ঐশানী সেন পর্ব ১: দাসীর যাত্রা শুরু আরাকানের ছোট্ট এক উপকূলগ্রাম। চারদিকে পাহাড় আর সমুদ্রের মিলন, নারকেল গাছের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকে কুটির। সেই গ্রামেই বাস করত কিশোরী মেয়ে মায়ারী। বয়স মাত্র ষোলো, চোখদুটো ঝকঝকে কালো, কপালে যেন সর্বদা একটা অবুঝ কৌতূহলের রেখা। মায়ারী ছিল মৎস্যজীবীর মেয়ে। প্রতিদিন সকালবেলা বাবার সঙ্গে সাগরে মাছ ধরতে যেত, মা ঝুড়ি বুনত আর ছোট ভাইটির যত্ন নিত। গ্রামজীবন ছিল সরল, অথচ সাগরের অনিশ্চয়তা সর্বদা তাদের বুকে ভয় জাগিয়ে রাখত। সেই ভয়াবহ রাতটা আজও গ্রামের লোকেরা ভুলতে পারেনি। দূর সমুদ্র থেকে হঠাৎ কিছু অচেনা পালতোলা জাহাজ এসে ভেড়ে। ওরা ছিল পর্তুগিজ দাসব্যবসায়ী। আগুন লাগানো হয়…
- 
				
 - 
				
আত্মদীপা সেন পর্ব ১ – আগমন শীতের শেষ দিকের হাওয়া নামছিল পাহাড় থেকে। সন্ধেবেলা দার্জিলিংয়ের ধারে মেঘলা সেন ছোট্ট একটা লোকাল বাসে চেপে নামল জনশূন্য রাস্তায়। চারদিক জুড়ে তখন কুয়াশার ধোঁয়া, যেন পাহাড়টা নিজের বুকের ভেতর পৃথিবীকে গিলে নিতে চাইছে। তার হাতে একটা পুরনো নোটবুক, ভেতরে টুকে রাখা এক রহস্যময় ঠিকানা—“শেষ গ্রন্থাগার, রংটং পাহাড়তলি।” মেঘলা কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। তার থিসিস ছিল প্রাচীন বই নিয়ে—কাগজের গন্ধ, ছাপার দাগ, মানুষের হাতের ছোঁয়া। অথচ এই পৃথিবীতে এখন বই বলতে বোঝানো হয় কেবল স্ক্রিনের আলো। সব দেশ, সব সরকার, সবকিছু ডিজিটাল আর্কাইভে সরিয়ে নিয়েছে। কাগজের বই নিষিদ্ধ না হলেও, বিলুপ্তির পথে ঠেলে দেওয়া…
 - 
				
অর্কদীপ সেন পর্ব ১ : আগুনের পুঁথি রুদ্রর বয়স তখন সাতাশ। কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানে তার গবেষণা শেষ পর্যায়ে। তার বিষয়—বাংলার লোকবিশ্বাস, ভূতপ্রেত, তন্ত্রমন্ত্র আর আচার। এই শহরে যাদের কাছে তন্ত্র কেবল এক অদ্ভুত ভয়ের প্রতীক, তাদের চোখে রুদ্র ছিল খানিকটা অদ্ভুতুড়ে। সে পুরোনো গ্রন্থাগারে বসে দিনের পর দিন প্রাচীন পুঁথি ঘাঁটতে ভালোবাসত, রাতে ঘরে ফিরে নিজের নোটবইয়ে লিখে রাখত অদ্ভুত সব ছেঁড়া ছেঁড়া তথ্য—যেন একটি ভাঙা আয়নার টুকরো একত্র করছে, কিন্তু আয়নার প্রতিফলন এখনও দেখা যায়নি। এক বিকেলে, গরমের ধুলোয় ভরা মে মাসে, রুদ্র যায় নীলরতন লাইব্রেরির আর্কাইভ বিভাগে। আর্কাইভের ভেতর ঢুকলেই ম্লান আলোয় অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে থাকে—পুরোনো কাগজ,…
 - 
				
তনিমা বসাক পর্ব ১: অজ্ঞাত সংলাপ কলকাতার গ্রীষ্মের বিকেল যখন কাচে ধাক্কা মারে, মনের ভেতরের অতীত-বর্তমানও তখন এক অদ্ভুত তাপমাত্রায় কাঁপে। ড. অরণ্য সেন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বাইরের ঝিম ধরা রোদ আর ঘামচাপা শহরের ভাঁজে ভাঁজে যতসব অদেখা গল্প জমা হচ্ছে, তার দিকে তাকিয়ে। তাঁর চেম্বারটি শহরের দক্ষিণে, বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছাকাছি, চতুর্থ তলায়, চুনে ধরা দেওয়ালের পাশ দিয়ে নেমে যাওয়া বিবর্ণ সিঁড়ির শেষ প্রান্তে এক প্রাইভেট চেম্বার। এইখানেই তিনি মানুষের মন পড়েন—যেমন দারোয়ান পড়ে কাগজে মোড়া চা, কিংবা বইয়ের দোকানের ছেলে পড়ে পৃষ্ঠার ভাঁজ। আজ তাঁর টেবিলের সামনে বসে রয়েছে এক অদ্ভুত মেয়ে—নিপা বসু। চোখে সুরের মতো নরম অস্থিরতা,…
 - 
				
মালবিকা সেনগুপ্ত ঢাকার ধুলো-ধোঁয়া আর ট্র্যাফিকের চক্রব্যূহ পেরিয়ে যখন জয়িতা নামল মেঘনাঘাটের ছোট্ট ফেরিঘাটে, তখন সূর্য মাথার উপর একচিলতে আগুন হয়ে দাঁড়িয়ে। চারপাশে জনমানবশূন্য প্রান্তর, দুটো হেমন্তের কাক আর কয়েকটা শুকনো পাতার ঝটপট আওয়াজ ছাড়া অন্য কোনও শব্দ নেই। ঠিক এইখানেই সে শুট করবে তার নতুন ট্র্যাভেল ভ্লগ: “Unfiltered Bengal”-এর এক বিশেষ পর্ব। “মোবাইল ডেটা কাজ করছে না? নো টাওয়ার?” – ক্যামেরাম্যান শান্তু মাথা চুলকে বলল। জয়িতা মাথা নাড়ল। ও জানত এই চর অঞ্চলে ঢুকলেই নেটওয়ার্ক ঘুমিয়ে যায়, মানুষের শব্দের চেয়ে নদীর শব্দ বেশি জোরালো হয়। “চর বলরামপুর”, গুগল ম্যাপে মাত্র একটা বিন্দু। কিন্তু সেই বিন্দুর মধ্যে যেন সারা…
 - 
				
ঋদ্ধিমান চক্রবর্তী পর্ব ১: চিঠির খামে কাঞ্চনজঙ্ঘা পুজোর ঠিক আগের দিন সকালে মিঠির চিঠিখানা হাতে আসে—একটা পুরোনো বাদামি খামে, অদ্ভুত সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা ‘মিতালী সেন’ নামটা ঠিক তার ছেলেবেলার ডাকনামের পাশে। তবে এই ডাকনামটা আজ বহু বছর কেউ ডাকে না, এমনকি নিজের কাছেও মিঠি অনেককাল হয়ে গেছে মিসেস মিতালী বসু। কিন্তু চিঠিটা খুলতেই মনে হল, সময় যেন উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করেছে। প্রেরক: প্রমথেশ চৌধুরী। ঠিকানা: সেন ভিলা, হিলকার্ট রোড, দার্জিলিং। তারিখ: ১৯৮৬। মিঠি শিউরে উঠেছিল। ১৯৮৬? তা হলে এই চিঠিটা এখন তার হাতে পৌঁছেছে ৩৯ বছর পরে? চিঠির ভাঁজে আরও ছিল একটি ছোট স্কেচ—হাতের আঁকা, পেনসিলে আঁকা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া, এক…
 - 
				
সন্দীপন ধর খামে মোড়া নীরবতা রমেশচন্দ্র বসু বসে আছেন জানালার ধারে রাখা সেই পুরনো বেতের চেয়ারে। জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া বিকেলের আলো তার রুপোলি চুলে খেলে যাচ্ছে। মাথার ঠিক পাশেই একটা ছোট কাঠের তাক, সেখানে রাখা তার স্ত্রীর একটা ছবি — মেঘলা শাড়ি, মৃদু হাসি, কপালে ছোট্ট টিপ। নাম ছিল তার — কাবেরী। আজ অনেকদিন পর আবার পোস্টম্যান এসেছিল। লাল-হলুদ ইউনিফর্ম, কাঁধে ব্যাগ। সে বলল, “বসুবাবু, আপনার পেনশনের শেষ চেকটা এসেছে।” রমেশচন্দ্র ধীরে হাত বাড়িয়ে খামটা নিলেন। যেন মৃদু এক স্নেহে ছুঁলেন। এই খামে শুধু টাকা নেই, আছে একটা দীর্ঘ জীবনের সমাপ্তি ঘোষণা। অফিসের শেষ বেতন মাসেরও বেশি…
 - 
				
সোমশুভ্র লাহিড়ী “এইবার নামো রে, শেষ চিৎকারটুকু রাখ, মাইক-ফাইক ভাঙিস না,” — পেছন থেকে ডাকল তপন, যাত্রাদলের আলো-ধরা ছেলে। শম্ভুদা হাত তুলে বললেন, “এই শেষবার, তপন, আরেকটা ডায়লগ বলি।” মঞ্চে দাঁড়িয়ে শম্ভু সেন, বয়স বাহাত্তর, কাঁপা গলায় বললেন— “জীবনটাই একটা যাত্রা, কিন্তু থিয়েটারটা? ওটা আত্মার আয়না!” চারদিক নিস্তব্ধ। দর্শক বলতে গুটিকয়েক লোক, সবাই চেয়ারে হেলান দিয়ে আছে। কেউ মোবাইলে, কেউ ঝিমুচ্ছে। কেউ আবার পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলছে, “ওই বুড়োটা এখনও মরে না কেন?” শম্ভুদা নামলেন মঞ্চ থেকে, হাঁটুর ব্যথায় কুঁজো হয়ে পড়েছেন। কিন্তু চোখে একরকম দীপ্তি। যেন কোনও জয় এসেছে। তপন বলল, “আর কতদিন এইরকম চলবে, দাদা?” “ততদিন চলবে,…
 - 
				
অর্ঘ্য দত্ত অধ্যায় ১: অজানা উত্তরাধিকার তীর্থর জীবনের সেই দিনটি যেন অন্য সব দিনের মতোই শুরু হয়েছিল, অথচ শেষ হয়েছিল এমন এক ঘটনার মধ্যে যা তার ভাবনার সীমার অনেক বাইরে। সকালে কলেজের ক্লাস শেষ করে বিকেলে বাড়ি ফিরতেই কাকা এসে বলল, দাদুর পুরনো ঘরের জিনিসপত্র কিছু বাছাই করতে হবে, আর সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তীর্থকে, কারণ দাদু নাকি প্রায়ই বলতেন কিছু জিনিস কেবল তার প্রিয় নাতির হাতেই থাকা উচিত। দাদুর সেই ঘরটায় ঢুকতেই তীর্থর মনে হল যেন পুরনো কালের গন্ধে ভিজে আছে প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি আসবাব। টালির চালের নীচ দিয়ে হালকা আলো এসে পড়ছে ধুলো জমা ট্রাঙ্ক আর বুকশেলফের ওপরে।…
 - 
				
সৌভিক রায়চৌধুরী পর্ব ১ বর্ষার বিকেল। গৌড়ের আকাশে কেবলই মেঘ জমছে। দূরে বাজ পড়ে, নদীর ধারে শাল, সেগুন আর কদম গাছের পাতা ভিজে নেমে আসে। দূর থেকে দেখা যায়, নদী যেন আছড়ে পড়ছে নিজেই নিজের বুকের ওপর। সেই জলপথ ধরে ধেয়ে আসছে এক একলা ঘোড়সওয়ার—ঘোড়ার খুরের শব্দ ডুবে যাচ্ছে বৃষ্টির ছন্দে। তার মাথায় পাগড়ি, চোখে তীক্ষ্ণ ছায়া, কপালে গাঢ় চিন্তার রেখা। সে কালাপাহাড়, নবাব সুলেমান কররানির সেনাপতি। কিন্তু তার জন্মনাম ছিল রামপ্রসাদ। একদা হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান, আজ ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত চরিত্রদের এক—ভাঙন, রূপান্তর, এবং আগুনের প্রতীক। এই পথ আজ যুদ্ধের জন্য নয়। এই পথ আজ তাকে নিয়ে যাচ্ছে তার…