে গিয়ে মা একসময় বললেন, “আবার কী ১…
-
-
দীপঙ্কর মাহাতো পুরুলিয়ার দক্ষিণ প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামটিতে ঢোকার পথটাই যেন শহরজীবনের ব্যস্ততা থেকে এক অলক্ষ্য ছেঁটে ফেলা। ঝাউগাছ, শাল, পিয়াল আর মহুয়ার সারি সারি গাছের ফাঁকে রাস্তা বেঁকে গেছে পাহাড়ের বুক চিরে। মে মাসের শুকনো রোদ আর ধুলোভরা বাতাসের মধ্যেও সেখানে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল, যেন প্রকৃতি নিজেই শব্দ চেপে বসে আছে। এমনই নিঃসঙ্গ, প্রায় বিস্মৃতপ্রায় এই জায়গাতেই নিজের শেষ জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ডা. অনিরুদ্ধ গুহ। কলকাতার এক খ্যাতনামা হাসপাতালে চব্বিশ বছর ধরে সার্জারি বিভাগের প্রধান ছিলেন তিনি, সহকর্মী আর ছাত্রছাত্রীদের কাছে ছিলেন এক কঠোর অথচ নীতিনিষ্ঠ পথপ্রদর্শক। তবে সময়ের নিয়মে অবসরের দিন ঘনিয়ে এলে…
-
১ বৃষ্টির রাত। এমন এক বৃষ্টি, যা যেন শুধু রাতের নীরবতা চুরমার করে দিতে আসে। সরলা দেবী জানালার পাশে বসে পুরনো কাঠের দোলনায় আস্তে আস্তে দুলছেন। তাঁর সামনে ছোট টেবিলে রাখা একটি মাটির প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছে, এবং তার পাশে রাখা একটি ফ্রেম করা ছবি—অমিতের, তাঁর একমাত্র ছেলে, যিনি গত তিন বছর আগের এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এখনো সেই দিনটার কথা ভাবলে সরলার বুকের মধ্যে একধরনের ঠান্ডা ঢেউ খেলে যায়। ছেলের শেষ জন্মদিনের সময় তোলা ছবি—চোখে হাসি, মুখে আত্মবিশ্বাস, যেন বলছে, “মা, আমি আছি তো!” অথচ সেই হাসির পেছনে কি লুকিয়ে ছিল কোনো গোপন কথা? কিছুদিন ধরে সরলার মনে…
-
প্রতুল মন্ডল ১ নভেম্বরের হিমেল সকাল। শিয়ালদহ থেকে ছুটে আসা দার্জিলিং মেল ধীরে ধীরে পাহাড়ের কোলে ঢুকছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকা ঋত্বিক চৌধুরীর চোখে ছিল গভীর এক কৌতূহল—একটা অদ্ভুত টান। অভিষেক তার সঙ্গী, যার চোখে-মুখে রোমাঞ্চের ঝলক থাকলেও সে ছিল মূলত ছুটি কাটাতে এসেছে, হিমালয়ের শান্তি আর কিছু ইনস্টাগ্রাম-যোগ্য ছবি তুলতে। ওরা দুজনেই কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়েছে কাজের ক্লান্তি ঝেড়ে একটু প্রকৃতির কাছে যেতে, কিন্তু ঋত্বিক জানে, এই ভ্রমণ শুধু অবকাশ নয়। গত ছ’মাসে তার হাতে কোনও ‘কেস’ আসেনি, অথচ এই পাহাড়ি গ্রাম ‘চান্দাক’-এর আশেপাশে কয়েকজন পর্যটক হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার খবর এক অখ্যাত অনলাইন ব্লগে পড়ে সে স্থির করে,…
-
সুতপা মল্লিক কলকাতার উত্তরের এক পুরনো বনেদি বাড়ির ভেতর দুপুরটা যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল। ছাদের ওপর চড়া রোদ, নিচের দোতলা বাড়ির অন্দরে নিঃশব্দের এক গহ্বর। ব্রতী সেন জানলার ধারে বসে ছিল, পাশের ঘরে টিকটিকির ডাকে একটানা সময় যেন আটকে পড়েছিল। দুপুরের খাবার, থালা বাসনের শব্দ, শাশুড়ির নিয়মিত বকুনি—সবই সেদিনের মতো সেরে ফেলা হয়েছে। অরিন্দম অফিসে, শাশুড়ি ঘুমোচ্ছেন, আর এই সময়টুকু তার—সে জানে, এই এক-দেড় ঘণ্টা সে তার মতো করে বাঁচতে পারে। কিন্তু কীভাবে বাঁচে, তা সে নিজেই জানে না। তার পছন্দের খাতা, একটা পুরনো পেন আর সেই শাদা পৃষ্ঠা—যেখানে সে শব্দে শব্দে নিজের নিঃশব্দ চিৎকারগুলো গেঁথে রাখে। কেউ জানে না, কেউ…
-
পৌলমী দে ১ শীতকাল তার নিঃশব্দ পায়ে গ্রামের উঠোনে নেমে এসেছে বেশ কিছুদিন হল। মাঠের ঘাসে জমে থাকা শিশিরের ওপর দিয়ে হাঁটলে পায়ের শব্দ হয় না, কিন্তু শীতে মোড়া সেই স্তব্ধতায় সায়ন্তী প্রতিদিন একটা পরিচিত শব্দের অপেক্ষা করে থাকে—স্কুলঘরের প্রথম ঘণ্টা বাজা। সে দিনের শুরুটা হয় ঘুম ভাঙা মায়ের কাশির আওয়াজে, চায়ের কাপ গুনে ফেরা সংসারে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মাথায় উলের চাদর জড়ানো, ব্যাগে খাতা বইয়ের ভার; বাকি সব দিনের মতোই যেন। কিন্তু আজকের সকালে কুয়াশাটা একটু বেশি জমাট, আর হাওয়াটা যেন অতীতের গন্ধ নিয়ে আসে। গলির ধারে সেই পুরনো দোতলা বাড়িটা, যেটায় একসময় খেলাধুলা চলত, কাঁঠাল গাছের ডালে…
-
মৈনাক ভৌমিক ১ পুরুলিয়ার চন্দনবন — নামটি আজও অনেকের কাছে অজানা, যদিও লোকমুখে ছড়িয়ে থাকা বহু গল্পের কেন্দ্রবিন্দু এই অরণ্য। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তঘেঁষা এই অঞ্চলটি আদিবাসী জনপদের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা ঘন জঙ্গলে ভরপুর, যেখানে আজও সূর্যাস্তের পর কেউ একা পথ মাড়ায় না। অথচ সেখানেই, এক শতাব্দী পুরনো ব্রিটিশ জরিপ মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া এক দাগচিহ্ন—“K.T. Akhra (Abandoned)”—ডঃ ঋত্বিক বসুর চোখে পড়ে। বহুদিন ধরে প্রাচীন ভারতীয় তন্ত্রচর্চা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসা এই প্রত্নতত্ত্ববিদ তার টিম নিয়ে রওনা দেন চন্দনবনের উদ্দেশ্যে। তাঁর দলের সঙ্গে ছিলেন ইতিহাসের গবেষক ইরা সেনগুপ্ত, ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর অভীক মণ্ডল, তথ্যলিপিকার তৃষা দে এবং স্থানীয় গাইড হিসেবে নিযুক্ত হন নিতাই মাহাতো,…
-
অর্ণা মুখার্জী ১ সায়নী বসু দক্ষিণ কলকাতার মফস্বলি এলাকায় দাঁড়িয়ে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে ছিল একটি পরিত্যক্ত বাসস্ট্যান্ডের দিকে। নতুন প্রজেক্টের কাজে তাকে পাঠানো হয়েছিল এই অঞ্চলের একটি পুরনো জমি পরিদর্শনের জন্য, যেখানে একটা কমিউনিটি সেন্টার তৈরির পরিকল্পনা আছে। কিন্তু সেই জমির পাশেই পড়ে থাকা পুরনো বাসস্ট্যান্ডটি তার দৃষ্টি আটকে দেয়। নীল রং উঠে যাওয়া টিনের ছাউনি, ভাঙাচোরা কংক্রিটের বেঞ্চ, আর বৃষ্টির জল জমে থাকা ময়লা গর্ত — দেখলে মনে হতো এই জায়গায় কোনো স্বপ্নের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা এক ঝাঁক বাচ্চা ছেলেমেয়ে, কেউ বোতল কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে, কেউ চায়ের কাপে জল খাচ্ছে, কেউবা টায়ারের টুকরো নিয়ে খেলছে — ওদের…
-
শুভময় দত্ত গভীর রাতে শহরের অন্ধকার অলিগলি নিঃস্তব্ধ, কিন্তু শহরতলির এক গোপন বায়োটেক ল্যাবরেটরিতে তখন প্রবল আলো জ্বলছে। ডঃ প্রণব সেনের চোখজোড়া ক্লান্ত, কিন্তু সেই ক্লান্তির মাঝে এক অদ্ভুত উন্মাদনা লুকিয়ে আছে। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন কাঁচঘেরা এক জীবাণুমুক্ত ঘরের সামনে, যেখানে একটি নগ্ন দেহ চুপচাপ ঘুমিয়ে আছে একটি স্বচ্ছ কাচের ক্যাপসুলের ভিতরে। তার গায়ের ত্বকে কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক ট্যাগ লেখা—K-7। চোখদুটো বন্ধ, নিঃশ্বাস চলমান, যেন কোনো সদ্যজাত শিশু ঘুমিয়ে আছে নিঃচিন্তে। প্রণব ধীরে ধীরে ক্যাপসুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, তার কণ্ঠে হালকা ফিসফিসে স্বর, “তুমি এসেছো…অবশেষে।” এই মুহূর্তটির জন্য তিনি অপেক্ষা করছিলেন গত সাত বছর ধরে—হাড়ভাঙা পরিশ্রম, নৈতিক সংকট, গবেষণার গোপনতা, এবং…
-
সৌমিক ভট্টাচার্য ১ পাহাড়ি রাস্তাগুলো যেন কোনও অজানা গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল অভিজিৎ সেনগুপ্তকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের গবেষক, লোকবিশ্বাস এবং পাহাড়ি সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘদিনের আগ্রহ ছিল তার। একটি গবেষণা প্রকল্পের সূত্রে সে এবার রওনা দিয়েছিল উত্তরবঙ্গের এক অদ্ভুত দূরবর্তী গ্রামে—সিংরিপাহাড়। ট্রেন থেকে নামার পর পায়ে হেঁটে, জিপে চড়ে, শেষমেশ খচ্চর পিঠে চেপে পৌঁছাতে হয়েছিল তাকে সেই দুর্গম স্থানে। পাহাড়গুলো যেন দাঁড়িয়ে ছিল এক অভেদ্য প্রাচীর হয়ে—মানুষের সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন, অথচ নিজেদের মতো করে সাজানো এক অলৌকিক গ্রাম। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অবস্থিত ছোট্ট গ্রামটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ল ছায়াঘেরা গাছপালা, পাথরের বাড়ি, আর সন্ধ্যার আগেই বন্ধ হয়ে আসা কুড়িটি দরজা-জানালা। অভিজিৎ…