ঋতব্রত মুখার্জি পর্ব ১ : প্রথম দেখা সেদিন আকাশটা অদ্ভুত রঙে ভরে উঠেছিল। সারাদিনের গুমোটের পরে বিকেলের শেষে নামল হঠাৎ বৃষ্টি। শহরের ব্যস্ত রাস্তায় সবাই দৌড়চ্ছে—কেউ অটো ধরছে, কেউ বাসের জন্য ছুটছে, কেউ ছাতা ভিজিয়ে হাঁটছে। আমি তখন কলেজ থেকে ফিরছিলাম, হাতে কয়েকটা ফাইল আর এক কাপ কাগজের কফি। মনে হচ্ছিল—এই ভিজে ভিজে শহরে কেবল একটাই শব্দ চলছে, বৃষ্টির টুপটাপ। বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়লো তাকে। নীল সালোয়ার পরে, কাঁধে ভেজা চুল ঝুলছে, একহাতে কালো ছাতা, তবু বৃষ্টির ফোঁটা তাকে যেন রেহাই দিচ্ছিল না। যেন ছাতার আড়াল থেকেও বৃষ্টি তাকে ছুঁয়ে ফেলছিল বারবার। তার চোখদুটো ছিল একেবারে সামনে, কিন্তু মনে…
-
-
নন্দিতা রায়চৌধুরী পর্ব ১: শহরের রাতের জানালা শহরের এই দিকটায় রাত নামতে সময় লাগে না। দিনের কোলাহল ধীরে ধীরে গলে যায়, গাড়ির হর্ন আর মানুষের ভিড় একসময় মিলিয়ে যায় নিঃশব্দের ভেতরে, শুধু দূরের আলোয় রঙিন হয়ে থাকে আকাশটা। রিমি জানলার সামনে বসে ছিল একা। ছোট এক বেডরুম ফ্ল্যাট, ভেতরে খুব বেশি আসবাব নেই—শুধু একটা পুরোনো সোফা, বুকশেলফে ঠাসা কয়েকটা বই, আর এককোণে অগোছালো গিটার। সবকিছুই যেন অসমাপ্ত, অর্ধেক। ঠিক যেমন তার জীবন। সে জানলার কাঁচে হাত রাখল। গরম শরীর থেকে শীতল কাচে স্পর্শ ছড়িয়ে গেল। বাইরে রাস্তার আলো, মানুষের ছায়া, চলমান ছুটোছুটি—সবই যেন অন্য কারও জীবন। তার জীবন আলাদা, নিঃসঙ্গতায়…
-
নবনীতা সেনগুপ্ত নীলাঞ্জনার শৈশব কেটেছিল নদীর ধারের ছোট্ট এক গ্রামে। দিনগুলো ছিল সাদামাটা, কিন্তু সেই সরলতায় এমন এক আবেশ ছিল যা তাকে সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়াবে। সকালের শুরু হতো পাখির ডাক দিয়ে, দুপুরের গরমে ধানের গন্ধ ছড়িয়ে যেত বাতাসে, আর সন্ধ্যা নামলেই আকাশটা ভরে উঠত অসংখ্য তারায়। তখনই নীলা অনুভব করত, এই আকাশের ভেতর যেন লুকিয়ে আছে অদ্ভুত এক ডাক, এক রহস্য, যা তাকে ছুঁয়ে যায় প্রতিদিন। এই শৈশবের দিনগুলোতে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ছিল ঈশান। বয়সে তিন বছরের বড় হলেও তাদের মধ্যে কোনো ভেদরেখা ছিল না। ঈশান দূর সম্পর্কের দাদা, শহরে পড়াশোনা করে ছুটিতে গ্রামে ফিরত। নীলার কাছে সে ছিল…
-
নন্দিতা রায় ১ বৃষ্টিভেজা ব্যাঙ্গালোরের সন্ধ্যা তখন গা ছমছমে করে তুলেছিল, যখন অর্ণব সেনের ফোনটা বেজে উঠেছিল। সে তখন একটি ক্লায়েন্ট মিটিংয়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, কফির কাপে চুমুক দিয়ে ল্যাপটপে পিক্সেল শিফট ঠিক করছিল। কিন্তু সেই একটানা বেজে চলা ফোনের শব্দ যেন আচমকা একটা অজানা সঙ্কেত হয়ে ঢুকে পড়ে তার শরীরের ভেতর। স্ক্রিনে নামটা দেখে মুহূর্তে নিঃশব্দ হয়ে যায়—‘ডা. অনিরুদ্ধ রায়’। সে বুঝে যায় কিছু একটা ভুল হয়েছে। ফোন ধরতেই ওপার থেকে ভারী গলায় খবরটা আসে—“আমার দুঃখিত অর্ণব, তোমার মা আমাদের মাঝে নেই।” কথাটা যেন স্থির বাতাসের মতো ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। কিচ্ছু বলতে পারে না অর্ণব। এত ব্যস্ততায় গা ভাসানো একটা…
-
কুহেলি দত্ত ১ বসন্তের সেই দুপুরে, যখন পাতাঝরা শিমুল গাছের তলায় বাতাস হালকা রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছিল, মেঘলার জীবনে প্রথমবার ঢুকে পড়েছিল ঈশান। কলেজের নতুন ক্লাসরুমে যখন সবাই নিজেদের চেয়ারে বসে কেমন যেন অচেনা অস্বস্তিতে গুটিয়ে ছিল, তখন মেঘলার চোখ পড়ে এক ছেলেকে—লম্বা, শান্ত মুখ, চোখের ভেতরে কেমন এক গভীর দৃষ্টি, যেন বহু কথা জমে আছে সেখানে। ঈশানের পাশে বসেছিল মেঘলা, নিছক সিট খালি ছিল বলে, কিন্তু সেই সিট ভাগাভাগি করতে করতেই দুজনের ভেতরে জড়িয়ে গিয়েছিল এক অদৃশ্য সুতো, যেটা তারা প্রথমে টেরও পায়নি। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, দুজনে একসাথে ক্লাসে যেত, লাইব্রেরিতে বসে একে অপরের কবিতার খাতা দেখত,…
-
স্মিতা সেন বিকেলটা ঘন বর্ষায় ভিজে গিয়েছিল যেন আঁধারের রঙে। দিগন্তজোড়া নীলচে মেঘে ঢেকে থাকা আকাশের তলায়, ঈশান তার হাতের ব্যাগটা টেনে তুলল ট্যাক্সি থেকে নামার সময়। সেই পুরনো বাংলো, যার ছাদে কচুরিপানার পাতার মত শ্যাওলা জমেছে, তার দালানে দাঁড়িয়েই সে প্রথম রূপসীকে দেখেছিল। সে এক অপূর্ব মুহূর্ত। যেন কেউ জলরঙে এঁকে দিয়েছে। মাটি ছোঁয়া শাড়ির প্রান্তটা কাঁধ থেকে খানিকটা পিছলে পড়েছে, ভেজা কেশরাশি কপাল ছুঁয়ে ঝুলছে, আর চোখে সেই চিরচেনা বিষণ্ণতা, যেটা শুধু একাকিত্বের গায়ে জন্মায়। ঈশান চোখ সরাতে পারছিল না। শিল্পী মাত্রেই সৌন্দর্যে হারিয়ে যায়, কিন্তু এই সৌন্দর্যটা যেন ক্যানভাসের বাইরের কিছু—নাড়ি ছোঁয়া, নিঃশ্বাসের মতো বাস্তব। “আপনি নিশ্চয়ই…
-
অনুত্তমা গাঙ্গুলী পর্ব ১ রুদ্রপ্রভা সেন সকাল ন’টায় ঠিক সময়েই ‘একান্ত প্রকাশ’-এর কাঠের দরজাটা খুলে দেন। কাঠে জং ধরেছে, একটু ঠেললে কঁকিয়ে ওঠে, যেন অফিসটাও জানে—তাঁর ভিতরটা এখন একরকম বিষণ্নতা আর অভ্যাসের বোঝায় ভারী হয়ে আছে। বাইরে একটানা বৃষ্টি পড়ছে, পার্কস্ট্রিটের সেই পুরনো ইমারতের তিনতলায় তাঁর ছোট্ট অফিস, যার জানালার কাঁচে কুয়াশা জমে থাকে দিনের বেশিরভাগ সময়। রুদ্রপ্রভা বত্রিশে পা দেওয়া একা মহিলা। না, একা শব্দটা নেহাতই সামাজিকভাবে। ভেতরে তাঁর ভিতর আরেকটা রুদ্রপ্রভা থাকে, যে রাতবিরেতে কাঠের টেবিলের এক কোণে বসে অজস্র পাণ্ডুলিপি পড়ে, যেগুলো হয়তো কেউই পড়বে না। কিন্তু তবুও সে পড়ে। আজ সকালটা একটু অন্যরকম। রিসেপশন টেবিলের ওপর…
-
ঋতুপর্ণা চৌধুরী পর্ব ১: সেই দিনের আলো নীলপাহাড়ের গায়ে রোজ সন্ধ্যে নামে অদ্ভুত এক নরম রঙে। যেন আকাশ নিজেই তার ক্লান্তি গায়ে মেখে পাহাড়ের কোলে শুয়ে পড়ে। সেই রঙের নাম কেউ জানে না, কিন্তু ঊর্মির চোখে সে রঙের ছায়া আজও লেগে থাকে, বছর পেরিয়ে গেছে তবু। শিলারি-গাঁওয়ের গায়ে ছোট্ট কাঠের হোমস্টের বারান্দায় বসে সে দিনভর বই পড়ে। কিন্তু বইয়ের পৃষ্ঠায় শব্দগুলো যেন আবছা হয়ে আসে — যেন বই পড়ছে না, বরং অতীতের পাতাগুলোতেই বারবার হারিয়ে যাচ্ছে। তিন বছর আগে ঠিক এই জায়গাতেই প্রথম দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে — অয়ন। অয়ন, পুরো নাম অয়ন সেনগুপ্ত, ছিল উত্তর কলকাতার ছেলে। পলিটেকনিক কলেজে…
-
অনিমা সেন পর্ব ১: প্রথম দেখা কলকাতার এক ঐতিহ্যবাহী কফি হাউসে, একটি স্বাভাবিক বিকেল, যেখানে মানুষের ভিড় এবং কফির গন্ধ মিশে এক অদ্ভুত মাধুর্যে পরিণত হয়, সেখানে প্রথমবারের মতো দেখা হয় নিলয় এবং রাধিকার। সেদিন রাধিকা কোনো কারণে তার usual জায়গা ছাড়িয়ে অন্য একটি টেবিলে বসেছিল। কফি হাউসে এসেছে তার বন্ধুদের সাথে কিছু সময় কাটাতে। তবে, তার মনের মধ্যে কিছু ছিল, যেটি সেদিন সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায় পেয়ে গিয়েছিল। সে আসলে কিছুটা বিধ্বস্ত, কিছুটা ক্লান্ত, আর ঠিক তখনই নিলয়ের চোখ পড়েছিল তার ওপর। নিলয় ছিল এক উচ্চাভিলাষী তরুণ। লেখক হতে চেয়েছিল, কিন্তু সে এখন এক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। সে…
-
সৃজন ঘোষ পর্ব ১ — শিবু কাকার দোকান ওরা দুজন দুটো আলাদা অফিসে কাজ করে। আলাদা ভবন, আলাদা ফ্লোর, আলাদা ম্যানেজার, আলাদা টাইমশিট—কিন্তু বিকেল তিনটা পঁচিশে দুজন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ে একটাই জায়গায়—শিবু কাকার চায়ের দোকানে। হ্যারিসন রোড আর ব্যাঙ্কশাল স্ট্রিটের সংযোগস্থলে ছোট্ট এক টিনের ছাউনি, তিনটে লাল চেয়ার, একটা কেরোসিন স্টোভ, আর একটা চুন-ছোপ খাওয়া কাঠের বেঞ্চ। এখানেই তুলি রোজ বিকেলে আসে মাথার ব্যথা সারাতে, আর রুদ্র আসে… আগে হয়তো কেবল চায়ের জন্যই আসত, এখন সে নিজেও জানে না ঠিক কেন আসে। তুলির অফিস ‘ইমার্জ ইভেন্টস’-এর তিনতলায়। একঘেয়ে মিটিং, থিম-পিচ, ক্লায়েন্ট ব্রিফ আর ইনস্টাগ্রামের ক্যাপশন নিয়ে সকাল থেকে বেলা পার…