অদ্রিজা চক্রবর্তী শরতের দুপুরটা ছিল অন্যরকম, বাসটা যখন কাঁচা রাস্তা ছেড়ে গোসাইপুরের চৌমাথায় এসে থামল, তখন চারদিকের আলো এক অদ্ভুত নরম সোনালি রঙে ঢেকে গেছে, যেন সূর্য নিজেকে ধীরে ধীরে ভাঁজ করে ফেলছে; শহরের ধুলোভরা গলিপথে এতদিন কাটিয়ে আসা ইলা মাথা উঁচু করে শ্বাস নিল, মনে হলো বুকের ভেতর যেন অচেনা এক স্বচ্ছ বাতাস জমে যাচ্ছে, যার সঙ্গে মিশে আছে কাঁচা ধানের গন্ধ, মাটির ভিজে গন্ধ, আর কোথাও অদৃশ্যভাবে ভেসে আসা কাশফুলের পরাগ; হাতে ছোট্ট ব্যাগ, ভেতরে ক্যামেরা, ডায়েরি, আর কয়েকটা বই—এবারের সফরটা নাকি নিছক অবকাশ নয়, ইলা বলেছিল নিজেকে, ‘এটা কাজের জন্যও’, কিন্তু আসলে সে জানত যে শহরের চাপে…
-
-
সৌমিতা রায় শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের সকাল যেন মাটির গন্ধ, রঙের খেলা আর সুরের মায়ায় মোড়া এক অলৌকিক প্রভাত। ফাল্গুনের হাওয়া যেন হাতের তালুর মতো কোমল, তবু তার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক ধরণের উচ্ছ্বাস যা আকাশের নীলকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। আঙিনায় গাছের গায়ে গায়ে হলুদ-কমলা ফুলের মালা ঝুলছে, পথের ধারে আলপনার নকশা, আর সকালবেলার আলোতে লাল মাটির পথ যেন আরও গাঢ় রঙে রাঙিয়ে উঠেছে। কিরণময়ী বাবার দোকানে বসে রঙিন পোড়ামাটির গয়না সাজাচ্ছে—গোলাপি আর সবুজ রঙের কানের দুল, মাটির মালা, ছোট ছোট পায়েলের মতো নকশা করা ব্রেসলেট। বাবার হাতে তৈরি গয়নার উপর তার নিজের আঁকা নকশা উৎসবের ক্রেতাদের চোখে আলাদা করে…
-
সায়ন চক্রবর্তী রবিবারের বিকেলটা এই গ্রামে যেন আলাদা আলোয় ঝলমল করে, সূর্যটা নদীর পাড়ে গড়িয়ে যেতে যেতে এমন এক নরম রঙ ছড়িয়ে দেয় যে হাঁসফাঁস করা সপ্তাহের ধুলোও মুহূর্তে থিতিয়ে আসে, আর সেই সময়েই শুরু হয় স্কুলবাড়ির বারান্দায় গানের আসর; হেডস্যার নিজের হাতে টাঙানো লণ্ঠনের নিচে মাদুর পাতা, ধুলো ধূসর কলাপাতায় রাখা গরম চা, কাঁচের গেলাসে তুলে দেওয়া মুড়ি-চানা, সরল অথচ শৌখিন এই আড্ডাটাই সৌম্যের সপ্তাহজুড়ে বেঁচে থাকার প্রাণবায়ু, যেহেতু সে জানে সোমবার থেকে আবার অঙ্কের ক-খ, ইংরেজির সরল বাক্য, ছাত্রদের টিফিনের গন্ধ আর খাতা পরীক্ষা—এই সব মিলিয়ে চার দেওয়ালের নীরসতা তাকে চেপে ধরবে; অথচ আজকের রবিবারটা অন্য রকম, কারণ…
-
আত্রেয়ী প্রধান মফস্বলের ছোট্ট স্টেশন। চারপাশে ধুলো উড়ছে, শিউলি গাছের নিচে পড়ে থাকা সাদা ফুলে ভরে গেছে পথ। বিকেলের আলো ধীরে ধীরে নেমে আসছে, আকাশের রং লালচে হয়ে উঠছে। এই সময়টায় স্টেশনটা যেন অন্যরকম লাগে—না শহরের কোলাহল, না গ্রামের নির্জনতা। মাঝামাঝি কোথাও দাঁড়িয়ে থাকা এই স্টেশন এক অদ্ভুত নীরবতার মধ্যে মোড়া। অমৃতা প্রায়ই এখানে আসে। তার কলেজ থেকে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনে পৌঁছোতে সময় লাগে পনেরো মিনিট। কেন আসে, সে নিজেও ঠিক জানে না। হয়তো এই স্টেশনের নীরবতা তার ভেতরের অস্থিরতাকে শান্ত করে। হয়তো ট্রেনের হুইসেল শুনলেই মনে হয় সে একদিন অচেনা কোথাও চলে যাবে, যেখানে কেউ তাকে চিনবে না। আজও…
-
অন্বেষা দত্ত শীতের মেঘলা সকালটা যেন নিজের ভিতরেই কথা বলছিল। জলপাইগুড়ির ছোট শহরের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সৃজনী ভেতরে ভেতরে কেমন একটা অব্যক্ত ঘুম ভাঙার শব্দ শুনতে পেল। দূরের মাঠে পৌষমেলা বসেছে— বাঁশের খুঁটি, তালপাতার ছাউনি, বেলুন, হাতে আঁকা ফেস্টুন; চায়ের ভাপ ওঠা কাপে দোকানিরা চুন-সুরক্ষা দেওয়া আঙুলে গরম গরম গোলমরিচ ছড়িয়ে দিচ্ছে। সৃজনীর লালচে কোটের ওপর ভেজা কুয়াশা বসে আছে, তবু সে থামল— শুধু মেলার গন্ধটা ভালো করে নেবার জন্য। কাঁচা কাঠ, তাজা উলের শাল, শুঁটকি নুডলসের হালকা ধোঁয়া, আর কোথাও থেকে ভেসে আসা “পর্যটকগণ, সামলে হাঁটুন”— এমন সব গন্ধ-শব্দে সকালটা তীব্র, কিন্তু শান্ত। কলকাতার চৌকো জীবনে সব আছে—…
-
অহনা কর্মকার এক ট্রেনের জানালা দিয়ে নীল সমুদ্রের এক ঝলক দেখা যাওয়ার মুহূর্ত থেকেই আর্যার মনে হচ্ছিল, এই যাত্রাটা তার জন্য কিছু আলাদা বয়ে আনবে। কলকাতার গুমোট, ধোঁয়াটে আকাশ, অফিসের অসংখ্য ডেডলাইন আর অবিরাম ফোনকলের জঞ্জাল থেকে মুক্তি পেতে কতদিন ধরে সে একটা একান্ত ছুটির স্বপ্ন দেখছিল। ট্রেন থেকে নেমে অটোরিকশায় চড়ে সমুদ্রের পথে যেতে যেতে তার চোখে ধরা পড়ল পথের দুই ধারের শাঁখফুল গাছ, শুকনো নারকেলের খোলায় ভরা আঙিনা, আর বালির গন্ধমাখা হাওয়া। স্টেশনের কোলাহল ফিকে হয়ে এল, গাড়ির শব্দ কমতে লাগল, আর সমুদ্রের ঢেউয়ের ফিসফিসানি ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল। ছোট্ট সমুদ্রতটের হোটেলে ব্যাগ রেখে সে যেন এক মুহূর্তও…
-
মেঘলা সেনগুপ্ত পর্ব ১: কুয়াশার ভেতর প্রথম দেখা দার্জিলিংয়ের সকালটা যে রকম হতে পারে—একটু কড়া চা, টিনের ছাদের উপর টুপটাপ জল, আর দূরে টাটকা ধোঁয়ার মতো ভেসে থাকা মেঘ—তৃষা ঠিক ওই রকম এক সকালে পাহাড়ে পৌঁছোল। রাতের ট্রেনের ক্লান্তি চোখে গড়িয়ে থাকলেও তার ভেতরে ছিল সেই পুরনো অস্থিরতা—নতুন জায়গা, নতুন আলো, নতুন মুখ। ব্যাকপ্যাকে দুটো লেন্স, একখানা নীল নোটবুক, আর একটা পুরনো স্কার্ফ—ওর মা দিয়েছিল কলকাতা থেকে বেরোনোর আগে—“পাহাড়ে হাওয়া লাগে, গলা ঢেকে রাখবি।” তৃষা মুখে হালকা হাসি টেনে স্টেশনের ভিড় পার হল, বাইরে বেরিয়ে এল কুয়াশার ধোঁয়াটে পর্দা ভেদ করে। তার বুক-পকেটে লিখে রাখা ছিল একটি নাম—“অভয় শেরপা”—স্থানীয় গাইড।…
-
সায়ন্তনী ঘোষ পর্ব ১: ট্রেন যখন ছাড়ে, মন তখন কোথাও আটকে থাকে কলকাতা স্টেশনটা যেমন সব সময় গমগম করে, সেদিনও ঠিক তেমনই ব্যস্ত আর পাঁপড়ের মতো শব্দে ভরা ছিল। তবে আমাদের ভেতরে যেন কোনও শব্দ ছিল না। আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম দু’জন দু’দিকে মুখ করে — কেউ কিছু বলছে না, কেউ কিছু বলার চেষ্টাও করছে না। ট্রেন ছাড়ার দশ মিনিট আগে, আমার হাতের বোর্ডিং পাসটা খানিকটা ভিজে গিয়েছিল, জানি না মেঘের জল ছিল না চোখের জল। রুদ্র আমার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, পিঠে রুকস্যাক, আর একটা নীল চেক শার্ট গায়ে। এই মানুষটার সঙ্গে আট বছর কেটে গেছে, অথচ আজও মাঝে…
-
সৃজন ঘোষ পর্ব ১ — শিবু কাকার দোকান ওরা দুজন দুটো আলাদা অফিসে কাজ করে। আলাদা ভবন, আলাদা ফ্লোর, আলাদা ম্যানেজার, আলাদা টাইমশিট—কিন্তু বিকেল তিনটা পঁচিশে দুজন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ে একটাই জায়গায়—শিবু কাকার চায়ের দোকানে। হ্যারিসন রোড আর ব্যাঙ্কশাল স্ট্রিটের সংযোগস্থলে ছোট্ট এক টিনের ছাউনি, তিনটে লাল চেয়ার, একটা কেরোসিন স্টোভ, আর একটা চুন-ছোপ খাওয়া কাঠের বেঞ্চ। এখানেই তুলি রোজ বিকেলে আসে মাথার ব্যথা সারাতে, আর রুদ্র আসে… আগে হয়তো কেবল চায়ের জন্যই আসত, এখন সে নিজেও জানে না ঠিক কেন আসে। তুলির অফিস ‘ইমার্জ ইভেন্টস’-এর তিনতলায়। একঘেয়ে মিটিং, থিম-পিচ, ক্লায়েন্ট ব্রিফ আর ইনস্টাগ্রামের ক্যাপশন নিয়ে সকাল থেকে বেলা পার…
-
ঋতুপর্ণা চৌধুরী শান্তিনিকেতনের পথচলা রুদ্রর হাত থেকে নোটবুকটা প্রায় খসে যাচ্ছিল, বাইক থেকে নামার সময়। শান্তিনিকেতনের হেমন্তের রোদ যেন কাগজের পাতার উপর কবিতার মতো পড়ছিল। কলকাতা থেকে পালিয়ে আসার পর প্রথমবার মনে হচ্ছিল, বেঁচে আছে। রাস্তার ধারে তাল গাছের সারি, লাল মাটি, আর ভোরের মিষ্টি শীত—সব মিলিয়ে একটা পুরনো কবিতা মনে হচ্ছিল চারপাশটা। “তুই আবার কবিতা লিখতে এলি, না পালাতে?”—প্রশ্নটা বাবার কণ্ঠে এখনো মাথার মধ্যে বাজছে। রুদ্র কিছু বলেনি, শুধু বলেছিল, “একটু সময় দে, নিজেকে খুঁজে নিচ্ছি।” কলকাতার ঘিঞ্জি ফ্ল্যাট, মা’র গুমরে রাখা কান্না, বাবার ভ্রুকুটি—এসব থেকে পালিয়ে এখানে এসেই যেন আবার শ্বাস নিতে পারছে সে। রুদ্র থাকছে শান্তিনিকেতনের…