সৌম্য বক্সী অধ্যায় ১: রহস্যময় প্রাসাদের ডাক শহরের ব্যস্ততা থেকে দূরে, উত্তর কলকাতার এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে জোড়াসাঁকোর পুরনো প্রাসাদ। চারপাশে আধুনিক ভবন, গাড়ির কোলাহল, হর্নের শব্দ—সবই ভেসে আসে, তবু প্রাসাদটিকে ঘিরে যেন এক অদৃশ্য দেওয়াল তৈরি হয়েছে। ভাঙা রেলিং, শ্যাওলা ধরা দেয়াল, আধভাঙা সিঁড়ি আর অন্ধকারমাখা জানালা, সব মিলিয়ে জায়গাটা যেন সময়ের গর্ভে আটকে গেছে। মানুষজন এদিক দিয়ে এলে দূর থেকেই চোখ সরিয়ে নেয়, কারণ দীর্ঘদিন ধরেই এর চারপাশে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। কারও দাবি, রাতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখা যায় সাদা শাড়ি পরা এক নারীকে। কেউ বলে, জানালার কাচে প্রতিফলিত হয় অদ্ভুত ছায়া। আবার অনেকেই বিশ্বাস করে, প্রাসাদের…
-
-
গৌতম ভৌমিক ১ শরৎকালীন আকাশে সাদা মেঘের পালক যেন উড়ে বেড়াচ্ছে। দূরে সবুজ ধানের ক্ষেতে হালকা বাতাস বয়ে যায়, তার সঙ্গে মিশে আছে কাশফুলের দোল খাওয়া, গোধূলি রঙে রাঙা হয়ে ওঠা আকাশ, আর তারই ভেতর গ্রামজুড়ে শুরু হয়েছে দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি। গ্রামের চৌমাথার কাছে কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে প্যান্ডেল—এবার থিম ‘নবরূপিণী দুর্গা’। গ্রামের কারিগররা দিনরাত খেটে যাচ্ছেন, বাঁশের গাঁথুনির উপর কাপড়ের ক্যানভাস টাঙিয়ে তুলছেন মণ্ডপ, মাটির মূর্তির গায়ে তুলির টান টেনে আনছেন দেবীর সৌন্দর্য। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মুগ্ধ চোখে সেই কাজ দেখে বেড়ায়, আর যুবকেরা আলোর তার ঝোলাচ্ছে গলিপথে। বাজারে পুজোর ভিড় জমেছে; সবাই নতুন কাপড়, ধূপ, মিষ্টি, উপহার…
-
প্ৰদ্যুম্ন মুখার্জী অধ্যায় ১ – আতরের গন্ধে ভরা ঘর অরিত্র ছিল এক তরুণ ইতিহাসবিদ, যিনি অদ্ভুত বিষয় আর অজানা ইতিহাসের খোঁজে ঘুরে বেড়াতেন। কলকাতার শহরতলির বিস্মৃত গলি আর সময়ের ধুলো জমা রাজবাড়িগুলো তার গবেষণার মূল ক্ষেত্র। একদিন তিনি শুনলেন এক প্রাসাদের কথা, যা আজও স্থানীয়দের কাছে রহস্যে মোড়া। এই প্রাসাদটি একসময় জমিদার দীনেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ছিল, যার রাজকীয় ঐশ্বর্য বহু আগেই মাটির তলায় মিশে গেছে, কিন্তু রয়ে গেছে এক অদ্ভুত গুজব—প্রাসাদের ভেতরে একটি ঘর আছে, যেখানে ঢুকলেই ভেসে ওঠে আতরের গন্ধ। অথচ সেই ঘরে আর কেউ থাকে না, বরং বহু বছর আগে সেখানে এক নববধূর মৃত্যু হয়েছিল। গ্রামের মানুষজন এখনো সন্ধ্যার…
-
অরিন্দম এবং মাধুরী দীর্ঘদিনের পরিশ্রম আর সঞ্চয়ের ফলস্বরূপ অবশেষে তাদের স্বপ্নের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করল। শহরের ব্যস্ততম এলাকাগুলো থেকে দূরে, একটি আধুনিক কমপ্লেক্সের উচ্চতর তলার এই অ্যাপার্টমেন্ট যেন তাদের নতুন জীবন শুরু করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। বাইরের কোলাহল এবং ধুলো-ময়লা থেকে একেবারেই আলাদা, চারপাশে প্রশান্ত নীরবতা, সবকিছু সুন্দরভাবে সাজানো লবি, এবং প্রতিটি ফ্ল্যাটে আধুনিক সুবিধা—এগুলো সবই তাদের নতুন জীবনকে স্বাগত জানাচ্ছিল। অরিন্দম বেশ উদ্দীপনায় নতুন ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণ ঘুরে দেখছিল, তার চোখে আনন্দ আর সাফল্যের প্রতিফলন স্পষ্ট। মাধুরী, যদিও আনন্দিত, কিন্তু তার মনে মাঝে মাঝে এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছিল। ফ্ল্যাটের নিখুঁত নীরবতা মাঝে মাঝে যেন তার কানে অদ্ভুত শব্দের…
-
সুনন্দা সোম বীরভূমের দেউলতলা গ্রামটি যেন সময়ের গতির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে ঢেউখেলানো মাঠ, মাটির ঘর, পাখিদের ডাক আর নিরিবিলি দুপুর—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত শান্তির আবহাওয়া। কিন্তু এই শান্ত গ্রামটির বুকেই দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন মন্দির, যেন ইতিহাসের এক নিঃশব্দ সাক্ষী। কেউ কেউ বলে মন্দিরটির বয়স চারশো বছরেরও বেশি, আবার কেউ বলে আরও প্রাচীন। দিনের বেলায় এখানে গ্রামের মানুষ আসে পুজো দিতে, গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেয়, মন্দিরের চাতালে বসে বাচ্চারা খেলা করে। কিন্তু সূর্য ডুবে গেলেই সবকিছু যেন পাল্টে যায়। মন্দিরটিকে ঘিরে এক অদ্ভুত শূন্যতা নেমে আসে, এমন নীরবতা যেন কেউ অদৃশ্য হয়ে সারা পরিবেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। গ্রামবাসীরা…
-
নন্দিতা দাস ১ শীতলপুর নামের ছোট্ট গ্রামটি যেন সময়ের স্রোতকে অগ্রাহ্য করে দাঁড়িয়ে আছে। মাটির বাড়ি, কাঁচা রাস্তা, চারপাশে গাছপালা আর মাঝে দিয়ে বয়ে চলা শান্ত কুশাবতী নদী—সব মিলিয়ে গ্রামের এক সহজ, নিরিবিলি ছবি। দিনের বেলায় নদীর ধারে হাট বসে, গ্রামের ছেলে-বুড়ো সেখানে বসে গল্প করে, গৃহিণীরা আসে কলসি ভরতে। কিন্তু রাত নামলেই এই কুশাবতী নদীর চেহারা যেন অন্যরকম হয়ে ওঠে। আকাশজোড়া চাঁদ উঠলে নদীর কালো জলের ওপর ঝিলমিল আলো পড়ে, গাছের ছায়া জলে মিশে যায়, আর সেই নির্জনতাকে ভেঙে কখনও শোনা যায় এক অচেনা কান্নার শব্দ। গ্রামবাসী অনেক বছর ধরে সেই কান্নাকে চন্দ্রাবতীর অভিশাপ বলে মানে। কারণ বহু আগে,…
-
দিব্যেন্দু হালদার ১ গ্রীষ্মের শেষ বিকেল। গঙ্গার একটি শাখানদী নীরবে বইছে বাংলার এক অজ পাড়াগাঁয়ের পাশ দিয়ে। চারদিক জুড়ে সোনালি আলো ছড়িয়ে পড়েছে, গাছের পাতায় হাওয়ার মৃদু সুর বাজছে, অথচ গ্রামের মানুষজনের মধ্যে এক অদ্ভুত কৌতূহল ছড়িয়ে পড়েছে। খবর এসেছে—বারাণসী থেকে এক অঘোরী সাধক হঠাৎ এ গ্রামে এসে উপস্থিত হয়েছে। কালো অর্ধফাটা চাদর জড়ানো দেহ, গায়ে চন্দনের বদলে শ্মশানের ছাই, লম্বা জটাজুট বাঁধা চুল, গলায় কপালের মালা আর হাতে একটিমাত্র খুলি। তাকে দেখে প্রথমে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভয়ে কেঁপে উঠেছিল। গ্রামের কয়েকজন প্রবীণ বলল, “ওরা অঘোরী—শ্মশানই ওদের ঘর।” সত্যিই, সন্ধ্যা নামতেই তাকে দেখা গেল গ্রামসংলগ্ন শ্মশানঘাটে বসতে। একলা আগুন জ্বালিয়ে…
-
অয়ন দত্ত অধ্যায় ১ – মেলার ডাক গ্রামের বার্ষিক মেলার দিনটি এসেছে, এবং পুরো গ্রাম যেন এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাসে ভরে উঠেছে। সকাল থেকেই মাটির রাস্তাগুলো জমে ওঠে মানুষের পদচারণায়, বেচাকেনা এবং উৎসবের আওয়াজে। হরেক রকমের দোকান সাজানো হয়েছে মেলার মূলমাঠে—ফুলের গলায়, রঙিন বাতির সারিতে, মাটির খেলনা, কাঠের পুতুল, হাতের কাজের ঝুলনা, আর দেশী ও বিদেশী খাবারের তামাশা সব মিলিয়ে যেন গ্রামের প্রতিটি মানুষকে আকৃষ্ট করছে। শিশুরা উল্লাসে দৌড়াচ্ছে, মুখে হেসে খেলে এবং নাগরদোলার ধোঁয়া ও লাল, সবুজ, নীল বাতি তাদের চোখকে মুগ্ধ করছে। গ্রামের বৃদ্ধা-বৃদ্ধরা মাটির বেঞ্চে বসে এই দৃশ্যটি দেখছে, আর তাদের চোখে এক অদ্ভুত ভাব—একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে কিছুটা…
-
১ অন্ধকার নেমে এসেছে গ্রামের উপর, চারদিকে নিস্তব্ধতা আর ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। আকাশে তখন অর্ধচন্দ্র, তার আলোয় গাঢ় ছায়ার মতো ঘিরে আছে তালগাছ আর বাঁশঝাড়। গ্রামের মাঝখানে পুরোনো সেই পুকুর, যেটি নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত থাকলেও এতদিন কেউ বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু সেদিন রাতে হঠাৎ করেই অদ্ভুত কিছু ঘটে। প্রথমে ভেবেছিল হয়তো চাঁদের প্রতিফলন, কিন্তু দেখা গেল পুকুরের তলদেশ থেকে অস্বাভাবিক নীল আলো উঠছে—ধীরে ধীরে জলের উপরিতলে ছড়িয়ে পড়ছে। আলো এতটাই অচেনা আর মায়াবী ছিল যে গ্রামের লোকেরা ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল। বাতাস যেন হিম হয়ে গেল, পুকুরপাড়ের কুকুরগুলো হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল,…
-
সুমনা মাইতি অধ্যায় ১ – গ্রামের চৌহদ্দি পেরিয়ে কিছুদূর এগোলেই যে জঙ্গলঘেরা পথটা মাঠের দিকে চলে গেছে, তার মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে এক বিরাট পুরোনো বটগাছ। চারদিকে ঝুলে থাকা অজস্র দড়ির মতো শেকড় আর অন্ধকারে ঢেকে রাখা পাতার ছাউনি যেন দূর থেকে দেখলে আকাশের সঙ্গে মিশে থাকা কোনো দানবের রূপ মনে হয়। দিনের বেলা মানুষ সেখানে গরু চরাতে যায়, শুকনো কাঠ কুড়িয়ে আনে, কিংবা ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেয়। কিন্তু সন্ধ্যা নামলেই অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নেমে আসে, পাখিরা ডাকতে ডাকতে থেমে যায়, আর বটগাছের শেকড়ের ফাঁক দিয়ে ওঠে অচেনা ফিসফিস শব্দ। গ্রামের ছেলেমেয়েরা একে অপরকে ভয় দেখাতে প্রায়ই বলে—“ওই গাছটার নিচে ভূত…