শ্রাবণী বসু অধ্যায় ১: অচেনা পরিচয় শহরের ব্যস্ততম রাস্তায়, যানজট আর মানুষের ভিড়ে ডুবে থাকা এক বিকেলে, অরণ্যের চোখ হঠাৎ আটকে যায় এক অপরিচিত মুখে। মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে বাসস্ট্যান্ডের কোণে, লাল-সাদা শাড়ি পরা, কাঁধে বইভরা ব্যাগ, আর চোখে যেন এক অদ্ভুত শান্তি। গরমে ক্লান্ত সবাই যখন বিরক্তিতে কুঁকড়ে আছে, মেয়েটির মুখে তখনও একরকম প্রশান্ত ভাব। অরণ্য জানে না কেন, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তার বুকের ভেতর ধক করে ওঠে—যেন বহুদিনের হারিয়ে যাওয়া কাউকে আবার খুঁজে পেল। মেয়েটির চুল এলোমেলো হয়ে কপালে লেগে আছে, বাতাসে দুলে পড়ছে গাল ছুঁয়ে, আর সে এক অচেনা জগতে হারিয়ে যেতে চাইছে। অরণ্য থেমে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে…
- 
				
 - 
				
অভিক ধর শহরের জীবন মানেই একটানা দৌড়ঝাঁপ, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অফিসের চাপ, যানজট, হর্নের শব্দ আর ব্যস্ততার ক্লান্তি। কংক্রিটের এই জগতে মানুষ খুঁজে ফেরে একটুখানি শান্তির আশ্রয়, যেখানে নেই হইচই, নেই ক্লান্তি—শুধু নিজের মতো করে বেঁচে থাকার সুযোগ। এই শহরের এক বহুতল ভবনের ছাদে ঠিক তেমনই এক আশ্রয় তৈরি করেছে নায়িকা তৃণা। দিনভর অফিসের কাজ আর একা থাকার নিঃসঙ্গতার মাঝেও তার মন খুঁজে নেয় অন্যরকম আনন্দ—গাছপালার সান্নিধ্য। ছাদের এক কোণ জুড়ে সাজানো টব, ড্রাম, পুরোনো বালতি আর কৌটোতে নানা রঙের ফুল, ঔষধি গাছ আর শাকসবজি। প্রতিদিন সকালে কাজের আগে সে গাছগুলোকে জল দেয়, শুকনো পাতা ছেঁটে ফেলে, আর বিকেলে…
 - 
				
সুমন্ত নায়েক ১ গঙ্গার ঘাটের বিকেলবেলা যেন এক রহস্যময় আঙিনার মতো ছিল, যেখানে মানুষের ভিড়, ঘাটের সিঁড়িতে বসা প্রার্থনায় নিমগ্ন বৃদ্ধা, ঘুড়ি ওড়ানো ছেলেরা, আর বাতাসে মিশে থাকা ধূপ-গঙ্গাজলের গন্ধ একসঙ্গে মিলেমিশে এক অন্য রকম আবহ তৈরি করেছিল। সেদিন সূর্যাস্তের ঠিক আগে, আকাশে রঙিন কমলা-সোনালি আভা মেখে যখন গঙ্গার শান্ত জলে প্রতিফলন তৈরি হচ্ছিল, তখনই তাদের দুজনের চোখ প্রথমবারের মতো একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়। ভিড়ের মধ্যে এক মুহূর্তের জন্য দুজনেই যেন সময় ভুলে যায়—চোখাচোখির সেই ক্ষণস্থায়ী টান অদ্ভুত এক নীরবতা তৈরি করে, যা চারপাশের কোলাহলের মধ্যে থেকেও কানে বাজতে থাকে স্পষ্ট সুরের মতো। মেয়েটি ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তার শাড়ির…
 - 
				
অনুরিমা মিত্র ১ কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরে লুকিয়ে থাকা পুরোনো লাইব্রেরিটি যেন সময়ের কোনো থেমে থাকা ঘড়ি। চারপাশে নীরবতা, মাঝে মাঝে কেবল পাতার ওলটানোর শব্দ কিংবা দূর থেকে ভেসে আসা কারো কাশির আওয়াজ শোনা যায়। এই নিস্তব্ধতার মাঝেই অনির্বাণ যেন খুঁজে পায় নিজের আশ্রয়। তার সহপাঠীরা যখন ক্যান্টিনে আড্ডা দিচ্ছে কিংবা মাঠে খেলায় ব্যস্ত, তখন সে লাইব্রেরির কাঠের লম্বা টেবিলে বসে পড়ে ইতিহাসের বই, পুরোনো পত্রিকা আর আর্কাইভ ঘাঁটাঘাঁটি করে। অনির্বাণকে দেখলে অনেকেই বলে—সে যেন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে জানে না, তার জগত অন্য কোথাও। কিন্তু সে জানে, এই নিস্তব্ধতা তাকে শান্তি দেয়, শব্দের বাইরে এক গোপন কথোপকথন তাকে টানে।…
 - 
				
অংশুমান সেনগুপ্ত কোলাহলমুখর শহরের ভেতরেও কিছু জায়গা থাকে যেখানে সময় যেন থেমে যায়, আর মানুষ খুঁজে পায় একটুখানি নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা। শহরের পুরোনো এক গলির ভেতর লুকিয়ে আছে ছোট্ট একটি ক্যাফে—“স্মৃতির ক্যাফে।” বাইরে থেকে খুব বেশি চমকপ্রদ নয়, কাঠের দরজার উপরে ঝুলছে ম্লান হয়ে যাওয়া নামফলক, জানালার কাচে প্রতিদিনের ধুলো জমে থাকে। কিন্তু দরজার ভেতরে ঢুকলেই অন্য এক জগৎ—হালকা বাদামি আলোয় সাজানো কাঠের টেবিল, দেয়ালে কিছু সাদা-কালো পুরোনো ছবি, আর কোণের শেলফে ছড়িয়ে থাকা বইপত্র। এখানে প্রবেশ করা মানেই শহরের কোলাহল ফেলে আসা, যেন অন্য এক জগতে ঢুকে পড়া। সেই সন্ধ্যাতেই অর্ণব প্রথমবার এই ক্যাফের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। বাইরে…
 - 
				
পিউ রায় এক অভীক যখন শহরের ব্যস্ত রাস্তা, ক্লান্ত করা যানজট এবং কংক্রিটের পাহাড় ছেড়ে গ্রামে প্রবেশ করে, তখন তার মন যেন এক নতুন পৃথিবীর দিকে উন্মুক্ত হয়ে যায়। গাড়ির জানালা দিয়ে যে সব সবুজ মাঠ, বিস্তীর্ণ খামার, এবং ধীরে ধীরে পাহাড়ের পটভূমিতে ছড়িয়ে থাকা পুরনো খামারবাড়ি দেখা যাচ্ছিল, তা যেন শহরের ব্যস্ততা এবং ধোঁয়াশাকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলিয়ে দেয়। গাড়ি যখন ধীরে ধীরে কাঁচা পথের দিকে প্রবেশ করে, অভীক দেখতে পায় কাদা জমির উপর বৃষ্টির জল ঢেউ খেলাচ্ছে, আর পাখির ডাক পরিবেশকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলছে। শহরের কাচ-লোহা আর কংক্রিটের গন্ধ যেন একেবারে বাতাসে মিলিয়ে গেছে, কিন্তু গ্রামে প্রবেশের…
 - 
				
অঙ্কিতা ভট্টাচাৰ্য এক প্রথম দেখা, প্রথম স্পর্শ, প্রথম নিঃশ্বাসে ভেসে আসা এক অচেনা গন্ধ—এসবই এক গবেষণার কাজে গ্রামের অচেনা জমিদারবাড়ির দিকে এগিয়ে আসা তরুণী ইরা সেনের কাছে যেন এক অজানা অভিজ্ঞতা। কলকাতার ব্যস্ত ভিড়, শহুরে ছন্দ, লাইব্রেরির ধুলো-মাখা বইয়ের স্তূপ ছেড়ে সে এসেছে এই প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে আজও সময় যেন ঘুমিয়ে আছে শেকড়ের মধ্যে। তার গবেষণার বিষয় ছিল বাংলার পুরনো জমিদারবাড়ি ও তাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্থাপত্য এবং সংস্কৃতি, কিন্তু কাগজে-কলমে যেটা শুষ্ক মনে হয়, বাস্তবে এসে দাঁড়ালে তার মধ্যে লুকিয়ে থাকে অদ্ভুত রহস্য আর আবেগ। সেই অনুভূতিই ইরার বুক কাঁপিয়ে দিল যখন রিকশা থেকে নামতেই তার চোখে ভেসে উঠল…
 - 
				
পৌলমী বসু এক সকালের প্রথম আলোয় যখন ঘুম ভাঙে, তখন থেকেই সোমার দিন শুরু হয় দায়িত্বের দীর্ঘ তালিকা নিয়ে। রান্নাঘরে চায়ের কেটলি চড়ানো, টিফিনের বাক্স সাজানো, মৌয়ের স্কুলব্যাগ গুছিয়ে দেওয়া, কাপড় কাচা—সবই যেন একটা অভ্যাসের অংশ। কিন্তু এই অভ্যাসের ভেতরে কোথাও এক অদৃশ্য শূন্যতা দিন দিন গভীর হচ্ছে। জানলার ফাঁক দিয়ে আসা আলো তার চোখে পড়ে, কিন্তু সেই আলো তাকে আনন্দ দেয় না। বরং মনে হয়—এই আলোও যেন কেবল আরেকটা রুটিনকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। রান্নাঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে সোমা যখন নুন-মশলার অনুপাতে তরকারি কষে, তখন তার ভেতরে ভেসে ওঠে প্রশ্ন—এটাই কি তবে তার জীবন? রান্নাঘরের কড়া গন্ধ, চায়ের ফুটন্ত বুদবুদ, কিংবা…
 - 
				
সঙ্গীতা দাস ১ মেঘলার শৈশব কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের এক প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে কাঁচা রাস্তা, বিস্তীর্ণ ধানের মাঠ আর দিগন্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা আকাশ তার শৈশবের নিত্যসঙ্গী। সকালবেলা কাকডাকা ভোরে মাটির ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া আলোয় সে ঘুম ভাঙত, আর সবচেয়ে প্রিয় সময় ছিল সন্ধ্যা। গ্রামের খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তার বাবার একটি পুরোনো রেডিও ছিল—যার শরীর ক্ষয়ে গেছে, অনেক সময় স্ট্যাটিক আওয়াজের ভেতরেই কণ্ঠ শোনা যেত। সেই রেডিওতে কখনো হঠাৎ বিমান চলাচলের খবর, কখনো বেতারে ভেসে আসা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের ভাঙাচোরা সিগন্যাল শোনার সময় তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠত। সে জানত না…
 - 
				
নন্দিতা বসু কলকাতার এক গরম দুপুর। শহরের রাস্তাঘাট তখনও গ্রীষ্মের দমচাপা গরমে হাঁসফাঁস করছে। সূর্যের তীব্র আলো জানালা পেরিয়ে লাইব্রেরির ভেতরে ঢুকছিল, কিন্তু ভেতরের শীতল নীরবতা বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক অনুভূতি তৈরি করেছিল। লাইব্রেরির চিরচেনা গন্ধ—পুরনো বইয়ের মলাট, ধুলোমাখা পাতার গন্ধ, আর কাঠের তাকের গন্ধ মিশে তৈরি করেছে এক অনন্য পরিবেশ। অনন্যা, ইতিহাস বিভাগের মেধাবী ছাত্রী, প্রতিদিনের মতো নিজের গবেষণার কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। রবীন্দ্রনাথের লেখার ওপর তার বিশেষ আগ্রহ, তাই প্রায়ই তাকে লাইব্রেরির কবিতা বিভাগে পাওয়া যায়। সেদিনও সে মন দিয়ে খুঁজছিল একখানা বই—“গীতাঞ্জলি”-র প্রথম সংস্করণের একটি বিশেষ কপি। তাকের সামনে দাঁড়িয়ে বইটা খুঁজতে গিয়ে হঠাৎই সে…