অদিতি পাল এক রাতের গঙ্গা সবসময়ই অন্যরকম। দিনে যে ঘাটে ভিড় জমে, স্নান, পূজা, আরতির ভিড়ে যেখানকার সিঁড়িগুলো পর্যন্ত হারিয়ে যায় মানুষের ভিড়ে, রাত নামলেই সেই জায়গাটা যেন অন্য কোনো জগতে ঢুকে যায়। বাতাসে তখন থাকে কেবল জলের সোঁদা গন্ধ আর অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে কেবল রাতজাগা পাখির ডাক কিংবা দূরে ভেসে আসা কুকুরের হাহাকার ভাঙে সেই নীরবতা। এই গঙ্গার এক পুরোনো ঘাট নিয়ে ছোটো ছোটো কিশোর থেকে শুরু করে বুড়ো পাণ্ডারা পর্যন্ত বলাবলি করে—ওখানে নাকি মাঝরাতে কান্নার শব্দ শোনা যায়। লোকেরা বলে, সেই কান্না কোনো মানুষের নয়, কোনো বউয়ের আত্মা ওখানে কাঁদে। যার করুণ সুরেলা সিসকি শোনা যায়, কিন্তু…
-
-
কলকাতার চৌরঙ্গীর ব্যস্ত রাস্তার কোলাহল পেরিয়ে হঠাৎই যেন সময় থমকে যায় যখন চোখে পড়ে হোটেল নীহারিকা রেসিডেন্স। লাল-ইটের গাঁথুনি, কড়িকাঠের বারান্দা, আর চারতলার মাথায় পুরনো দিনের ঘড়িঘর—যার কাঁটা আজ বহু বছর ধরে নড়েনি। এই হোটেলটা যেন এক প্রাচীন জীবাশ্ম, চারপাশের আধুনিক কাচের ভবনের ভিড়ে হার মানতে না চেয়ে গোপনে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢোকার গেটের ওপরে ঝুলছে বড় বড় অক্ষরে নাম, তবে রঙ মুছে গেছে, কিছু অক্ষর ভাঙা। দরজার দুইপাশে দুটো পাথরের সিংহ, যাদের চোখে জমে থাকা ধুলোতে একটা চাপা বিষণ্ণতা। অরিন্দম মুখার্জী, তিরিশের শেষের এক অভিজ্ঞ ইনভেস্টিগেটিভ সাংবাদিক, ধীর পায়ে গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। তাঁর হাতে ছোট্ট একটি নোটবুক আর…
-
এক মাঘ মাসের শেষে মুর্শিদাবাদ শহরের ভেজা শীত এখনও হাড়ে হাড়ে কাঁপায়। গঙ্গার পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা রাজবাড়ির ছায়ায়, ড. সায়ন্তনী মুখোপাধ্যায় একটি পুরাতন প্রত্নতাত্ত্বিক ফাইল হাতে নিয়ে চুপ করে বসেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি অনুদানের ভিত্তিতে তিনি এসেছেন মুর্শিদাবাদের হারিয়ে যাওয়া ফোক-কালচার আর মুঘল-পরবর্তী ইসলামি নির্মাণকলা নিয়ে গবেষণার জন্য। কিন্তু আসল আগ্রহ তাঁর ছিল এক রহস্যময় বস্তু নিয়ে—যার নাম কেবলমাত্র একটি ডকুমেন্টে পাওয়া গিয়েছিল: “শ্বেতপাথরের বালিশ।” নথিতে লেখা ছিল, এটি এক সময় একটি প্রাচীন মসজিদের গোপন কামরায় রাখা হত এবং বলা হত যেই এই বালিশে একবার মাথা রাখে, সে মৃতদের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে—তাদের যন্ত্রণার স্মৃতি, তাঁদের না-বলা ইতিহাস যেন…
-
অরুণাভ দাশগুপ্ত এক নৈহাটি শহরের এক নিরিবিলি কোণে ছোট্ট একটা গলি, যার নাম শুনেই অনেকের মুখ থমকে যায়—“কবরস্থান রোড”। শহরের অন্য অংশে আলো ঝলমলে বাজার, রঙিন দোকান আর ব্যস্ততা থাকলেও এই গলিটা যেন স্থির এক মৃত অতীতের বুক ছুঁয়ে বেঁচে আছে। পুরনো বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে প্যাঁচপেঁচে গলির পাশে, যেন কারো দীর্ঘশ্বাস জমে আছে দেয়ালের ফাটলে। সেই গলিরই একদিকে, ধূসর রঙের তিনতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ভাড়া নেয় অভিক সেন, তার স্ত্রী তৃণা এবং তাদের চার বছরের ছেলে বিভান। শহুরে কোলাহল থেকে দূরে এক চিলতে শান্তি আর স্থিরতার খোঁজে তারা কলকাতা ছেড়ে এই শহরে এসেছে। অভিক একজন ফ্রিল্যান্স গ্রাফিক ডিজাইনার, ঘরে বসেই…
-
এক দক্ষিণ কলকাতার একটি তুলনামূলক পুরনো কিন্তু চৌকস আবাসন, নাম ‘উজ্জ্বল উদয়ন’। নাম শুনলেই মনে হয় যেন আলোয় ভরপুর কোনো স্বপ্নের মতো বাসস্থান। বাস্তবে অবশ্য চারতলার ওপরে ওঠা মাত্রই আলো যেন হঠাৎ একটু ফিকে হয়ে আসে, ছাদের নিচে জমে থাকে একরকম নরম, নিস্তব্ধ অন্ধকার। সেখানেই চতুর্থ তলার ফ্ল্যাট 4C-তে উঠল সদ্যবিবাহিত দম্পতি সায়ন ও মেঘলা দত্ত। বিয়ের পর মাত্র তিন মাস কেটেছে, সংসার এখনও নতুন, তাজা, রঙিন বাক্সে মোড়ানো স্বপ্নে ভরা। সায়নের চাকরি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায়, অফিস মূলত হাইব্রিড—তাই বেশিরভাগ সময় সে বাড়ি থেকেই কাজ করে। মেঘলা একটি বেসরকারি স্কুলে ইতিহাসের শিক্ষিকা, শান্ত, সংবেদনশীল স্বভাবের। আবাসনে উঠে আসার দিনটিতে সব কিছুই…
-
প্ৰনব দত্ত এক পত্রটা এসেছিল একেবারে অচেনা কাগজে, যেন তালপাতার কপি, তাতে আঁচড়ে আঁকা অদ্ভুত সব অক্ষর — সংস্কৃতের মতো, কিন্তু অচেনা ছন্দে বাঁধা। কলকাতার কলেজ স্টাফরুমে বসে চা খেতে খেতে যখন ঋদ্ধিমান ভট্টাচার্য চিঠিখানা খোলে, তখন সে ভাবেনি এমন কিছুর মুখোমুখি হবে। “আপনার পাণ্ডিত্য ও ঋগ্বেদের উপর আপনার বিশেষ জ্ঞান সমীহ জাগায়। অতএব, আপনাকে ত্রয়োদশ তিথির নবচণ্ডী যজ্ঞে উপস্থিত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি — মহাভৈরবী মন্দির, দক্ষিণ নবগ্রাম।” চিঠির নিচে কোনো নাম নেই, শুধু একটা সিলমোহর — গাঢ় লাল, আর তার উপর খোদাই করা এক নারীর মুখ, যার কপালে শূন্য। প্রথমে মজা ভেবেছিলেন ঋদ্ধিমান, কেউ হয়তো বানিয়ে পাঠিয়েছে। কিন্তু জায়গাটার…
-
অরূপ কুমার সেনগুপ্ত এক উৎসব মিত্র গাড়ি থেকে নামতেই তার চোখে পড়ল গ্রামের সেই ধূসর রঙা বিকেল, যেন ছায়ায় মোড়া এক মৃত সময়। গড়ভানিপুর — নামটা যতটা রূপকথার মত, বাস্তবটা যেন ঠিক ততটাই নিঃসাড়। কলকাতা থেকে ট্রেনে এসে তিন ঘণ্টা বাস জার্নি আর এক ঘণ্টা ইজে রিকশার পর, অবশেষে তার গবেষণার গন্তব্যে সে পৌঁছল। একটি পুরনো, প্রায় ভেঙে পড়া পাকা ঘর তার থাকার জায়গা; গ্রামের পাশেই গাছপালার ছায়ায় ঢাকা এই রাজবাড়ির ভগ্নাংশ। ছাদে শালপাতার স্তর, দেওয়ালে ছোপ ছোপ শ্যাওলা, আর মাঝে মাঝে ঘুঘুর ডাক। উৎসব ইতিহাসের ছাত্র— তার থিসিস “উনবিংশ শতকের বাংলার সামন্তপ্রথা ও মন্দির সংস্কৃতি” নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেফারেন্স লাইব্রেরিতে…
-
অতীন্দ্র সোম অধ্যায় ১: নতুন আলো নতুন জায়গায় সকালটা সবসময় অচেনা গন্ধে ভরা থাকে। রিয়া সেন যখন উত্তরবঙ্গের পাহাড়ঘেরা ওই নিঃসঙ্গ গ্রামে পৌঁছালেন, তখন আকাশটা ছিল ঘোলাটে, যেন পুরোনো কাপড়ের মতো রঙচটা। রিয়া একটা পুরনো জিপ থেকে নামলেন—হাতে একটা কাঁধব্যাগ, চোখে চশমা, পরনে হালকা সাদা কুর্তা আর ধুলোমাখা স্যান্ডেল। চারপাশটা যেন নিঃশব্দে তাঁকে পরখ করছিল। দূরে চা-বাগানের গাছেরা হাওয়ায় মাথা নেড়ে চলেছে, আর মাঝেমাঝে কিছু পাখির ডাক ভেসে আসছে—অপরিচিত, গভীর, নিঃশব্দকে কেটে দেওয়া একরকম সুর। রিয়া এই গ্রামে এসেছে একটা স্কুল খোলার উদ্দেশ্যে—সরকারি অনুদানে নয়, কোনো এনজিও-র প্রজেক্টেও নয়, নিজের স্বপ্নে। শহরের স্কুলের চাকরি ছেড়ে এসে সে ভেবেছিল, এই নির্জন…
-
সুমন দাস ১ শিলচরের একান্ত কোণে, যেখানে সরু গলি ছুঁয়ে উঠে যায় পাহাড়ের ঢালে এবং সেখানেই ছড়িয়ে আছে কামাক্ষ্যা মন্দিরের প্রাচীন কমপ্লেক্স—সেখানকারই এক জনমানবহীন অংশে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষ পুরোনো গ্রন্থাগার, ‘তান্ত্রচক্র পাঠাগার’। লাল ইটের দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে, কাঠের জানালার পাল্লা আধা খোলা, যেন কেউ সদ্যই ভিতরে ঢুকেছে—বা বেরিয়ে এসেছে। এখানে কর্মরত গ্রন্থাগারিক সায়ন্তন রক্ষিত, নিজেকে খুব সাধারণ মানুষ বলেই ভাবেন। ইতিহাসের ছাত্র হলেও জীবনের কোনো দিকেই তিনি সাহসী পদক্ষেপ নেননি। দিনগুলো কাটে ধুলো ঝাড়া, বই গোছানো, আর কামাক্ষ্যার মন্দিরে যাত্রার আগে কিছু সাধুদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে। কিন্তু সেইদিন সকালটা ছিল অস্বাভাবিক। বাতাসে এক রকম কাঁপুনি ছিল, এবং গ্রন্থাগারে ঢোকার মুখে…
-
১ তপন মিত্রের জীবনের প্রতিটি ছন্দ যেন গত কয়েক মাসে বদলে গেছে। ইতিহাসের শিক্ষক সে, কলকাতার একটি নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ায়। কিন্তু স্কুল, টিউশন, আর অতীতের ছায়ায় ঢাকা জীবন — তপনের দিনগুলো যেন কেমন একটা কুয়াশায় ঘেরা। একসময়ে সে ছিল প্রাণবন্ত, ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষক, বন্ধুদের আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু। এখনকার তপন নিঃসঙ্গ। কিছুদিন আগে প্রেমিকা ঋতাভার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভেঙে গেছে। কষ্ট আর অভিমান মিলেমিশে এক অদ্ভুত শূন্যতা তার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। এই শূন্যতা থেকে মুক্তির জন্যেই সে এখন ঘন ঘন বাইকে চড়ে বেড়ায়, একা। কলকাতার ভিড়, শব্দ আর স্মৃতি থেকে দূরে কোথাও গিয়ে কিছু সময়ের জন্য হলেও নিঃশ্বাস নিতে চায়।…