ঋতুপর্ণা দাশগুপ্ত পর্ব ১: নদীর ডাক গাঁটা যেন অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় মোড়ানো ছিল। শীতল দমকা হাওয়া ভোরের আকাশে নীলচে ছাপ রেখে দিত আর দূরে শাল-সেগুনের বনের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসত নদীর গুঞ্জন। এই নদীর নাম ছিল কুলেশ্বরী। তবে মাধুরী ছোটবেলা থেকেই জানত, নামটা পুরোটা নয়—এই নদীর আরেকটা নাম আছে, একেবারে গোপন নাম, যা শুধু রাতের আঁধারেই ফিসফিস করে শোনা যায়। মাধুরী তখন দশ বছরের মেয়ে। প্রতিদিন বিকেলে সে বাঁশের ডাল দিয়ে বানানো কঞ্চির দোলনা নিয়ে নদীর ধারে যেত। নদীর পাড়ে বসেই তার পড়াশোনা, খেলাধুলো সবকিছু। কিন্তু এক পূর্ণিমার রাতে, হঠাৎ করেই সে শোনে অদ্ভুত একটা আওয়াজ—যেন নদী গুনগুন করছে। প্রথমে ভেবেছিল…
-
-
সুকান্ত আইচ পর্ব ১ পাড়ার নাম মধুবন কলোনি। কলকাতার এদিকেই, গঙ্গার ধার ঘেঁষা এক অদ্ভুত গলি। এই গলির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ—একজন টিউশন মাস্টার। নাম—বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী। বয়স পঞ্চান্ন, কিন্তু চেহারায় বোধহয় এখনও তিরিশের মতো এনার্জি। পরনে খাটো পাঞ্জাবি, চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা, আর মাথার উপরে তেল দেওয়া টাকের চারপাশে জেগে থাকা ঝাঁকড়া চুল। বিষ্ণুপদবাবু একসময় কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন, পরে কাজ ছেড়ে দিয়ে “প্রাইভেট টিউশনের দুনিয়া”য় নামেন। আর তারপর থেকেই তার জীবন অন্যদিকে ঘুরে গেল। আশপাশের পাড়ায় নাকি তিনি এমন সব বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন যে পড়ুয়ারা ভিড় জমিয়ে ফেলল। বিজ্ঞাপনে লেখা— “যে যা পড়তে চাও, এসো আমার কাছে। আমি সব শেখাই। অংক,…
-
তনয়া সেন বিকেলের শেষ আলোয় যখন সূর্য পাহাড়ের গায়ে ধূসর হয়ে গলে আসছিল, তখনই অরণ্যের বাস এসে পৌঁছল ছোট্ট গ্রামটায়। বাস বলতে আসলে একটা পুরোনো মিনিবাস, জানালার কাচ ঝাপসা, সিটের চামড়ায় ফাটল। গাঁয়ের নাম রাধাপুর—এমন নাম মানচিত্রে খুঁজলেও পাওয়া মুশকিল। তবু অরণ্যের মতো ফটোগ্রাফারের কাছে এই জায়গার টান ছিল অন্যরকম। শহরের কোলাহল, নামজাদা প্রকল্প, নামী রিসর্ট নয়—বরং অচেনা, অনাবিষ্কৃত জায়গার মধ্যে লুকোনো প্রকৃতির ছবি তুলতে তার সবচেয়ে ভালো লাগে। অরণ্যের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা ভারী, ভিতরে ক্যামেরা, লেন্স, ত্রিপড আর কিছু নোটবুক। বাসস্ট্যান্ডে নেমে চারপাশে তাকাতেই সে বুঝল, এই গ্রাম যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচা রাস্তা, খড়ের চালের ঘর, বাচ্চাদের…
-
অংশুমান রায় ঋদ্ধির আগমন কলকাতার শীত তখন পড়তে শুরু করেছে, তবে হাওয়ার ধার এখনো নরম। সন্ধের আলোয় গড়িয়াহাটের মোড় থেকে দক্ষিণে যে রাস্তা নেমে গেছে, সেই ফুটপাথগুলো ভরে উঠছে শালপাতার ধোঁয়া, ভাজা মুড়ির গন্ধ, আর দোকানিদের চেঁচামেচিতে। ড. অনির্বাণ দত্তের চেম্বার এই মোড় থেকে দশ মিনিট হাঁটাপথ। তিনতলা পুরনো বাড়ির দ্বিতীয় তলায়, কাঠের পালিশ করা দরজা, পাশে ছোট পিতলের নেমপ্লেট — Dr. Anirban Dutta, Consultant Psychologist. চেম্বারের ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা। দিনের শেষ রোগী চলে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। অনির্বাণ ডেস্কে হেলান দিয়ে কাগজপত্র গুছাচ্ছিলেন, তখনই নিচের দারোয়ান কাঁচা গলায় ডাকল, — “ডাক্তারবাবু, একজন এসেছেন… বলছেন খুব জরুরি।” তিনি চোখ তুলে…
-
তনুশ্রী রায় এক রোজকার মতো সকালটা শুরু হয় একঘেয়ে নিয়মে—চা, শাড়ির আঁচল গুঁজে নেওয়া, আর বাড়ির সদর দরজাটা হালকা শব্দে টেনে বন্ধ করা। শহরের কিনারে পুরোনো একটি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষপ্রাচীন ডাকঘরটি যেন সময়কে আটকে রেখেছে নিজের দেওয়ালে। দুলালী ঘোষ, যাকে শহরের সকলে ‘দিদি’ বলে জানে, প্রতিদিন সকাল সাড়ে ন’টায় এসে সেই সাদা-লাল রঙের গেট ঠেলে ভেতরে ঢোকে। দেওয়ালে ঝোলানো পিতলের ঘড়িটা তার আগমনের সাক্ষী হয়ে থাকে, তার চলার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে চুপচাপ টিক টিক করে। খোলা জানালার ফাঁকে মৃদু আলো ঢোকে, আর তাতে ধুলোর কণাগুলি বাতাসে ভাসে যেন স্মৃতির মতো। দুলালী টেবিলে রাখা তার কাঠের বক্স খোলে, যেখানে…